অনেকগুলো দেশ ঘুরেছি আমি। কিন্তু মন কেড়ে নিয়েছে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। এতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাট আমি আর কোথাও দেখিনি। হুম ইয়ূরোপ অনেকটাই পরিচ্ছন্ন, তবে জাপানের মতো নয়। প্রায় পাঁচটি বছর ছিলাম আমি জাপানে। মোটামুটি বহু জায়গা দেখা হয়ে হয়েছিলো। জাপানের ট্যুরিষ্ট স্পটগুলো প্রতিটিই আকর্ষণীয়। অনেক ভীড়ের মধ্যেও কারো সাথে কারো ধাক্কা লাগছে না, কোথাও কেউ এলোমেলোভাবে একটুকুও আবর্জনা ফেলছে না। এমন একটি দেশে থাকার পর পৃথিবীর কি আর কোনো দেশ ভালো লাগে? যাই হোক ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে হঠাৎ একদিন প্ল্যান করা হয় জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ফুজি মাউন্টেন দেখার। আর এটির অবস্থান রাজধানী টোকিও থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে হনশু দ্বীপে। ফুজি সান শুধু তো পর্বতশৃঙ্গই নয়, এ যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি! জীবনের প্রথম আগ্নেয়গিরি দেখার সুযোগ পেতে চলছি, মনের সে যে কি রোমাঞ্চকর অবস্থা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।
পাহাড় আর অরণ্য আমার খুব প্রিয়। আরও লাফিয়ে উঠলাম। সেদিন ছিলো রবিবার, অনেক সকালে উঠে প্রস্তুত হয়ে বের হলাম। তখন আমার ছেলের বয়স দুই বছর। তাই ওর জন্য খাবার সাথে নেয়া। স্ট্রলারও সাথে নিতে হতো, যদি হাঁটতে না চায়। যাক প্রথমে আমরা হিয়োশি স্টেশন থেকে ট্রেনে করে গেলাম ইয়োকোহামা। সকলেই জানেন জাপান হচ্ছে ট্রেন নির্ভর জীবন-যাত্রা। তারপর ওখানে আবার ট্রেন বদল করে কোজু স্টেশন। সেখান থেকে আবার দু’বার ট্রেন বদল করে ফুজি মাউন্টেন পৌঁছালাম। স্টেশন থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হলো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো ফুজি মাউন্টেনকে। জাপানিরা ফুজি সান বলে। ‘সান’ শব্দটির অর্থ হলো ‘মিস্টার/মিস’। জাপানীদের কাছে বড়ো পবিত্র স্থান এই ফুজি মাউন্টেন। এর উচ্চতা ৩ হাজার ৭৭৬ মিটার/১২,৩৮৯ ফুট। পর্বতের একেবারে শীর্ষে উঠতে গেলে দশটি স্টেশন পার হতে হয়। পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত গাড়ীতে ওঠা যায়।
আমরা পঞ্চম স্টেশন থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। সেদিন অবশ্য মাউন্টেনে প্রচুর মেঘ জমেছিলো, তাই উপরিভাগের তুষার দেখতে পাইনি। ওখানকার আবহাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টায়। আমার ছেলেটা খুবই খুশী এভাবে প্রকৃতির মধ্যে আসতে পেরে। আমি তো আরও নাচছি, দৌঁড়ে দৌঁড়ে উঠছি। চারিদিকে কি সবুজ। যে পথ দিয়ে চলছি কালো মাটি আর পাথরে ছড়ানো। আসলে ফুজি সানের নীচের অংশটি নাকি সবসময়ই জ্বলতে থাকে। আর উপরের অংশ তো বছরের অধিকাংশ সময়েই বরফে ঢেকে থাকে। এতো চমৎকার এখানকার ল্যান্ডস্ক্যাপ, ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনা। ফুজির চারদিকে পাঁচটি লেক। প্রধান লেকটির নাম লেক কাওয়াগুচিকো। আকাশ পরিষ্কার থাকলে লেকের জলে ফুজির বরফাবৃত চূড়ার অংশটি দেখা যায়। আমাদের ভাগ্য খারাপ, দেখতে পারিনি। চারদিকে বেশ সবুজ। ওই ডিসেম্বর মাসেও প্রচুর মানুষ শীর্ষে উঠছে। এমনকি বয়ষ্ক মানুষদেরও দেখলাম লাঠি নিয়ে উঠছে। আমি তখনও সেভাবে জাপানিজ(নিহঙ্গ) ভাষা শিখিনি, অল্প-স্বল্প। তাই সেভাবে অনেক কিছুই জানা হয়নি। ইংরেজীতে কোন বর্ণনা লেখা ছিলোনা। আমরা হাল্কা খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম, ওই হেঁটে হেঁটেই খেলাম। আসলে সেদিন যতোটা আনন্দ পাবার কথা ছিলো, পাইনি। আকাশ ছিলো মেঘলা, আর চারদিকে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। যখন সূর্য জেগে উঠলো, তখনও ফুজি সানের তুষারের সাথে দেখা আর হয়নি। খুব বেশি পথ হাঁটা হয়নি, ওই পঞ্চম স্টেশন থেকে অল্প কিছু হেঁটে ষষ্ঠ/সপ্তম স্টেশন পর্যন্ত মনে হয় গিয়েছিলাম।
একটি কথা না বললেই নয়, এই ফুজি মাউন্টেন জাপানের সুপরিচিত প্রতীক। প্রায় প্রতিটি শিল্পকলা ও স্থিরচিত্রে একে দেখা যায়। জাপানীদের গৌরব এই ফুজি সান। যদিও সেভাবে মন ভরেনি, কিন্তু বিকেল হয়ে এলো, বাসায় ফিরতে হবে। রওয়ানা দিলাম, ট্রেন ছেড়ে দিলো, আর আমরাও আবার ফিরে এলাম শান্তির নীড়ে। তবে আকাশ পরিষ্কার থাকলে টোকিও থেকেই ফুজি মাউন্টেন দেখা যায়। আর আমি বহুবার ট্রেনে বসে দূর থেকে মাউন্টেনের সাদা চূড়াকে দেখেছি। একবার ভেবেছিলাম ফুজি শিবাজাকুরা ফেস্টিভ্যালে যাবার, ওই সময় ফুজির আরেক রূপ। চারিদিকে সাদা, লাল, গোলাপী, হাল্কা বেগুনী শিবাজাকুরা(মস ফ্লক্স) ফুল ফুটে থাকে। কিন্তু আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে কখনো যদি মাউন্ট ফুজির ঘুম ভেঙ্গে যায়, টোকিও শহরের অস্তিত্ব আর থাকবেনা। সৌন্দর্যের নীচে যে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য চাপা পড়ে আছে, ফুজি সানের কাছে গিয়ে জানা হয়েছিলো। সবশেষে না বললেই নয়, এই ফুজি সানের পশ্চিম-উত্তর ভাগে আওকিগাহারা বনের অবস্থান। এটি হলো জাপানীদের আত্মহত্যা করার সেই বিখ্যাত জঙ্গল। যাকে আত্মহত্যার স্বর্গরাজ্য বলা হয়। এই গহীন বনে যে-ই যায়, সে আর ফিরে আসেনা। শুনেছি বহু লাশ ঝুলে থাকে বিভিন্ন গাছে। শুধু লাশ নয়, কঙ্কালও।
হ্যামিল্টন, কানাডা
২৭ এপ্রিল, ২০১৭ ইং।
২০টি মন্তব্য
নীহারিকা
ছবি আর চমৎকার উপস্থাপনার আমিও যেন ঘুরে এলাম মাউন্ট ফুজি। কি ভালো বর্ণনা করেন আপনি। স্পটে সশরীরে না গিয়েও সেখানকার ফিলিংস পেয়ে গেলাম।
নীলাঞ্জনা নীলা
নীহারিকা আপু তাও সেভাবে দেখা হয়নি আপু। এটাই আফসোস।
তাছাড়া অনেক কিছু ভুলেও গেছি। কম দিন তো হয়নি! পুরোনো ছবিগুলো পাবার পরে লিখতে পেরেছি।
ভালো থাকুন।
ইঞ্জা
একেই বলে ভয়ংকর সুন্দর, আমি নিজেও অনেক পড়েছি এই মাউন্ট ফুজি সম্পর্কে কিন্তু আপনার ভাষায় বর্ণনা মানেই আলাদা কিছু প্রিয় আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
হ্যান্ডপাম্প ভাইয়া আমায় পাহাড়-অরণ্য খুব টানে।
আর ফুজি সান যেদিন যাই, সেদিনকার নাচ আমার দেখে কে! 🙂
ভালো থাকুন ভাইয়া।
ইঞ্জা
আপু, আমি দেখেছিলাম নিউজিল্যান্ড এর সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, যেদিন আবার এই আগ্নেয়গিরি জাগবে, সেদিন নিউজিল্যান্ড খুব বিপদে পড়বে।
নীলাঞ্জনা নীলা
তাই নাকি? নিউজিল্যান্ড দেশটা খুব সুন্দর। গুগলে ছবি দেখেছি।
কি জানি কখনো যাওয়া হবে কিনা! 🙁
আমরা জাপানে থাকতেই একবার ফুজি সান নড়ে উঠলো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো ধোঁয়া উঠছে আর শব্দও। কিন্তু আবার থেমে গিয়েছিলো। আমরা সবাই প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিয়েছিলাম।
অরুণিমা
এটা ভালো লাগল
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ অরুণিমাদি।
ছাইরাছ হেলাল
আওকিগাহারা বনের কথা শোনার অপেক্ষা করছি।
লেখায় বলছেন, পুরো মজা নিতে পারেন-নি, আমাদের-ও তাই অপূর্ণ থেকে গেল কোথায় যেন,
এই মাুউন্ট ফুজির কথা শুনেছি, এবার পড়লাম, ভালই।
আমরা চাই আপনার দেখা জায়গাগুলো নিয়ে আরও কিছু লিখুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
বনটার ভেতর তো যাওয়া হয়নি। তবে দূর থেকে দেখেছি। শুনেছি যেটুকু, সেটা নিয়ে লিখবো একদিন তবে। ঠিক আছে?
আসলে হয়েছে কি কোথাও বেড়াতে যেতাম, তখন তো ফেসবুক-ব্লগ ছিলোনা। তাই বাসায় ফিরে ডায়েরীতে লিখতাম। সেই ডায়েরীটাও যে কোথায়! 🙁 এটা লিখতে পেরেছি পুরোনো ছবিগুলো পেয়েছিলাম বলে। তবে যা যখনই মনে আসবে লিখবো। পুরষ্কার লাগবে, কি দেবেন? এবং কবে দেবেন? দেশে গেলে পাবো, সেই অপেক্ষা করা সম্ভব না। 😀
ছাইরাছ হেলাল
সমুদ্র-মন নিয়ে যা-ই লিখুন- না কেন
মুক্তো হয়ে-ই ভাসবে,
হৃদ-পুরস্কার জমা আছে
অপেক্ষার শেষ প্রহরে!!
নীলাঞ্জনা নীলা
পুরষ্কার লাগবো না। লিখমু আবার অপেক্ষাও করমু।
এইটা একটা কথা হইলো? :@
মেহেরী তাজ
পড়লাম,জানলাম,দেখলাম ও।
ধন্যবাদ আপু। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
পিচ্চি আপু লেখাটির পাশে থাকার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন। 🙂
বাবু
অসাধারণ ভ্রমণকাহিনী আর ফুজি মাউন্টেনের অসাধারণ মনোমুগ্ধকর বর্ণনায় পাঠকও মুগ্ধ হবে দিদি আপনার লেখা পড়ে । সত্যি ভ্রমণ নিয়ে এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন আপনি। ভালো লেগেছে আপনার লেখনী পড়ে, ভালো থাকবেন দিদি।
নীলাঞ্জনা নীলা
দাদা যতোটুকু মনে এসেছে, সেসবই লিখেছি। আর আপনার ভালো লেগেছে আমি কৃতজ্ঞ।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
ভালো থাকুন।
মৌনতা রিতু
এতোকিছু তার কিছুই জানতাম না। শুধু ছোটবেলায় বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে জাপানের আগ্নেয়গীরি পড়েছিলাম তাও খুবই সামান্য।
আমার কিন্তু একটুও মন ভরোনি পড়ে।
‘সান’ এর অর্থ সম্পর্কে জানলাম।
এই আপু, ঐ বন সম্পর্কে আরো লিখ প্লিজ।
রহস্যপত্রিকা পড়তাম একসময়। প্রতিমাসে না কিনলে হতোই না।
এটা মনে হয় কোনো বিশেষধরনের গাছের কারণে হয়। তাই না!
আমাদের হ্যান্ডস্যাম হিরো তীর্থ কেমন আছে?
অনেক আদর দিও।
জান, মেমন এবার এসে বলছে,”মা জান, বড় ভাইয়ারা বলেছে এই তোমরা এবারের ছুটিতে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে রেখে আসবে এবং গল্প শোনাবে, বলছে কয়েকজনের আছেও জান মা।” হেসে আমি শেষ। আমি বললাম,”তোমার কি এমন কেউ আছে পছন্দের!” শুনে ক্ষেপেছে খুব। আমাকে নাকি আর কিছুই বলবে না।
বাচ্চাগুলো কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু গো এটা ভ্রমণ কাহিনী, যা দেখেছি সেটাই লিখেছি। আর আওকিগাহারা বন নিয়ে লিখেছি। পছন্দ হয়েছে?
মেমনের কথা শুনে হাসতে হাসতে আমি শেষ। এভাবেই স্বাধীনতা দিও। যাতে সব কথা বলতে পারে।
আমি তো কিচ্ছু বাদ রাখিনা তীর্থর সাথে শেয়ার করতে।
আর হ্যান্ডসাম তীর্থ, এমনিতে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেনা। আর যতো ক্ষ্যাপানো শুধু আমাকে। এই তো একটু আগে বললাম চল খাবো। আমায় বললো ও নাকি প্রোটিন শেক খেয়েছে। আমি তো খেয়ে নিলাম। এসে বলে “তুমি আমাকে ফেলে খেয়ে ফেললে?” চিন্তা করো কি শয়তান হয়েছে! 😀
অনেক ভালো থেকো আপু।
ইকরাম মাহমুদ
আমার এক পরিচিতের কাছে ফুজি সান এর কথা শুনেছিলাম তবে এবার ছবিসহ বর্ণনা।
কানাডার বিখ্যাত ও দর্শনীয় জায়গা নিয়েও লিখুন। আপনার লেখায় ভর করে সেখানটাতেও ঘুরে আসার সুযোগ হবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
এই হ্যামিল্টন আসার পর থেকে জীবনটা বৃত্তবন্দী হয়ে গেলো। এর আগেও বেড়িয়েছি।
কয়েকটা জায়গায় ঘুরেছি, ঠিক আছে লিখবো। আগে জাপান শেষ করি। কেমন?