কত যে সন্ধ্যা ওই হিজল গাছটার নিচে আড্ডা মেরে কাটিয়েছিলাম তার কোন হিসেব নেই। তখন বয়স খুব একটা ছিল না। কৈশোরের অলস সময়গুলো বর্ণিল হয়ে যেত সন্ধ্যা বেলার আড্ডায়। সময় পাল্টেছে, এখন আর সন্ধ্যা বেলায় আড্ডা দেয়া হয় না। সেই গাছ ঠিকই আছে, শুধু মানুষগুলো এদিক সেদিকে আরকি। সময়ের স্রোতে আমাকে ঢাকায় আসতে হল। গুলশানে অফিস। সারাদিন অফিস শেষে বাসস্ট্যান্ডে ছাউনির নিচে বাসের অপেক্ষায় কাটে আমার সন্ধ্যা বেলা। কিছুক্ষণের বৃষ্টি তে ফুটপাত গুলো দ্বীপের মতো লাগছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির দিনে মেঘের ভীড় কাটিয়ে সূর্যের দেখা পাওয়া ভাড়। সন্ধ্যা বেলার শূণ্যতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। মানুষ বোঝাই বাহন গুলো কাছে আসে, উঠি না, একরকম বিরক্ত কাজ করে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে একটা হাত নেমেছে, শুধু মাত্র একটা হাত। কোন মাথা নেই, শরীর নেই, বিষণ্ণতার হাত। যাকে ছুঁয়েছে সেই বিষণ্ণতায় ভারী হয়ে যাচ্ছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শহরের ক্লান্ত কে আরও বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎই আমি আমার দ্বীপে আবিষ্কার করি তাকে। বয়স চেহারা কে খানিকটা পাল্টে দিয়েছে। সে আমার দিকে তাকায়, অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে। বাঁ চোখের উপরে দাগটা অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে।
– আপনি???
আমি বলি, আপনি??
তারপর কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলাম আমরা। পৃথিবীর সকল ভাষা বর্ণ বুঝি হারিয়ে গিয়েছে। তারপর সেকেন্ড, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ যেতে লাগলো। আমাদের মুখে কোন কথা ছিল না। অতঃপর কয়েক আলোকবর্ষ পরে সে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনি এখানে?
– আমি এখানেই ব্যাংকে চাকরি করি। আপনি এখানে কিভাবে?
– আমি স্কুল টিচার।
আমি বা আমরা তখন জমিদার ছিলাম। পুবে হাসুদের বাড়ি থেকে পশ্চিমে সঞ্জিব দাদার বাড়ি পর্যন্ত বিশাল এলাকা আমরা চষে বেরাতাম। জমির ফসলের উপর আমরা কোন জমিদারি করতাম না, করতাম শুধু ফল গাছগুলো তে। কার উঠোনে কোন গাছ আছে আর কার গাছে কয়টা আম কাঠাল আছে তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতাম। মালিক বেচারা ফল লুকিয়ে রাখতে পারতো না। শত বাধাঁ পেরিয়ে ফলগুলো আমাদের চোখে জ্বলজ্বল করতো। তবে এ নিয়ে ঝামেলাও কম হতো না। তবে কারও কিছু বলার ছিল না। এটাই নিয়ম। যেই মালিকের গাছের আম খাচ্ছি ছেলেবেলায় সেও অন্যের বাড়ির আম খেয়েছে।
ঐশীর দোতলা বাড়ি। পাশেই আমের গাছ। অমন আমগাছ গোটাখানেক পাওয়া মানে বিশাল কিছু। কালো কেশের দুধ বরণী মেয়েটাকে অনেক আগে থেকেই চিনি। কতবার যে ওকে স্বপ্নে দেখেছি তার হিসাব নেই। কখনোবা ওর স্বপ্ন দেখতে দেখতেই রাত ভোর হয়েছে।
– তুই কি আসলেই ঐশী কে পছন্দ করিস? মারুফ ভ্রু কুচলে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
– না এমনটা ঠিক না।
– তাহলে স্বপ্নে দেখিস কিভাবে?
– আরে সাদিকও তো নূরজাহান কে স্বপ্নে দেখে তাতে হয়েছেটা কি?
– আরে নূরজাহান তো নাইকা, তাকে তো হাজার মানুষ স্বপ্নে দেখে। আর আমাদের তানু তো স্বপ্নে দেখে ঐশী কে!
– শেষ পর্যন্ত ঐশীর প্রেমে পড়লি!! সাদিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
ব্যাকবেঞ্চারদের হাসি সারা ক্লাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো।
– কে রে হাসে?
– তানু , স্যার!! মারুফ ধরিয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
– ওও, আবারও তানু? তা বাবা হাতটা দাও দেখি?
প্রেমিক প্রেমিকার হাত চায় একটু ছুঁয়ে দেখার আশায়, আর এই আবুল স্যার হাত চায় বেত মারার আশায়!!! এমন সুন্দর ভাবে বাবা বলে হাত টা চাওয়ার কি দরকার ছিল, মারবেনই যদি? স্যার আমার ঐশী সম্বন্ধীয় কল্পনা থেকে সোজা মাটিতে আছাড় মারলেন! সারাটি ক্লাস কাকতারুয়ার মতো হাত দুটো পুবে আর পশ্চিমে বাড়িয়ে রাখলাম!!
প্রতীক ভাই ছিলেন আমাদের থেকে প্রায় চার বছরের বড়। এলাকার বড় ভাই আর আমাদের কাছে বিশ্ব প্রেমিক হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রেম সম্পর্কে তাকে আমরা গুরু মানতাম। তিনি ছিলেন আমাদের মতো নতুন গোঁফ ওঠা কিশোরদের আদর্শ, আমাদের অনুপ্রেরনা। শুধুমাত্র প্রেম পিরিতি বিষয়ে। পাঞ্জাবি পায়জামা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা, সুঠামদেহী প্রতীক ভাই ছিলেন এলাকার প্রায় সব মেয়েদেরই স্বপ্নের পুরুষ। তিনি যখন রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যেতেন অনেক মেয়েরাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো! তবে তার একজন সাবিহা ছিল। ক্লাস টেন পড়ুয়া ভীরু মেয়েটা এলাকার সব মেয়েদের ঈর্ষা! মারুফ বলতো টিউশনি তে যাচ্ছেন, আমি বলতাম সাবিহার কাছে।
– নাহ, আসলেই ঐশীর প্রেমে পড়েছি আমি!!
– সেটা তো জানিই, সাদিক অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বললো।
– কিন্তু ওই রাজকন্যে তো আমাকে দামই দিবে না!
– ওরে বাবা আবার নামও দেখি দিয়েছে, রাজকন্যা!! আহা!!
সাদিক মারুফ হাসাহাসি তে ব্যাস্ত। আমার মুখ দিয়ে কি আর হাসি আসে??
– তুই এক কাজ কর, আয়নায় একবার মুখটা দেখে আয়!
আবারও অট্টহাসিতে মেতে উঠলো ওরা।
– কোন চিন্তা করিস না, আমরা আছি তো।
মারুফের কথাটাতে খানিকটা চিন্তামুক্ত হওয়া গেলেও হত। ভেবেছিলাম ওটা অবজ্ঞার। শেষমেষ প্রতীক ভাইয়ের উদাহরণ এলো। কি আর করার? ওদের কথা মতো কাসেম ভাইয়ের সেলুন থেকে ঘাড়টা গোল করে ছেঁটে এলাম। সামনের চুলগুলো তে একটু স্টাইল! আলমারি থেকে শার্ট বের করে করা ভাবে মাড় দিয়ে ধুলাম। তারপর ইস্ত্রি। চোখে একটা সানগ্লাস?? নাহ ওটা কেমন জানি খারাপ দেখাচ্ছে, ওটা বাদ। চশমার জায়গায় চশমাই থাক। আর কালো রঙ্গের জিন্স, সাথে একটা স্নিকার। নিজেকে আয়নায় দেখে চিনতেই পারছিলাম না। হাবাগোবা আমার কি অবস্থা। ঠিক সাড়ে বারোটার দিকে উর্দু গলিতে রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম।
ওই সময়টাতে ডালিয়া বাসটা এসে থামে আর নিয়ে আসে শহরের অর্ধেক সুন্দরীদের। সব শেষে নামে নীল রং এর ড্রেস আর সাদারঙ্গের ওড়না পরা আমার ঐশী। আমারই বললাম, কিশোর মনের কল্পনার রাজ্য বলে কথা। শুরু হয় এক কিশোরীর পথ চলা।
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে স্থবির হয়ে যাই। তারপর ভয়ংকর বয়সের অস্থির যন্ত্রণায় আমার মন ছটফট করতে থাকে। সে যন্ত্রণা পোষাকের বাধা মানে না। সভ্যতা, ভদ্রতা, আইনকানুন, রীতিনীতি ইত্যাদি শব্দগুলোকে কামান দাগতে থাকে। মনে হয় চিৎকার করে বলি, ঐশী আমি তোমায় ভালোবাসি।
ঐশী চুপচাপ হেটে যায়, আমার দিকে তাকায় না। কোথায় কি হল সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সোজা বাসায় চলে যায়। আর আমি চেয়ে থাকি তার দিকে, তার পথের দিকে। সৈনিক যুদ্ধ শুরু করার পূর্বেই তা শেষ হয়ে যায়।
রাত কেটে ভোর হল, আমার ঘুম ভাঙ্গলো আশেপাশের চেঁচামেচিতে। কে বা কারা যেন মহল্লার অলিগলির দেয়ালে বড় বড় করে লিখে রেখেছে “তানু+ ঐশী”। কোত্থাও বাদ রাখে নি। এমনকি ঐশীর বাড়ির সামনের দেয়ালেও। এবার আর বাঁচার আশা করা যায় না। পিতা নামক ভয়ংকর মানুষটা আমার সামনে দৈত্যের মতো দাঁড়ালো। আবার সেই কাসেম ভাইয়ের দোকান, পচাঁ নাপিত রীতিমত রোলার চালালো আমার মাথায়। ক্রন্দনরত মা প্যান্ট আর শার্টটা আলমারী বন্দি করলেন। সানগ্লাসটা হাওয়া হয়ে গেল। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। গৃহবন্দী।
– তোরা আমার সাথে এমন করলি কেন? কি দোষ করেছিলাম আমি??
আমি হাউমাউ করে কাদতেঁ লাগালাম।
– ও মা, কি বলে? খারাপের কি করলাম? তোর বলতে সমস্যা আমরা সাহায্য করলাম। এখন কাক পক্ষী সবাই জানে তুই ঐশী কে ভালোবাসিস।
– তো এভাবে বলার কি দরকার ছিল?
– আর কিভাবে বলবো? মাইক নিয়া আসবো? প্রেম করবি আর মানুষ জানবে না!? আমরা আমাদের কাজ করেছি, বাকিটা তোমার পালা। নৌকা বানিয়ে দিয়েছি, সাগরেও ভাসিয়েছি, এবার পাড় খুজেঁ নাও।
– তোদের জন্যই আমার বদনাম হল!
– প্রেম করবে বদনাম হবে না? ক্ষীর খাবে আর গোঁফে লাগবে না? তবে শাড়ি পরে ঘরের কোণে বসে থাকো। আর কক্ষণো আমাদের ডাকবে না এসব ব্যাপারে।
স্বাভাবিকভাবেই ঝড়ের তীব্রতা কমে এল। এখন আমি মোটামুটি স্বাধীন। তবে মনে হত বাবার নির্দেশে কেও কেও আমাকে পাহাড়া দেয়। কিশোর মন বড়ই অবাধ্য। সন্ধ্যা হলেই উর্দু গলির চা দোকানের কথা মনে পড়ে যায়। একদিন ছুটে যাই আমি গুপ্তচরের হিসাব অংক ফাকি দিয়ে। উর্দু গলির চায়ের দোকানে। নিয়ম করেই ডালিয়া বাস এসে থামে। রূপরাজ্যের রূপবতী রাজকন্যা ঐশী নামে বাস থেকে। নেমেই আমার চোখে তার চোখ পরে। আমি অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছু দূর আসতেই দেখলাম ঐশীর মা পিছনে পিছনে আসছে। আমাকে আর থামায় কে? দিলাম ভো দৌড়। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম বা পায়ের জুতোটা হাওয়া হয়ে গেছে, পরে যদিও ওটাকে পাশের এক নর্দমায় আবিষ্কার করেছিলাম।
ল্যাম্পপোষ্টের বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। রাতের শহরকে আলোকিত করতে সারা রাত এরা কাজ করে যায়।
– তা কেমন যাচ্ছে আপনার দিনকাল?
আমি বোকার মতো প্রশ্নটা করি।
– জ্বী ভালোই যাচ্ছে। দিন দিনের মতো আর আমি আমার মতো।
– আপনার সাথে দেখা হবে কখনো ভাবি নি। কি আশ্চর্যের বিষয় তাই না?
– পৃথিবী তে কতো আশ্চর্যই না থাকে, তার কটার খবরই বা আমরা জানি?
– তা ঠিক বলেছেন।
আমি আকাশের দিকে তাকাই। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এল, বৃষ্টিও কমে এসেছে।
– বাসের যেই অবস্থা মনে হচ্ছে আজ আর বাসায় যাওয়া লাগবে না।
– চলুন রাস্তা ধরে হেটে যাই।
ওর প্রস্তাবে আমার সায় দিতে মোটেও দেরী হল না। দুজন হেঁটে চললাম, নিয়ন বাতির তলে।
একদিন মহল্লায় প্রতীক ভাইয়ের সাথে দেখা।
– তোমার নাম তানু না?
– জ্বী।
– তুমি ঐশী কে ভালোবাসো?
ঠোঁট দিয়ে কোন কথা বের হল না। মুখটা শুকিয়ে গেল। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল ফাসিঁর রায় পড়া হল নাকি!
– ঐশী কে বলে দিলেই তো পার।
– ভয় করে।
– আরে পাগলা এতো ভয় পেলে কি হয়? সাহস রাখো বুকে বুঝলা। দেখি আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারি কিনা।
মোটামুটি চিন্তামুক্ত হয়েছিলাম বটে কিন্তু কে জানতো আমার চিন্তার গ্রাফ যে প্রতিক দা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন?
– যাক প্রতিক ভাই যখন সাহায্য করবে বলেছেন, তা হলে তো একটা কিছু হয়েই যাবে।
মারুফকে বেশ খুশিই দেখাচ্ছে এ ব্যাপারে। কিন্তু আমি তবুও ছটফট করতে লাগালাম। কিছুদিন গড়াতেই দেখলাম প্রতিক দা নিয়মিত ঐশীদের বাড়ি যাতায়াত করছে। সাদিকের কাছ থেকে জানতে পারলাম ঐশীর নতুন টিচার নাকি প্রতিক দা। যাক বাসায় তো ঢুকেছে এখন আমার জন্য কি কিছু করতে পারবেন কিনা? সাদিক মারুফের কাছ থেকে নিয়মিত খোঁজ খবর নিতে লাগালাম।
– আজকে দেখলাম প্রতিক দা আর ঐশী বেশ হাসাহাসি করছে, কাছে গিয়ে কান মেলাতেই কিছুক্ষণ পর বুঝলাম ঐশী অংক করছে। তা অংকের বইতে কি গোপাল ভাঁড়ের কটা পাতা জুড়ে দিয়েছে নাকি প্রকাশনী?
সাদিক কটকটিয়ে কথা গুলো বলছিল, বুঝাই যাচ্ছিল ও কিছুটা বিরক্ত। আমি শান্ত হতে বললাম।
– আরে ও কিছু না, আগে তো ভাব জমাতে হবে তারপরই না আমার ব্যাপারে বলবে।
-যা খুশি কর।
অনেকদিন পর বাজারে প্রতিক দা কে পাকড়াও করলাম।
– প্রতিকদা আমার কি হল?
– আরে তানু না? কেমন আছ?
– ভাল। আমার ঐ ব্যাপারটা কি হল?
– কোনটা? ঐশীর কথা বলছ? আরে এসব কি এতো তারাতারি হয়?
– আর কতদিন? করুন আর্তনাদ আমার।
-এসবে সময় লাগে। সবুর কর। সবুরের ফল মিষ্টি হয়।
এই বলে প্রতিকদা হাসতে লাগলো। আমি উনার মতিগতি কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। ক্রমেই তার উপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল।
-আজকে যাচ্ছিলাম ফুপির বাড়িতে। যেতে সময় দেখলাম ঐশীকে।
– তারপর?
– দেখলাম ঐশী প্রতিক দার সামনে “বনলতা সেন ” আবৃত্তি করছে। সারা ঘর মোঁ মোঁ করছে। তা মেট্রিকুলেশন তো আমরাও দিয়েছি, এই কবিতা তো পড়িনি!
মারুফের কথায় আমার হাহাকার আরোও বেড়ে গেল। নিজের ভুল কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছি।
– এখন আমি কি করবো? অসহায়ের মত জিজ্ঞেস করলাম।
– তুই লোভে পড়েছিলি। সাদিক রাগে ফুসতে থাকে।
– তখন এতো কিছু বুঝিনি। আমি তো নিজে থেকে কিছু বলিনি।
– এখন আমরা কি জানি? নিজের কাজ নিজে করতে পার না? প্রতিকের ঘাড়ে মই দিতে কেন গিয়েছিলি? এবার বুঝো ঠেলা।
– যা হবার হয়েছে, এবার তো বল কিছু।
– নিজে গিয়ে বলে দে ভালোবাসি। পুরুষ মানুষ হয়েছিস এতটুকু করতে পারিস না?
– আরে বলব কিভাবে? দিনে দেখিই দুইবার, একবার স্কুলে যাওয়ার সময় আরেকবার আসার সময়। তখন তো ওর চারিদিকে মেয়েরা ঘিরে থাকে। বাসার সামনেও তো যেতে পারি না।
আমরা সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রতিকদা কে কিভাবে হটানো যায় কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। পরক্ষনে বুঝলাম একে সরানো সম্ভব নয়, অন্যপথ দেখতে হবে। মারুফ বললো
– ঐশী রোজ রাত সাড়ে নয়টার দিকে বারান্দায় আসে। আমি ফুপির বাসায় যেতে দেখেছি।
– তাতে কি হবে?
-আরে এই তো সুযোগ, কোনভাবে ঐশী কে জানাতে পারলে……
– কেল্লাফতে। শোন, তুই একটা চিরকুট লিখবি তারপর ওটা গুলতি দিয়ে ঐশীর কাছে পাঠিয়ে দিলেই কেল্লাফতে! রাতেই সবকিছু করতে হবে। সাদিক উঠে দাঁড়ালো।
সবাই মিলে তাই ঠিক করলাম। যেভাবেই হোক এটা করতে হবে। যথারীতি কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম। কি লিখবো বুঝতে পারছিলাম না। “প্রিয় ঐশী” এতোটুকু লিখতেই দুবার কাটাছেঁড়া করলাম। একবার বানান ভুল আরেকবার লেখা সুন্দর হয়নি, আরোও কত কি! নাকি এতটুকুই থাক, তাহলে ত কিছুই হয় না। সব মিলিয়ে লিখলাম কিছু,
প্রিয় ঐশী,
বিশ্বাস কর আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই নি। যা চেয়েছিলাম তার হিতে বিপরীত হয়েছে। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, সেটা আমার কালো চুল সাদা হয়ে গেলেও থাকবে। অনেক কথা বলার আছে, সেটা না হয় সামনাসামনি বলবো।
তোমার তানু
রাতের বেলা আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মারুফ আর সাদিক সাইকেল নিয়ে এল। বাড়ির কিছু দূরে একটা ঝোপে আমি লুকিয়ে রইলাম। মহল্লার এক প্রান্তে ওদের বাড়ি, লোক যাতায়াত কম। মারুফ আর সাদিক সার্বিক পরিস্থিতি জানতে সামনে গিয়েছে। ওদের ইশারা পেলেই আমি আমার কাজে নামবো। এদিকে মশা আমাকে কামড়িয়ে যাচ্ছে। মারতেও পারছি না, পাছে যদি শব্দ হয়? মশারা কামড়িয়ে যাও, আমারও একদিন সময় আসবে। যথারীতি মারুফ আর সাদিক চলে এল।
– ঐশী বারান্দায় এসে পড়েছে। তারাতারি যা।
আমি অস্ত্রে শাণ দিলাম। চিঠিটা যত্ন করে ইটের টুকরোয় মুড়িয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই পুবের বারান্দায় ঐশী কে দেখলাম। চুল গুলো মেলে দিয়ে বারান্দায় হাঁটাচলা করছে আর চারিদিকে মিটমিট করে জ্বলে ওঠা জোনাকীরা তাদের রাণীকে পূজো করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার রূপসুধা পানে আমি ব্যাস্ত। মনের অজান্তেই আমি বাড়ির আরও সামনে চলে যাই।
– কে? কে ওখানে?
আতংকিত হয়ে উঠলো ঐশী। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তারাতারি গুলতি টেনে দিয়ে চিঠি সহ ইটের টুকরোটা মারলাম। একটা আর্তনাদ ভেসে এল। দেখলাম ঐশী বা পাশের চোখে হাত দিয়ে বসে পড়েছে। বাড়ির ভিতর হৈচৈ পড়ে গেল। আমিও কিছু না ভেবে দৌঁড় দিলাম। জীবনের সেরা দৌঁড়। ঝোপের কাছে সাদিক মারুফ দাড়িয়ে।
– ঐশী কে মেরে দিয়েছি। প্রচণ্ড ভয় আর হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম।
– ঐশী কে মেরে দিয়েছি মানে? মারুফ জিজ্ঞেস করলো!
– জানি না। ঐশী কে মেরে দিয়েছি।
বলেই আমি দৌঁড়াতে লাগলাম। দিক বিদিক কিছু না ভেবেই। কিছু দূর পরে দেখলাম আমার দুপাশ দিয়ে মারুফ আর সাদিক সাইকেল নিয়ে শাঁ করে চলে গেল। বুঝতে পারলাম কাহিনী বাড়ি ছেড়ে বাইরে গড়িয়েছে। আমি শুধু দৌঁড়ালাম। এক সময় মনের অজান্তেই হাজির হলাম প্রতিকদার বাড়িতে।
– আরে তানু, তুমি এতো রাতে? এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?
– ঐশী কে মেরে ফেলেছি।
– মানে?
প্রতিকদাকে সব বলে দিলাম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব। প্রতিকদাকে সব কথা খুলে বলতেই বিশ্বের সব বিস্ময় তার মাঝে এসে জড়ো হল।
– তুমি করেছ কি? তুমি এখানে থাক, আমি খোঁজ নিয়ে আসছি। আমি আসার আগে বাইরে যাবে না।
প্রতিকদা শার্ট পড়ে দ্রুত চলে গেলেন। আমি দরজা লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মুহুর্তেই সব চিন্তাভাবনা দূর করে দিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুম জেঁকে বসলো। দরজার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো।
– কি হয়েছে প্রতিকদা?
– তুমি কি করেছ জানো? কপালে তিনটা শেলাই দিয়েছে। আরেকটু হলেই ঐশীর বা চোখটা যেত।
আমি গ্রিক ভাষা বুঝি না। প্রতিকদার দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।
– তোমার চিঠি ঐশীর মায়ের কাছে। কাল পুলিশের কাছে যাবে জিডি করতে। ইতোমধ্যে তোমার বাসায় খবর পৌঁছে গেছে।
আমি হিব্রু ভাষা বুঝি না।
– রাত অনেক হয়েছে, এখন আমার এখানেই থাক। কাল সকালে চলে যেও।
সারারাত জেগে ছিলাম, পরের দিন কি হতে চলেছে? প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন সকাল না আসে। কিন্তু সকাল তো আসবেই। পরেরদিন সকালে বাসায় গেলাম। থমথমে অবস্থা। তারপর যা হবার হয়েছে। বাবার রক্তচক্ষু আর মায়ের অশ্রুজল। আবারও আমি গৃহবন্দী। পিতামাতার ক্ষমা চাওয়া, বাবার ব্যাক্তিগত মুচলেকা এবং মায়ের ঘনঘন ঐশীর বাড়ি গমন আমাকে সে যাত্রায় কাঠগড়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বটে কিন্তু আমাকে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল। সেটা অবশ্য পিতার নির্দেশে। ঢাকায় আমি পড়ালেখা চালিয়ে গেলাম।
এর পরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেল। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে শুনলাম ঐশীর বিয়ে হয়ে গেছে প্রতিকদার সাথে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতিকদা কে ধরে রাখার কোন ক্ষমতাই ছিল না সাবিহা নামক ভীরু বালিকার।
মাঝে মাঝে পথেঘাটে ওদের দেখতাম। ঐশী কে দেখে মনে হত ও বোধহয় সুখে আছে। বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে রিক্সায় দুজনে হুস করে চলে যেত। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবতাম এ রকমই বুঝি সুখের চেহারা। আমার মনে কোন দুঃখ ছিল না। শুরুতে কষ্ট হলেও ভাগ্যকে আমি বরন করে নিয়েছিলাম।
গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়িতে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাদিক বললো,
– প্রতীকদা একটা ভন্ড। শয়তান।
আমি চমকে উঠি। প্রতিকদা আবারও সাবিহার বাসায় ঘনঘন যাতায়াত করা শুরু করেছে। এ নিয়ে সংসারে ঝামেলা বেধেঁ যেত। ঐশীর বাবা মা গত হয়েছেন। বড় ভাইদের আলাদা সংসার। তবুও নাকি ঐশী প্রায়ই ভাইদের কাছে চলে যেতেন।
আরও আনেকদিন গড়িয়ে গেল। একসময় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ঐশী আর এখানে থাকে না। ঢাকায় কোন এক লেডিস হোস্টেলে থাকে। তার ভাই এটার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। প্রতিকদা ফের সাবিহা কে বিয়ে করেছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। সব মেঘ বিসর্জন দিয়ে আকাশ এখন মেঘমুক্ত। রাস্তাটা কেমন জানি খালি হয়ে গেছে। মানুষ খুব একটা নেই, কয়েকটা রিক্সা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আকাশে বিশাল এক চাঁদ। পিচঢালা ভেজা পথটাতে মানুষ, রিক্সা সবকিছুর ছায়া পড়ছে। জোৎস্না দিয়ে আকাঁ একেকটা ছায়া। আমি আর ঐশী হেঁটে যাই অজানা গন্তব্যে। সেই জোৎস্না এঁকে দিল আমাদের হাত। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে।
৩২টি মন্তব্য
আর্বনীল
প্রেম…… ভালবাসা… শেষে বিরহ…
ভালো লিখেছেন…
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ 🙂
আদিব আদ্নান
ভালই লাগল,তবে বিরহের পরিমান বেশ বেশি।
হিলিয়াম এইচ ই
কেঁদে দিয়েন না!! 🙂
অনিকেত নন্দিনী
এই ছেলে! দিলে তো তো কাঁদিয়ে। 🙁
গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো ছেলেটা এমন চমৎকার গল্প লিখতে শিখে গেলো কবে কবে তা ভেবে পাচ্ছিনা। সত্যিই খুব ভালো লেগেছে তোমার গল্প। -{@
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ আপু 🙂 🙂 🙂
পারভীন সুলতানা
ভাল লাগলো
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ। 🙂
স্বপ্ন
এত বিরহ কেন? ++++
হিলিয়াম এইচ ই
এটা আমার উপরে ভর করেছে।
খেয়ালী মেয়ে
অনেক বড় গল্প–পর্ব করে লিখলে আরো ভালো হতো মনে হয়….যাই হোক গল্পটা পড়লাম ভালো লাগলো…উর্দ গলির চায়ের দোকান/তনু+ঐশী/চিঠি/ভো দৌড় কি নেই গল্পে?সব মিলিয়ে দারুন…………
প্রেমিক প্রেমিকার হাত চায় একটু ছুঁয়ে দেখার আশায়, আর এই আবুল স্যার হাত চায় বেত মারার আশায়!!!————–লাইনটা একটু বেশী ভালো লেগেছে (y)
হিলিয়াম এইচ ই
পর্ব করে লিখলে অনেকে হয়তো তাল মিলাতে পারতো না, তাই দেই নি।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
সিকদার
বলার কিছুই নেই । দারুন !!! আপনার লেখায় পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা আছে।
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
অনেক দিন পরে লিখলেন
এত বিলম্বে পোষ্ট দিলে তাল কেটে যায় 🙂
শুভ কামনা।
হিলিয়াম এইচ ই
কি করবো ভাই।
সময় যে নাই!!! 🙁
ধন্যবাদ।
সীমান্ত উন্মাদ
প্রেম বিরহী গল্পে ভালোলাগা। শুভকামনা জনিবেন নিরন্তর।
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ।। 🙂
মিথুন
প্রেমপত্র দিতে গিয়ে প্রেমিকার কপাল ফাটিয়ে দেয় কেউ এই প্রথম দেখলাম 😀
সব ভালো তার শেষ ভালো যার। কিশোর কিশোরীর মজার গল্প পড়তে গিয়ে এমন মন বিরহ দেয়া ঠিক না। তবু জ্যোৎস্না দুজনের হাত মিলেমিশে দিয়েছে, এটুকু প্রাপ্তি অনেক।
খুব ভালো গল্প।
হিলিয়াম এইচ ই
হাহাহাহাহা!!!
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
অতীত ফিরে দেখা।লেখাটা খন্ড করে প্রকাশ করলে পড়ে মজা পাওয়া যেত।তবু গুড জব।
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ। 🙂
পরেরবার খেয়াল করবো।
ব্লগার সজীব
খুব বড় লেখা,পড়লাম পুরোটাই।ভাল লেগেছে ভাই।
হিলিয়াম এইচ ই
ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
দারুন একটা গল্প। ডাক্তার রাও লিখতে পারে। তারা কপাল ফাঁটালে কি হবে সেলাই টাও তারাই করবে 🙂
হিলিয়াম এইচ ই
ডাক্তাররা তো আর সবকিছু বিসর্জন দেয় না!! 🙂
কপাল সেলাব কেন শুধু? হাত দুটোও সেলাই করে লাগিয়ে দিয়েছি!! 🙂
মেহেরী তাজ
আপনি এতো ভালো লেখেন আমার জানা ছিলো না। গোগ্রাসে গিলেছি আপনার লেখা। আমার খুব ভালো লেগেছে।
হিলিয়াম এইচ ই
thank you 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
কথা হলো এতো কান্নায় তো শুধু কান্না আসে। আর আমি যে কাঁদতে পারিনা। এখন কি করবো ডাক্তার বাবু? ;(
গল্প (y)
হিলিয়াম এইচ ই
Napa Extra..
ইমন
ভাল লাগলো 🙂
হিলিয়াম এইচ ই
🙂