মুরাদ সোবাহান সাহেবের গ্যারেজে কাজ করে। তিন হাজার টাকা বেতন, সকাল সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। মুরাদের বয়স ১৬, একটা ছোট বোন শিউলি আর মাকে নিয়ে ও জুরাইন বস্তিতে থাকে। মুরাদ হাজার কস্ট করে হলেও ওর বোনটাকে পড়ায়, শিউলি ক্লাস ফাইভে পড়ে। আর ওর মা মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেন। দুবেলা ভাত আর দুটো আপন মানুষকে নিয়ে দিন শেষে নিজেকে খুব তৃপ্ত মনে হয় মুরাদের।
গ্যারেজে মুরাদ লিটন মিস্ত্রির এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে। গাড়ির পার্টস পাত্তি পরিস্কার করে, টুলস এগিয়ে দেয়, বড় বড় রেঞ্জ দিয়ে গাড়ির চাকা পর্যন্ত খুলে ফেলে। আশেপাশের দুই-চার এলাকায় মুরাদের ওস্তাদ লিটন মিস্ত্রির নামে গমগম করে। ড্রাইভাররা গাড়ি নিয়ে এসে ওস্তাদের সাথে মিহি স্বরে মিস্টি মিস্টি কথা বলে, যাতে কাজটা ভালো হয়। কিন্তু মুরাদের সাথে খ্যাক খ্যাক করে। ওর মন খারাপ হয়।
মুরাদের স্বপ্ন এক সময় ও লিটন মিস্ত্রির মতো বড় মেকানিক হবে। সবাই এসে ওকে মুরাদ ভাই মুরাদ ভাই বলে ডাকবে।
ঈদের আর দুই দিন বাকি, মালিক সোবাহান সাহেব বলেছেন দুইদিন আগে বেতন দেবেন। মুরাদ সময় গোনে। শিউলি গরুর মাংস খায় না, গতবার ঈদের আগে মুরাদের মা রেহানা বলেছিলেন শিউলির জন্যে খাসীর মাংস নিয়ে আসবেন। কিন্তু যাদের বাড়িতে কাজ করেন তারা কেউ খাসী কুরবানি দেন নাই। রেহানা খাসীর মাংসের ব্যাবস্থা করতে পারেন নি। সেবার শিউলি দুইদিন বিছানায় পরে পরে কেঁদেছে। গরুর মাংস খায়নি। রেহানা শিউলিকে চড় থাপ্পড় মারলেন। কিন্তু গরুর মাংস খাওয়াতে পারলেন না।
সেদিন রাতে মায়ের কান্না শুনে মুরাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল, মুরাদ চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো মা শিউলিকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। কয়েক ফোঁটা গরম পানি মুরাদের চোখ ভিজিয়ে স্বপ্নের দেশে নিয়ে গেল।
– শিউলি দেখলি, কতো বড় ছাগল কিনছি!
– ভাইয়া এটা ছাগল না, বইয়ে লেখা আছে খাসী।
– আচ্ছা আচ্ছা এইটার নাম খাসি। খাসী দেইখা আমার বইনের মুখে ফুটছে হাসি। হা হা হা।
– ভাইয়া দেখো তোমার কথা শুইনা ছাগলটাও মনে হয় হাসে। হি হি হি।
শিউলির মশকরা আর এতো সুন্দর হাসি দেখবার পর মুরাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুরাদ ঘুম থেকে উঠে শপথ করলো আগামী ঈদেই খাসী কুরবানি দিবে।
সেই থেকে মুরাদ একটু একটু করে টাকা জমায়। ওর কাছে এখন প্রায় ৬ হাজার টাকা আছে। আজকে বেতন পাবার পর কিছু টাকা মিলিয়ে হাটে চলে যাবে, শিউলিকে বলে এসেছে। আর শিউলিও বলে দিয়েছে কালো রঙয়ের ছাগল কিনতে। গায়ে ইঞ্জিনের কালি নিয়েই টাকা পকেটে ভরে মুরাদ হাটের দিকে রওনা দিল, ভালো একটা ছাগল কিনে তবেই ঘরে ফিরতে হবে।
হাটে অনেক মানুষ, বড় বড় গরু। গরু দেখতে মুরাদের ভালো লাগে। ঐ পাশে হাতির সমান এক গরুকে ভিড় করে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। গরুটার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দম যায় যায়। সেটার চারপাশে বড় বড় ৪ টা ফ্যান লাগিয়ে বাতাস দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতো বড় স্বাস্থ্যের ধকল এতো ছোট প্রাণের গরুটা সামলাতে পারছে না। মুরাদের মন খারাপ হয়ে গেল। মুরাদ ছাগলের হাটের দিকে রওনা গেল।
চমৎকার একটা কালো ছাগল পছন্দ হয়েছে। দামাদামি করে সাড়ে সাত হাজার। ছাগলের দড়ি ধরে টাকা দিতে মুরাদ পকেটে হাত দিল। হাত দিয়েই ওর বুকটা ধ্বক করে উঠলো। টাকাগুলি নেই। এই পকেট সেই পকেটে খুজেও টাকাগুলি পাওয়া গেল না।
শত শত মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে, গায়ে কালি মাখা একটি ছেলে পাগলের মতো কাঁদছে আর কি যেন খুঁজছে। এই হাটেই নাকি তার স্বপ্ন খোয়া গেছে//
১৩/১০/১৩, গুলশান।।
১০টি মন্তব্য
লীলাবতী
পারলোনা মুরাদ এবারেও ছোট বোনের মুখে হাসি ফুটাতে । এদের হাসি কুরবানী হয়ে যায় ।
ভালো লিখেছেন ।
ব্লগার সজীব
মনটি খারাপ হয়ে গেলো ভাই। ভালো লিখেছেন ।
ফরহাদ ফিদা হুসেইন
ধন্যবাদ।দোয়া করবেন।
ছাইরাছ হেলাল
মুরাদদের লালিত স্বপ্ন এমন করেই ধুলোতে লুটায় ।
খসড়া
কোরবানি সবার জন্য নয় যাদের সামর্থ আছে তাদের জন্য। তাইতো তিন ভাগ করতে বলা হয়েছে।
জিসান শা ইকরাম
গরীবের স্বপ্ন এমনিই ধুলায় লুটায়–
ভালো লেখা ।
আদিব আদ্নান
এই শ্রেণির অপূর্ণতা থেকেই যায় কোন না কোন ভাবে ।
প্রিন্স মাহমুদ
দুর্দান্ত লেখা ।
নীলকন্ঠ জয়
গরীবের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায় আবার বুঝলাম। মনটা ভীষম খারাপ হয়ে গেলো।
লেখককে সাধুবাদ।
প্রজন্ম ৭১
গরীবের স্বপ্ন এভাবেই শেষ হয়ে যায় 🙁 ভালো লিখেছেন ।