মঙ্গোলিয়ান পরাশক্তির বিস্তৃতি ও ক্রীতদাস প্রথা।
১৩ শতকের দিকে বিভিন্ন রাষ্টে মঙ্গোলিয়ানদের অনুপ্রবেশ ও রাজ্য বিস্তৃতি ক্রীতদাস প্রথাকে আরো জটিল করে তোলে এবং ক্রীতদাস ব্যবসায় নতুন শক্তির উদ্ভব হয়। মঙ্গোলরা প্রশিক্ষিত ও সাধারণ নারী, পুরুষ এবং শিশুদেরকে জোরপূর্বক বন্দি করে মঙ্গলদের রাজধানী কারাকোরাম এর সারাই শহরে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তাদেরকে ইউরেশিয়াতে বিক্রয় করা হতো। অনেক ক্রীতদাসকে জাহাজে করে রাশিয়ার বান্টিক সমুদ্র হতে ওরাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত নভোগোরদ স্টেটসের ক্রীতদাস বাজারে বিক্রি করা হতো। ( রুশ চিত্র শিল্পী সার্গে ভেসিলিভিচ ইভানভের, Sergey Vasilievich Ivanovo’s চিত্রকর্ম। ১৯০৭ সালে আঁকা চিত্রকর্মটি আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংরক্ষিত আছে)।
মধ্যযুগের শেষের দিকে ক্রীতদাস ব্যবসা মূলত ভেনিস ও জেনোয়ার ক্রীতদাস ব্যবসায়ী ও তাদের অ্যালায়েন্সের নিয়ন্ত্রনে ছিল। ১৩৮২ সালে গোল্ডেন হর্দ খাননেত এর শাসক খান তখতামিশ মস্কো অবরোধ করেন এবং শহরে আগুন ধরিয়ে দিলে সেখানকার অধিবাসীরা দিকবেদিক ছুটতে থাকে। তখতামিশের সেনাবাহিনী এই পলায়নপর হাজার হাজর মানুষকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাস বানায়। ১৪১৪-১৪২৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব ইইরোপ হতে অন্তত ১০,০০০ জনকে ভেনিসে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করা হয়। রাশিয়ার ইতিহাসে নথিবদ্ধ আছে যে, ১৬ শতকের প্রথমভাগে কাজান দস্যুরা রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে অন্তত ৪০ বার আক্রমন করেছিল। ১৫২১ সালে ক্রিমিয়ার খান মেহমেদ জিয়ারি ও কাজান খানেত যৌথভাবে মস্কো আক্রমন করে লুটতরাজ শেষে হাজার হাজার মস্কোবাসীকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাস বানায়।
রাশিয়ার বিশাল তৃণভূমির অপর পার্শ্বে ছিল শক্তিশালী অটোমান সম্রাজ্য আর দক্ষিণাঞ্চলে ছিল আরো ভয়ঙ্কর মঙ্গল উত্তরসূরি ক্রিমিয়ান খানেত। ক্রিমিয়ার খানেতের অর্থনীতিই টিকে ছিল রাশিয়ান স্লাভদের অপহরন করে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে অটোমান সম্রাজ্যে বিক্রয় করার অর্থের উপর। অটোমান সম্রাজ্যের পাশাপাশি তারা ইরান ও অপরাপর আন্তর্জাতিক ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের নিকট। অটোমান সম্রাজ্যে হাজার হাজার ক্রীতদাস থাকার ফলেই ১৬ শতকে ইস্তাম্বুল ইউরোপের সবচেয়ে বড় শহরে পরিণত হয়েছিল।
কৃষকরা যখন তাদের মাঠে কাজ করত তখন ক্রিমিয়ান দস্যুরা আতর্কিত হামলা করে তাদের ধরে নিয়ে যেতো। রাশিয়াতে ক্রিমিয়ানদের এই আক্রমন প্রতিবছরই হতো। মাইকেল খোদারকোভোস্কি তার Russia’s Steppe Frontier গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ১৭ শতকের প্রথম দিকে রাশিয়ান সমাজের যে পরিমান লোক অপহারন করা হয়েছে এবং অনেককে মুক্তিপন দিয়ে ফিরিয়ে আনতে যে অর্থ ব্যায় হয়েছে তা দিয়ে প্রতি বছর অন্তত ৪টি শহর তৈরি করা যেতো। ১৭৮৩ সালে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলে এই ক্রিমিয়ান আক্রমন বন্ধ হয়।
বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে অনেকবারই বর্ণনা করেছেন যে, তাঁকে অনেকবারই ক্রীতদাস উপহার দেওয়া হয়েছে এবং তিনি নিজেও ক্রীতদাস ক্রয় করেছেন। ১৪ শতকে বিখ্যাত পন্ডিত ও ইতিহাসবিদ ইবনে খালুদুন বর্ণনা করেছেন, ‘ কালো চামড়ার মানুষরা অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই এই ক্রীতদাস হয়ে থাকতো। তাদের ছিল অসহ্য রকম সহ্য ক্ষমতা। কারণ মানুষ হিসেবে একজনের যতোটুকু বুদ্ধি থাকা দরকার তাদের তা ছিল না। তারা ছিল অনেকটা বুদ্ধিহীন জন্তুর মতো।’
যখন ক্রীতদাস হিসেবে তাদের বন্দী করা হতো সাথে সাথে তাদের হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হতো। খাবারও কম দেওয়া হতো যাতে করে তারা পালানোর শক্তি না পায়। এবং গলায় পরানো থাকতো কাঠের এক ধরনের বেড়ি। ক্রীতদাস আনা নেওয়ার একটা বড় মাধ্যমই ছিল সমুদ্রপথ। জাহাজের একেবারে নীচে ডেকে হাত পা বাধা অবস্থায় অন্ধকারে তাদের রাখা হতো। সমুদ্রপথে অনেক ক্রীতদাসই অসুস্থ হয়ে পড়তো তখন তাদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। সমুদ্রের লবন পানি, ঠান্ডা, হিংস্র প্রানীর আক্রমনে ধীরে ধীরেই তার মৃত্যু হতো। এরকম হাজার হাজার মানুষকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,
২০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
পশু শিকারের মত মানুষকে শিকার করা হতো অতর্কিত ভাবে,
শক্তিশালী মানুষেরা অসহায় আর দুর্বল মানুষকে ধরে নিয়ে যেত পশুর মতই,
এরপর পশুর মতই পরিশ্রম করাতো।
হায়রে সভ্যতা
ধন্যবাদ এমন পোষ্টের জন্য
শুভ কামনা -{@
মৌনতা রিতু
অসভ্য এক ইতিহাসের উপর আমাদের সভ্যতা দাঁড়ানো।
ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
নীহারিকা জান্নাত
কি ভয়ংকর সেই দিনগুলো।
আল্লাহর কাছে হাজার শুকুর যে সেই সময়ে আমি জন্মাইনি।
পোস্টগুলো পড়ে জানছি অনেক কিছু কিন্ত খুব ভয়ে ভয়ে পড়ি।
মৌনতা রিতু
এর পরের পর্বগুলো তো আরো ভয়ঙ্কর।
ঠিকই বলেছো, ভাগ্য ভাল তখন আমরা জন্মাইনি।
ইঞ্জা
বেশ ভয়ানক ছিলো সেইসব দিন, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বাকি সব মানুষকে মারছে, শিকার করছে, দাস বানাচ্ছে, উফফ গা শিউরে উঠছে।
মৌনতা রিতু
ঠিক ভাইজু। কি নির্মম সেই সব দিনগুলো ছিল! ভাবতেই ভয় লাগে।
ইঞ্জা
লিখে যান আপু, পাশে আছি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সীমাহীন বর্বরতার যুগ ছিল যা শুনলেই গায়ের পশম দাড়িয়ে যায়।লেখা চলুক ইতিহাস আপু আমরা পড়ছি আর অজানাকে জানছি। -{@
মৌনতা রিতু
আপনাদের উৎসাহেই লেখা। দোয়া করবেন ভাই। ভাল থাকবেন।
নিতাই বাবু
সেই সীমাহীন বর্বরতার যুগের ইতিহাস জেনে গা শিউরে ওঠার পালা । সেই দিনগুলি যেন আর ফিরে না আসে, সেই কামনাই করি ।আগেকার ইতিহাস জেনে ভালো লেগেছে দিদি, আরও লিখে জানান, আমরা জানি। ধন্যবাদ দিদি ভালো থাকবেন আশা করি
মৌনতা রিতু
চেষ্টা করব ভাই। পাশে থাকবেন। দোয়া করবেন ভাই।
নীলাঞ্জনা নীলা
কি ভয়ঙ্কর!
নাহ এই যুগে আমরা আসলেই ভালো আছি।
ভালো লিখছো আপু। দারুণ!
মৌনতা রিতু
ঠিকই বলেছো আপু। অন্তত নিরাপদ আছি।
ভাল থেকো আপু।
ছাইরাছ হেলাল
এ দেখছি ভয়ংকর অবস্থা,
লিখুন লিখুন।
মৌনতা রিতু
সত্যিই ভয়ঙ্কর। ইতিহাসের সব সম্রাটদের কথা পড়লে তো তাদের আর আমার মহান বলতেই ইচ্ছে করে না।
হালাকু খান, চেঙ্গিস খান। মুঘল সম্রাজ্যের পতন ও কালো অধ্যায় পড়েছিলাম।
অসহ্য এরা সব।
শিপু ভাই
শ্বেতাঙ্গরাও যে ক্রীতদাস ছিল এটা জানতাম না।
সিরিজটা চমৎকার হচ্ছে!
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাই। ভাল থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
এই কৃতদাস ব্যবসা বন্ধ করতে কতো মানুষকেই না কষ্ট করতে হয়েছে। ধন্যবাদ সেইসব মানুশগুলোকে, যারা অন্তত মানুষ ছিলেন।
কী নির্মমতা কে ফুঁটিয়ে তুলছো লেখায়! অনেক ভাল হচ্ছে সিরিজটা।
মৌনতা রিতু
হুম সোনা অনেক প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছে। যতদূর মনে পড়ে এরই ধারাবাহিকতায় আট ঘন্টা শ্রমের আন্দোলন হয়েছে।
দেখি কঢোটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারি। আদর নিও অনেক।
সঞ্জয় কুমার
কি নির্মম নিষ্ঠুর !!!