জানিস্! ভীষণ মনে পড়ছে তোকে। এই মাসটা এলেই আমি বিষণ্ণ হয়ে যাই।আমার বুকের ভেতরে চাপ চাপ কষ্টেরা কিলবিল করে।এ মাসটা এলেই তোর চাঁদের জোছনার মতো মুখটা চোখের তারায় জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে। তোর চোখ মুখ ললাট, কদম ছাঁটের মতো ঘন কালো চিকচিকে চুল গুলো। আমার চোখ পোড়ায়,আমার বুক ঠেলে কান্না পায়।আমি একা একা কাঁদি। এমন করে কেন চলে গেলি?
তোকে চিঠি লিখি কোন ঠিকানায়? তুই পারবি তো পড়তে আমার চিঠি। এখনো কি আমার ওপর অভিমান আছে তোর? পারবিনা আমায় মাফ করতে? তুই ভীষণ শান্ত ছিলি। একেবারে মাটির পুতুলের মতো। আমার যে অনেক রাগ ছিলো! একটু এদিক সেদিক হলেই তোকে চড় থাপ্পর মারতাম। খুব কি লাগতো তোর?
কেন বুঝিনি তোর মর্ম? তাই কি এত তারাতারি ছেড়ে চলে গেলি?
তোকে নিতে চাইনিতো, কেন জিদ ধরলি তুই? সেদিনটা আজো জ্বল জ্বল করছে স্মৃতীতে, নিপুর জন্ম হলো সকালে, কোরবানী ঈদের দ্বিতীয় দিন।ঈদের দিনের পোড়ানোর পরেও বাকি থাকা আতশ বোমা (বাঁশের কঞ্চির মাথায় রঙিন কাগজে মোড়া বারুদ)ফাটালাম আমরা সবাই মিলে।রঙ মাখলাম,বায়না ধরলাম পুকুরে গোসল করতে যাবো, জানতাম আম্মা আজ আর বেশি আপত্তি করবেন না। শুধু তোকে আর সাগর’কে নিতে চাইনি, তারপরও তুই বিপু সাগর সবাই বায়না ধরলি আমার বন্ধুদের সাথে তুইও যাবি।আম্মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তোদের জন্য আলাদা পানি তুলছিলেন, গোসল করিয়ে দেবেন বলে।
তুই আম্মার সামনে কেমন ভাবে অনুনয় করে করে রাজি করিয়ে নিলি। ১০/১২ জনের দলের সাথে তোরাও চলে এলি।
থানা’র পুকুরের ঘাটে বসিয়ে বিপু, সাগর আর তোকে আমি বলে দিয়েছিলাম, খবরদার,যেখানে বসিয়ে রেখেছি এখানেই থাকবি। আমি ছাড়া এক সিঁড়িতেও নামবিনা তোরা। সাগর,বিপু,তুই লক্ষী হয়ে বসে ছিলি। আমি তোদের মগে পানি তুলে তুলে গোসল করিয়ে দিয়ে বসিয়ে রাখলাম।
তাহলে কি হলো?
আমাকে ধাক্কা দিলো কে পেছন থেকে? হাবুডুবু খেতে লাগলাম সাঁতার না জেনে! ডাক্তার কাকার মেয়ে ঈরানী চুল ধরে টেনে না তুললো। তারপরই শুনলাম সুইট সুইট চিৎকার। তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। হাবুডুবু খেতে খেতে আমার শরীর বিবশ।
আমি জোড় গলায় চিৎকার করছি, সুইটি সুইটি সুইটি……..মুক্তি,বনানী, মনি,সেলিনা, শিউলি, পলি ফুপু,হ্যাপী ফুপু, ঈরানী, দুলালী সবাই তোকে ডাকছে। ছুটে যাচ্ছি বাসার দিকে, পা চলছেনা, রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মোফাজ্জেল কাকা জানতে চাইলেন এমন করে কাঁদছি কেন? রাস্তার মধ্যেই লুটিয়ে পড়লাম। কাকু সুইটি কে পাচ্ছিনা, কাকু হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললেন, তুই বাসায় যাইয়া জানা, আমি যাচ্ছি,বলেই দৌড়ে ছুটে চলে গেলেন পুকুর পাড়ে।
বাসায় এসে লুটিয়ে পড়লাম আম্মার পায়ের কাছে, কেবল গোসল করে বের হয়ে শাড়ি পড়ছিলেন আম্মা।
আম্মা কি ভেছিলো জানিস! আবার বুঝি তোর সাথে আমার মারামারি লেগেছে। যখন বললাম তোকে খুঁজে পাচ্ছিনা,দিগ্বিদিক হয়ে ছুটে বেড়োতে গিয়ে সদর গেটের সাথে শাড়ির আঁচলে ছিঁড়ে আটকে রইলো। চৌমাথা থেকে সোজা থানার পুকুর পর্যন্ত এক দৌঁড়ে রাস্তা পেড়োলেন, সাথে সাথে ছুটলো শত শত মানুষ। পুলিশ সদস্য,সাধারন মানুষ পুকুরে নেমে গেলো তোকে খুঁজতে। ২০/২৫ হাত গভির পুকুরে তোকে কেউ খুঁজে পেলোনা।
পুকুরের ডান দিকে ওই দুরের কোনা ধরে লাবলু কাকাদের বাসা। তাঁদের বাসার পেছন দিকটাতে এই পুকুর। ওখানে ভিড় জমেছিলো দেখার জন্য এ পুকুরে কেউ হাড়িয়ে গেছে বলে। লাবলু কাকা ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন, লাবলু কাকার মা তাকে ঠেলে জাগিয় দিয়ে বলেছিলেন… “লাবলু তুই এহনো ঘুমাও ওঠ শিগগীর, দেখ গিয়া চাঁনের ( চাঁদ,আমার আব্বার নাম) মাইয়া পুকুরে পড়ছে মনে হয়।” কাকু সোজা দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুকুরে। এক ডাইভে চলে গেলেন পুকুরের গভির অতলে, তোর পিঠেই হাত পড়লো সোজা। দৌড়ে আসার ফলে তাঁর নিঃস্বাশের কষ্ট হচ্ছিলো।ভেসে উঠলেন। জানালেন সবাইকে, তোকে পেয়েছেন খুঁজে। দ্বিতীয় ডাইভে তোকে তুলে আনলেন। সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা চললো। তোর অমন সুন্দর ফর্সা দেহ নিথর রইলো তো নিথরই রইলো। সবাই আমাকে দোষী করলো। আমি কেন পুকুরে যাবার বায়না করেছিলাম। আব্বা আমাকে চড়ও মারলেন। আমি কেন বেঁচে রইলাম বল বুবু? পরে জেনেছি তোকে সাঁতার শেখাবার ছলে কেউ একজন(নাম বলছিনা) পিঠে করে মাঝ পুকুরে নিয়ে গিয়েছিলো। ফিরে আসাতে কষ্ট হচ্ছিলো বলে তোকে ছেড়ে দিলো। কি করে মানবো বল? আমার ওপরে রাগ করে আছিস এখনো বুবু? পারবিনা আমায় মাফ করতে?
আমার বিশ্বাস তুই বেহেস্তি বাগানে ফুল হয়ে আছিস। মহান আল্লাহ তোকে বেহেস্তি বাগানে ফুল করেই রাখুন।
আমি ভাবিনি তোকে কখনো লিখতে পারবো। কষ্ট হয় বুবু, ভীষণ কষ্ট!
যেখানেই আছিস খুউব ভালো থাকিস বুবু।
আজকের দিনটা এলেই আমি বড় বেশি কাঁদি। আমার যে আর কেউ বোন রইলোনা। শুভ’টাও ছেড়ে চলে গেলো।
ওকে তো নিজের বাচ্চার মতো করে পালতাম রে! তাও চলে গেলো।
আর লিখতে পারছিনা।
তুই ভাল থাকিস।
তোর
লিপি আপু
১০: ১০:২০১৯
৩২টি মন্তব্য
নীরা সাদীয়া
এক হৃদয়বিদারক কাহিনী পড়লাম। সত্যি, আপনজন হারালে এমনটাই লাগে। শুধু মনে হয় কেন তাকে যেতে দিলাম?
আমিও ভাবছি লিখব একটা চিঠি, কোন এক প্রিয়জনকে ।
বন্যা লিপি
এ কাহিনী সম্পূর্ণ সত্যি।আমার ইমিডিয়েট ছোটো বোনকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
মনে হয়না যেভাবে লিখতে চেয়েছিলাম, সেভাবে লিখতে পেরেছি। কষ্টগুলো ভাষা রুদ্ধ করে রেখেছে। পড়েছেন, মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ জানবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
nনa পড়েই দিলাম ভাল নাই। দেশের তরে। পড়ে আসল মন্তব্য হবে।
বন্যা লিপি
আচ্ছা ভাই, পরে আসবেন কিন্তু।
মোঃ মজিবর রহমান
আমিও যে আর পারছিনা বোন এর মন্তব্য লিখতে। এই চিঠি এমনই যেভার বওয়া খুব খুব খুব কস্টের। ঐ পারে ভাল থাকুক এইটুকুই বলি।
বন্যা লিপি
কিছু কষ্টের ভার আপন মনেই বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন।
ধন্যবাদ ভাই, ভালো থাকবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যা, কিছু কিছু বোঝা নিজেই বইতে হয়। আল্লাহ আপনাকে সেই ভার সহ্য করার শক্তি দিক। আমিন
মনির হোসেন মমি
পুকুরে পানিতে ডুবে মৃত্যু! এ মৃত্যুটা আমার অনেক চেনা তবে মরিনি আমি ভাগ্যের জোরে এক সকালে ডুবেছিলাম পুকুরে উদ্ধার হই সেই বৈকাল পাচটায়। অলৌকিক ভাবে বেচে যাই আমি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।আজ আপনার এ লেখাটি পড়ে মনে পড়ে গেল আমার সেই ভয়ংকর স্মৃতি। ওপারে ভাল থাকুক আপনার বোনটি এই দোয়া রাখছি।
বন্যা লিপি
রাখে আল্লাহ্ মারে কে?
চমৎকৃত হলাম জেনে, আপনার কথা।
লিখে ফেলুন আপনার সেই স্মৃতীকথা। আমরাও জানবো।
কৃতজ্ঞতায় ধন্যাবদ জানবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
কি বলেন আল্লাহই রখার মালিক। কোথায় সকাল আর কোথায় বিকাল বিশ্বাস করা ও শক্ত।
আল্লাহ ভাল রাখুন আপনাকে।
আরজু মুক্তা
কীভাবে লিখলেন এই কষ্টের কথা। ভাষা নির্বাক। হৃদয়বিদারক। কান্না জমে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
বন্যা লিপি
অনেক চেষ্টার পরে লিখেই ফেললাম।
অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করছিলাম লিখতে।
অবশেষে এটুকু পারলাম এভাবে….
ভালো থাকবেন।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। হৃদয় বিদীর্ণ হতে থাকে আজীবন।
বন্যা লিপি
বেশ কষ্ট হয় এমন বিদায় মেনে নিতে।
সর্বস্রষ্টা মহান,
তিনিই সর্বময়।
ভালো থাকবেন সবসময়। শুভ কামনা।
মোহাম্মদ দিদার
বেস গুছিয়ে লিখেছেন।
শেষে কাঁদাতে ছা্রলেন না!!!
বন্যা লিপি
কান্নাটুকু যে সম্বল এখন শুধু!! ভালো থাকবেন সবসময়। ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানবেন। শুভ কামনা।
আহমেদ ফাহাদ রাকা
দিলে তো মনটাকে খারাপ করে আমার
সুইটি আপু তুমি ভালো থেকো জান্নাতে ❤️❤️❤️
আমিন
বন্যা লিপি
আমিন।আমাদের বোনটা জান্নাতে থাকুক শান্তিতে রাকা!
ভালো থেকো সবসময়।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
লেখা পড়ে ব্যথিত হলাম আপু। বোনের জন্য অনেক দোয়া রইলো।
আজ আপনার লেখায় সত্যিই চমৎকৃত হলাম। ফাঁকিবাজের মত যিনি বড় লেখা এড়িয়ে যেতেন তিনি নিজেই আজ এত সুন্দর আবেগময় লেখা লিখেছেন দেখে অনেক খুশি হয়েছি।
ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। শুভকামনা রইলো।
বন্যা লিপি
ভাই বড় হয়ে গেছে অনেক, তাইনা? কি করবো বলুন? এটুকু না লিখলে কি পুরোটা বোঝানো যেত?
ধৈর্য ধরে পড়েছেন তাতেই ধন্য হলাম অনেক। শুভ কামনা, শুভেচ্ছা জানবেন।
তৌহিদ
আরও বড় করে লিখুন, পড়তে আমার ভালোলাগে আপু।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
এ ব্যথা কোনোদিন ভুলবার নেয়। আল্লাহ পরপারে উনাকে শান্তিতে রাখুন।
বন্যা লিপি
আমিন। দোয়া করবেন ভাই। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
ছোট বোনের আত্মা শান্তিতে থাকুক ওপারে। কলিজার টুকরা বোনের পরপারে চলে যাওয়া কতটা হৃদয় বিদীর্ণ করে তা কাউকে বোঝানোর মত নয়।
ভালো থেকো বন্যা। শুভ কামনা 🌹🌹
বন্যা লিপি
আমার একটা নয় সাবিনা, দুজন বোন চলে গেছে আমাকে একলা করে।
দোয়া করি ওরা জান্নাতি ফুল হয়ে থাকে যেন। তোমাকে অজস্র ভালবাসা ❤❤❤
সাবিনা ইয়াসমিন
নিজের অর্ধ শততম পোস্ট প্রিয় বোনকে নিয়ে দিয়েছো। সে যেখানেই আছে তোমার এই নিবেদনে খুশি হবে।
শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন অর্ধ শততম পোস্টের জন্যে। আশা করি অতি শিগ্রিই শততম পোস্ট আমাদের উপহার দিবে। 🌹🌹
বন্যা লিপি
তোমাকে আবারো অজস্র কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা ❤❤
এমনি করে পাশে থেকো সবসময় চেষ্টা জারি থাকবে শততম পোস্টের।
ইঞ্জা
চোখের কোণে জল নিয়ে চিঠিটি পড়ছিলাম আপু, বুক ফেটে কষ্ট বেরিয়ে আসছে, কি বলে স্বান্তনা দেয় আপনাকে, বোনের অকাল মৃত্যু আসলেই সইবার নয় আপু।
দোয়া করি আল্লাহ্ যেন আপুকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাগানে রাখেন, আমীন।
😭
বন্যা লিপি
আপনার সহানুভূতি টুকু সঞ্চয় করে রাখলাম ভাই। দোয়া করবেন আমার বোনের জন্য।কৃতজ্ঞতা, শুভ কামনা শুভেচ্ছা জানবেন।
ইঞ্জা
অবশ্যই দোয়া থাকবে আমাদের বোনের জন্য, আপু।
শুভেচ্ছা আপু।
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
তুই পারবি তো পড়তে আমার চিঠি।
পৃথিবীতে বোনের মতো আপন সত্বা আর ২য় টি হয় না
বন্যা লিপি
একদম ঠিক বলেছেন আপু,দু’দুটো বোন হারিয়ে অবশেষে আমি একা রয়ে গেছি। সবার মাঝে বোনদের খুঁজি। আমার অনেকগুলো কাজিন বোন আছে। ওদের মধ্যেই খুঁজি আমার হারানো বোনদের। ওরাও আমাকে ভীষণ ভালবাসে।
আপনাকে ধন্যবাদ অনেক।
মনে হচ্ছে আপনি আমার ব্লগে এসে পচন্দসই পোস্টগুলোতে মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। আমার নজরে পড়তে দেরি হলো বলে ক্ষমাপ্রার্থী।
ভালবাসা রইলো আপনার প্রতি।