বেলা খানিকটা পড়ে এলে কলসী কাঁখে বাইরে বেরিয়ে আলতো পায়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সালেহা। সেই নির্জন আমগাছটা পেরিয়ে সে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ামাত্র আধো-আলো, আধো-অন্ধকার থেকে বেরিয়ে লোকটা সালেহার সামনে দাঁড়ায়। তার চোখের তীব্র ঢেউ এসে কামনার মত আছড়ে পড়তে থাকে সালেহার দেহের ওপরে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সে তাকিয়ে থাকে। মৃদু হেসে চোখের ইশারায় তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয় সালেহা। লোকটা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। একমুহূর্তে সে সালেহার ডান হাতটা নিজের হাতের ভেতরে তুলে নেয়। সালেহার শরীরেও এক অচেনা বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যায়। তার রক্তের গতি কয়েক লক্ষ গুণ বেড়ে গিয়ে এক উল্টা স্রোতের আবর্তে তাকে নিক্ষেপ করে। মুখের ওপরে একটা রক্তিম আভা ঘন আবরণের সৃষ্টি করে। সে কিছু বলে না। মুখে শুধু একটা মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘রাইতে ঘরে আইসেন।’
সালেহার কথা শুনে লোকটার চোখের ভেতরে একটা স্বপ্ন দোল খেতে থাকে। তার মনে হয়, সে কোনও সুদূরপারের মায়াবী নারীর কণ্ঠের আহ্বান শুনছে। কথাটা যেন সে শুনতে পায়নি, এমনভাবে সালেহার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী বললা তুমি, কী বললা তুমি আমারে ?’
‘বললাম, রাইতে ঘরে আইসেন।’
‘ক্যান্ রাইতে তোমার স্বামী ঘরে থাকবে না ?’
‘না, হ্যারা সবাই যাত্রা দেখতি যাবি। ঘরে আমি শুধু একলাই থাকব।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে লোকটার। এত সহজে সালেহা নিজের স্বপ্নের নায়িকা হয়ে তার বাহুপাশে ধরা দেবে, সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিলো শেষপর্যন্ত প্রত্যাখানই জুটবে তার ভাগ্যে। অবশ্য সে জানে, কঠিন প্রাপ্তির জন্য জীবনে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়-অনেক সাধনা করতে হয়। কিন্তু তাকে তেমন সাধনা করতে হয়নি, শুধু কিছুটা ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তবে কি তার কথায় ভয় পেয়ে সালেহা তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, নাকি তার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তাকে তার ঘরে আহ্বান জানাচ্ছে ? একটা অজানা পুলকে ভরে ওঠে লোকটার মন। সে তার অসম্পূর্ণ দাড়িতে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে, ‘আমি রাইতে তুমার ঘরে আসব।’
সালেহা মৃদু হাসির ঝলক ছড়িয়ে খাঁ সাহেবের পুকুরঘাটে গিয়ে দ্রুত বাড়ির পথ ধরে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটা ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে প্রকৃতিকে। আমবাগানে ঝিঁঝিপোকার আলোর উৎসব শুরু হয়ে গেছে। এখন আর গাছের আড়ালে লোকটিকে দেখতে পায় না সালেহা। সে গিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তুলে দেয়া শেকলটা টেনে নামিয়ে ঘরে ঢোকে। খুঁজে খুঁজে ম্যাচের কাঠি দিয়ে হ্যারিকেনটা জ্বালায়। স্বামী রহমত আর ভাইয়েরা এখন ঘরে ফিরবে না। সকালে মাঠে যাবার সময় তার ঘরের পেছনের মুলিবাঁশের বেড়ার বাঁধন খুলে কোনও রকমে হালকা করে লাগিয়ে রেখে গেছে। ঘরের ভেতরে একা একা বসে উত্তেজনায় কাঁপছে সালেহা। লোকটাকে তো ঘরে আসতে বলল। সে এলে কী করবে সালেহা ? যদি লোকটা এসে তার গায়ে হাত দেয়, যদি…। ভাবতে পারে না সে। সে কি চীৎকার করবে ? তা না হলে রহমত, ভাইয়েরা কেমন করে টের পাবে, লোকটা ঘরে এসে ঢুকেছে ? কিন্তু চিৎকার করলে তো আশেপাশের ঘরের মানুষরাও সব ছুটে আসবে। এসে এভাবে লোকটার সঙ্গে খালি ঘরে সালেহাকে দেখলে কেলেঙ্কারী হবে। না, চিৎকার করবে না সালেহা।
ঘরের দরোজায় হালকা টোকা পড়ে। একটা ফিস ফিস আওয়াজ কানে ভেসে আসে সালেহার।
‘সালেহা, দরজা খোল। আমি এইসেছি।’
সালেহা নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে ভেতর থেকে দরজার খিল খুলে দিলে লোকটা একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে একলাফে ঘরে ঢুকে পড়ে। সালেহা দরজা বন্ধ করে দেয়। হ্যারিকেনের আলোয় এবার ভাল করে লোকটার মুখটা দেখে। বয়স কত হবে ? তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ। থুতনিতে কালো কুচকুচে দাড়ি। বাকি মুখাবয়র ফাঁকা। মাথার চুল ছোট করে ছাটা। চোখে সুরমার সরু রেখা চেহারায় একটি মেয়েলি আভরণ সৃষ্টি করেছে। গায়ে সাদা দীর্ঘ পাঞ্জাবি, পরনে একটা চেক লুঙ্গি। গায়ের রঙ শ্যামলা। সালেহাকে আকর্ষণ করতে পারে, এমন কোনওকিছুই তার চেহারায় নেই। তবুও লোকটা সালেহার পেছনে লেগেছে। সে জানে তার স্বামী আছে, সন্তান আছে-তবু সালেহাকে তার চাই-ই। সালেহা বোঝে, এটা পুরুষমানুষের এক ধরনের নেশা। অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণের মধ্যে ভালবাসার চেয়ে কামতৃষ্ণাই যে প্রবল হয়ে ধরা দেয়, এই লোকটা তার ব্যতিক্রম নয়। মনে মনে লোকটাকে ঘেন্না করতে শুরু করে সে।
লোকটা ঘরে ঢুকে খুব ভাল করে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে। গরিবের সংসারের যে হাল হয়, এ ঘরেও তার জরাজীর্ণ প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করে তার প্রলোভনের মাত্রাটা আরও বেড়ে যায়। সে বুঝতে পারে, কেন এত সহজে সালেহা তার কাছে আত্মসমপর্ণ করতে বাধ্য হয়েছে। দারিদ্র্য নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসে পয়সাওয়ালা মানুষেরা। আজ সে চতুর শিকারী, সালেহা তার জালে বন্দি নির্জীব মাছ। সালেহাকে নিয়ে এখন সে খেলবে, বড়শিতে গেঁথে নিয়ে এক উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়বে। আজ সালেহা শুধু তার, শুধু তার।
‘আপনে চৌকিতে বসেন।’ লাজনম্র কণ্ঠে বলে সালেহা।
চৌকিতে বসতে বসতে বলে লোকটা, ‘আইজ যে আমার কী আনন্দ লাগতেছে সালেহা, তোমারে কী কইরে বোঝাব।’
সালেহা হাসে। সেই হাসির মধ্যে আলোর দোলনার মত অজ্ঞাত এক রহস্য ঝুলে থাকে। লোকটার বুকে তাতে আরো শিহরণু জাগে। সে সালেহার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি মুহূর্তেই একবার পর্যটন করে আসে। কী সুন্দর দেখতে এই সালেহা। কে বলবে তার আট বছর হলো বিয়ে হয়েছে, তার সাত বছরের একটা ছেলে আছে। ছেলেকে সালেহা আজ মেজ বউয়ের ঘরে ঘুমোতে বলেছে। বোনদের সঙ্গে খেলতে খেলতে সে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ ঘর একেবারেই ফাঁকা। লোকটার আর তর সয় না। সে চাপা স্বরে ডাক দেয়, ‘কাছে আসো সালেহা।’
সালেহাও রহস্য করে, ‘আসতিছি মিয়া সাব, আসতিছি। এত তাড়া কিসের ? সারারাত্তির তো পইড়েই আছে।’
‘তা তো আছেই। তাই বইলে কি তুমি এখন আমার কাছে একটুও আসবা না?’
‘আমি তো আপনার কাছেই আছি। শুধু আমি আর আপনি। আইজ রাইতে এইখানে আর কেউ আসবি না।’
লোকটা দাঁত বের করে হাসে। জিভের আগায় একটুখানি তরল পদার্থ এসে ঝিলিক মারে। ঢোক গিলে সে আবার তরল পদার্থটুকু গলার ভিতর দিয়ে পেটের মধ্যে চালান করে দেয়। দেখে সালেহার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। লোকটা চৌকি থেকে নেমে সালেহার কাছে চলে আসে। সালেহার বুক দুরু দুরু করে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে কলস থেকে পানি ভরার ভঙ্গিতে দূরে সরে যায়।
(চলবে..)
আগের পর্বের লিংকগুলো :
পর্ব-১
http://sonelablog.com/archives/3693
পর্ব-২
http://sonelablog.com/archives/3840
পর্ব-৩
http://sonelablog.com/archives/3888
১৬টি মন্তব্য
শিশির কনা
সালেহা বড়শির টোপ , মাছ নিয়ে খেলা করছে । পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ
খসড়া
পর্বগুলি পরে এলাম। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। চলুক।
সাতকাহন
আপনারা আছেন বলেই তো লিখতে আনন্দ পাই।
প্রজন্ম ৭১
(y)
সাতকাহন
সাথে থাকবেন
আদিব আদ্নান
আমিও অপেক্ষা করছি ।
সাতকাহন
প্রথম থেকেই তো আছেন, ধন্যবাদ আপনাকে।
জিসান শা ইকরাম
ঘটনার বর্ণনা গুলো এত চমৎকার যে চোখের সামনে দেখছি যেন সব কিছু ।
সাতকাহন
আপনাদের দেখেই তো শিখি ভাইয়া
তুমি আমি এক
ভালো লাগলো পড়ে ……………
সাতকাহন
ধন্যবাদ আপনাকে।
ছাইরাছ হেলাল
বেশ ভাল হচ্ছে ।
গোছান লেখা ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, ভালো লাগলো।
মিসু
গল্পে কিছু সত্যি কথা বেড়িয়ে এসেছে , ভালো লাগছ । পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।
সাতকাহন
একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে, ছাত্র আন্দোলন করে জেল খাটার সময় এক খুনের আসামীর সাথে পরিচয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে সেই ব্যক্তিরই কাহিনী এটা।