নিউইয়র্কে আমার এক ভাড়াটিয়া ছিলেন।
দেশে স্ত্রী আর আমার বয়সী দু’টি কন্যা ছিল তাঁর। তিনি ম্যানহাটনে “হোমলেস শেল্টার” এ চাকুরী করতেন। সপ্তাহের পাঁচদিন কাজ, দুইদিন ছুটি। দেখা হলে, গল্প হলে, গল্পের পুরোটা জুড়েই থাকতো উনার পরিবার। বলতে বলতে খানিক আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতেন। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা পরিবারের জন্যে বিশুদ্ধ এক আবেগ।
ছুটির দিনে আমরা যখন শহরের বাইরে দূরে বেড়াতে যাই, কোন না কোন পার্টিতে যাই, কিংবা বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ, আড্ডায় মেতে থাকি, তিনি তখন একাকি ছুটি কাটাতেন অন্যভাবে। একদিনের মেট্রোকার্ড কিনে নিতেন, যা দিয়ে সারাদিন বাস, ট্রেনে ঘুরে বেড়ানো যায় একই ভাড়ায়। বাসার সামনের বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতেন। Q58 বাস এলে জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসতেন। শহর দেখতেন দিনভর। যাত্রীরা উঠে, আবার গন্তব্যে নেমেও যায়। কিন্তু তিনি বসে থাকতেন শেষ স্টেশন পর্যন্ত। আবার উল্টো দিকে ফিরতেন। আমি বলতাম, বসে থাকতে বোরিং লাগে না আপনার ? উত্তরে তিনি বলতেন, ” এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে বসে শহরের মানুষজনের, গাড়িগুলোর নিরন্তর ছুটেচলা দেখতে, ঘোরলাগা প্রকৃতি, শহর দেখতে ভালোই লাগে। এ ছাড়া আমার তো এই শহরে কেউ নেই, আনন্দ করবার জায়গা নেই।”
আরেকজন বড়ভাই ছিলেন। দেশে তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র পুত্র। ছুটির দিনে একাকি এখানে, ওখানে ঘুরতেন। সামান্য অসুস্থ ছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে পার্কে কিংবা রাস্তার পাশে বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিতেন। একদিন বিশ্রাম নেবার সময়টাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। পার্কের বেঞ্চিতে এমন করে ঘুমিয়ে থাকবার অপরাধে পুলিশ তাঁকে জরিমানা করে। তীব্র মনখারাপ নিয়ে সেদিন তিনি বাড়ি ফিরেন।
জীবনের প্রয়োজনে স্ত্রী-সন্তান-পরিবার থেকে দূরে বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন অজস্র মানুষ থাকেন, যাঁদের ছুটির দিন মানে অপার আনন্দের কোন দিন নয়। খাঁখাঁ রৌদ্রের ভর দুপুরের মতই শুন্যতা বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেন ছুটির দিন। কাটিয়ে দেন জীবনের অনেকটা সময়। অতঃপর একদিন শেকড়ে ফিরেন, নয়তো ফিরে তাঁর দেহ।
যেসব সন্তানরা তাঁদের বাবাকে জীবিত থাকার পরও বাবার উষ্ণ সান্নিধ্য পেলো না, ছুটির দিনগুলোয় বায়না ধরে এখানে ওখানে বেড়াতে যেতে পারলো না, তাঁদের মতন দুর্ভাগা আর কে হতে পারে ? কিংবা যেসব বাবা’রা এক আকাশের নিচে থেকেও সন্তানকে দেখতে পায়না, জড়িয়ে ধরতে পারে না, কাছে থেকে আবদারগুলো মেটাতে পারেন না, তাঁদের মতন হতভাগা পিতা আর কে হতে পারে ?
ছোট্ট এই জীবনে যারা পরিবার নিয়ে একসাথে জীবনের সুন্দর সময় অতিক্রম করছে, তাঁরা ভাগ্যবান। সত্যিই ভাগ্যবান।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
আমার স্বভাব কিছুটা আপনার ভাড়াটিয়ার মত,
দেশের বাইরে গেলে আমার ট্রেন বা বাসে এমন করে ঘুরতে ইচ্ছে করে,
ষ্টেশনের প্রথম থেকে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত, কত কিছু দেখার আছে।
পরিবার পরিজন থেকে বিভিন্ন কারনে বিচ্ছিন্ন সন্তান এবং বাবারা আসলেই হতভাগা
ভাল থাকুক সবাই।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
শুভকামনা…
মিষ্টি জিন
জিবন এবং জীবিকার মানুষকে কত অসহায় করে দিয়েছে ! ছুটির দিন কাটাতে হয় একাকী বাসে চড়ে বা পার্কের বেনচীতে বসে। খুব কষ্টের এই প্রবাস জিবন। 🙁
রিমি রুম্মান
পিছনের গল্পগুলো দেশে পরিবার গুলোর অজানাই থেকে যায়।
মিষ্টি জিন
ঠীক তাই আপু । 🙁
ছাইরাছ হেলাল
কঠিন বাস্তবতার কাছে স্নেহ মায়া ভালোবাসা হেরে যায়।
রিমি রুম্মান
ছোট্ট একটা জীবন এমন করেই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায় অনেক না পাওয়া নিয়ে।
আবু খায়ের আনিছ
জীবন এমন ই এক বাস্তবতা যার সাথে কোন কিছুর তুলনা চলে না, সব কিছু হার মেনে যায় এই বাস্তবতায়।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন।
তবুও ভাল থাকুক সবাই এই দোয়াই করি।
ব্লগার সজীব
আপু এসব ভাবলে খেয়ে না খেয়ে থাকি তবুও পরিবারের সাথে থেকে যেতে ইচ্ছে করে।
রিমি রুম্মান
এটাই ভাল। অনেক না পাওয়ার বেদনার চেয়ে একসাথে থাকাই বড় পাওয়া , বড় আনন্দের।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রবাস জীবনের অনুভূতি দেশের মানুষ সহজে বোঝে না।
রিমি আপু জানো আমিও না হ্যামিল্টন এসে বাসে উঠে বসতাম, যেখান থেকে উঠতাম, শেষ স্টপেজে গিয়ে থামার পর আবার যখন ফিরতো আমিও ওই একই সিটে বসতাম। তখন কিছুই চিনতাম না। বন্ধু ঊর্মী কাজে চলে গেলে একা লাগতো, তাই বেড়িয়ে পড়তাম।
রিমি রুম্মান
বাহ্, এমনটি দেখি অনেকেই করে ! এই ঘুরে দেখাও মন্দের ভাল, তাই না, নীলা’দি ?
অনিকেত নন্দিনী
বাস্তবতার কষাঘাতে যারা একই আকাশের নিচে থেকেও সময়ে অসময়ে বাচ্চাদের নিয়ে আইসক্রিম খাবার বাহানায় দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনা, ছুটির দিনে ঘুরতে যেতে পারেনা, সারামাস রোজা রাখার পর ঈদের দিন গোসল করে সেজেগুজে আতর মেখে পুত্রের হাত ধরে নামাজে যেতে পারেনা, খুঁটিনাটি বাহানায় বুকে জড়িয়ে ধরে তাদের গায়ের গন্ধ নিতে পারেনা – সেসব বাবা এবং সন্তান সবাই অভাগা; তাদের মতো দুর্ভাগা আর এই পৃথিবীতে নেই।
ভালো থাকুক সবাই। 🙂
ইঞ্জা
ভালো থাকুক সকল বাবারা। -{@
মৌনতা রিতু
জীবনের বাস্তবতার কাছে সবকিছুই যেন তুচ্ছ।
একেকটা মানুষ একেকরকম ভাবে জীবনটা উপলব্দি করে। পার্কে একটু ঘুমালেও জরিমানা করে !
সত্যি দিনশেষে ক্লান্তির অবসানই তো সন্তান। সন্তানের হাত ধরে এ পথ ওপথ হেটে বেড়ানোর অন্য এক জীবনের স্বাধ।