জীবনে অনেক কিছুই ঘটে যায়, যার কোনো কারণ থাকেনা। আর থাকলেও সেটা খুঁজে পাওয়া যায়না। এমনই একটা সত্যিকারের ঘটনা বলতে এসেছি। আমি কানাডার নোভাস্কোশিয়া প্রদেশে আসি ২০১১ সালে। আর ২০১২ সালের জুন মাসে ওন্টারিও প্রদেশের হ্যামিল্টনে চলে আসি। এখানে এসে প্রথম দুই মাস বন্ধুর বাসায় থেকে বাসা খোঁজা শুরু করলাম। আগষ্ট মাসে স্যানফোর্ড এভিনিউর একটা এপার্টমেন্টে উঠি। দুই বেডরুম, তার সামনেই একটা লম্বা প্যাসেজ, এখানে ক্লোজেটগুলো আছে। বাসাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে আরোও এক কারণে ছেলের স্কুলও খুব কাছে, রাস্তার এপার আর ওপার। একেবারে নিশ্চিন্ত আর কী!
সেপ্টেম্বরে তরুণ চলে গেলো ওর চাকুরী স্থলে আর তীর্থরও স্কুল খুলে গেলো। আমি তখনও কাজ খুঁজছি। বাসায় একা। রান্না শেষ করে, ঘর পরিষ্কার করলাম। তারপর স্নান সেরে পূজো করতে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো একটা বাচ্চা যেনো প্যাসেজে ছুটোছুটি করছে। আমার মনে হলো ধ্যাৎ এ আমার মনের ভুল। তীর্থটাকে মিস করছি হয়তো। তারপর প্রায়ই এমন হতো। কেমন একটা ভয় কাজ করছিলো। তারপরেও সেভাবে পাত্তা দেইনি। একদিন তীর্থ এসে আমাকে বলে, “মাম আমার রুমে একটা ছোট মেয়েকে প্রায়ই দেখি।” আমি তীর্থকে কখনোই এসব কিছু বলিনি। তখন সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। একদিন রাতে আমার বন্ধু ঊর্মী এলো বাসায়। আসলে ও কাজ সেরে বিল্ডিংয়ের সামনের দিক দিয়ে যাচ্ছিলো, আমায় ফোন দিতেই বললাম বাসায় আয়। খেয়ে যা। তোর পছন্দের রান্না করেছি। ও এলো, বললো ফ্রেশ হবে, কাজ থেকে এসেছে। আমার জামা দিলাম ওকে। ঊর্মী স্নান সেরে বাইরে এসে বললো, “নীলা তীর্থ এখনও জেগে আছে? এগারোটা বাজে। সকালে স্কুল না?” বললাম ও তো ঘুমিয়ে গেছে রে দশটার সময়। বললো, “অসম্ভব! আমি নিজে দেখেছি আমাকে দেখেই একছুটে দৌঁড়ে গেলো।” বুঝে গেলাম নিশ্চিত সে-ই। কিছুই বললাম না ঊর্মীকেও। এই ভাবীর সাথে পরিচয় হলো, একদিন আমার বাসায় উনার পরিবারকে নিমন্ত্রণ করলাম। ভাবীর ছেলে ঢুকে বললো, “আন্টি তোমার বাসায় একটা মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পুতুলটা খুঁজছে।” আমি সেই সময় যে কী অবাক হয়েছি, পরে জানলাম ভাবীর ছেলে আত্মা সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখে। বললাম কই আমি তো দেখিনি। বললো, “আন্টি ওকে তুমি দেখতে পারবে না।” সেদিন ঊর্মীও ছিলো। সত্যি বলতে কি অসম্ভব ভয় পেয়েছিলাম সেইদিন থেকে। ভাবীর ছেলে শাহান আরেকদিন এলো চারটে পাথর নিয়ে। ও নিজেই রেখে দিলো। সেইদিনের পর আমি প্রায়ই শব্দ শুনতাম ধস্তাধস্তির। আর ঘুমাতে গেলে মনে হতো কেউ একজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তখন আরোও ভয় শুরু হলো। শাহানকে বললাম সব খুলে। ও বললো, “আন্টি আমি ভালো একটা আত্মাকে দায়িত্ব দিয়েছি, তাই তোমাকে পাহারা দেয়। সাতদিন পর আর দেখবে না।” আমাকে অবাক করে দিয়ে আসলেই আর কিছুই যেনো অনুভব করিনি। এই বাসায় ছয়টি বছর পার করে দিলাম। তারপর আর কিছু হয়নি।
পরে খবর নিয়েছি আমার এই বাসায় একটা পরিবার ছিলো, বাবা-মা এবং ৫/৬ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটি খুব অসুস্থ ছিলো। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই মারা যায়। ওর সঙ্গে সবসময় একটা পুতুল থাকতো। অনেকেই বিশ্বাস করতে না পারেন, কিন্তু আমার জীবনে এমন একটি সময় এসেছিলো। তারপর থেকে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করি যে আত্মা আসলেই আছে। যারা অতৃপ্তি নিয়ে প্রাণত্যাগ করে, তারা এই পৃথিবীর মোহ কাটিয়ে যেতে পারেনা।
হ্যামিল্টন, কানাডা
২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ইং।
২৮টি মন্তব্য
ইঞ্জা
উফ লিখলেন তাহলে, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম, আমার এক লেখায় আপনার এই ঘটনার কিছু বলেছিলেন যা আজ সম্পূর্ণ জানলাম, ভয়ই পেয়েছি। 😮
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া আমি ভয়ঙ্কর ভীতু এসব ভৌতিক ব্যাপারে। অথচ নিজেই অবাক হয়ে গেছি কীভাবে এতো সাহস তৈরী হলো আমার! মামনি আমায় বলতো ভুত বলে কিছু নেই, তাই ভয় পেতে নেই। মানুষ হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অথচ আমি এখন পর্যন্ত কোনো মানুষকে ভয় পাইনি। অদৃশ্য আত্মার প্রতি ভয় থাকতো। একটা কথা লিখিনি, ভুলে গেছিলাম। আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো, উলটো বলতাম, “এই চুপচাপ থাক। এতো শব্দ করিস কেন?” 😃
যাক এখন আর কিছু নেই। 💃 \|/
ইঞ্জা
ওরে বাবারে, এমন করে বলতেন, আপনার সাহসের তারিফ করতেই হয় আপু। 😮
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া ভালো আত্মা তো! ভুতনাথ মুভির ভুতের মতো। 😃
তৌহিদ
আপু জীবনে এরকম অনেক কিছু ঘটে। হয়তো অবচেতন মনে অনেক কিছুই থাকে বলে এসব জীবনে প্রতিফলিত হয়। তবে ঘটনাগুলি কিন্তু বাস্তব। ভালো লাগলো পড়ে। ভালো থাকবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি এমন অবস্থার ভেতর কখনোই পড়িনি। তাই অনেক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া ভাবীর ছেলে শাহানের কাছেও কৃতজ্ঞ। শাহানের মধ্যে একটা শক্তি আছে। ওকে নিয়ে লিখতে চাই, তবে ছেলেটা এসব পছন্দ করেনা। তা না হলে ও আমাকে এমন অনেক কথা বলেছে, যা এ পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।
অশেষ ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
তৌহিদ
লিখে ফেলুন আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
কেউ যখন না চায় যে তার কথা লেখা হোক, সেটা করা ঠিক নয়। শাহানের অনুমতি ছাড়া তাকে নিয়ে লেখাটা অন্যায় হবে।
সাবিনা ইয়াসমিন
লেখাটি পড়ছিলাম আর কেমন জানি অনুভুতি হচ্ছিলো,,,ভয় পেলে যেমন শিরশিরে একটা কিছু হয়,,ঐরকম। অন্যকেউ হলে সেই বাড়িতে কিছুতেই থাকতে চাইতো না। আপনি ও তীর্থ অনেক সাহসী।
গল্প বলতে চাইনা,,কারন এটা সত্যি ঘটনা। অনেক ভালো করে লিখেছেন।❤❤❤💛
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার ছেলেটা সাহসী। আমি ভৌতিক ব্যাপারে সাহসী ছিলাম না। কিন্তু ঘাড়ে পড়লে যা হয় আর কী! শাহান এ-ও বলেছিলো অতৃপ্ত আত্মা হলেও ভয়ঙ্কর ছিলোনা। তবে দিন কে দিন এভাবে চলতে থাকলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো। তারপরও একটি বছর এভাবেই চলছিলো। ভাবীর সাথে পরিচয় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। ভাবীর পরিবারকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম, তা না হলে কি যে হতো জানিনা।
প্রেরণা পাই যখন আপনারা মন্তব্য করেন। অশেষ ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
সাবিনা ইয়াসমিন
শুভেচ্ছা শুভ কামনায় আছেন নীলা আপু,,,💛❤
নীলাঞ্জনা নীলা
অনেক ভালো থাকুন আপনি। 🌺🌺
বন্যা লিপি
পড়ছিলাম আর দেখছিলাম হরর মুভি’র দৃশ্য! সার্থক ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারন লেখনী’তে। কিছু আবছায়া রহস্য বা এজইউজাল্ কাকতালীয় ব্যাপার বলবো না ব্যাখ্যা সহ কোনো অপ্রয়োজনীয় আখ্যান….. বলতে পারবোনা খুুবই সামান্য দু’একটা ঘটনা জানি বা নিজেও টের পাই(অবশ্যই আত্না টাত্না কিছু নয়) এমন কিছু ঘটনা…. ইচ্ছে আছে লিখবো। শুভ কামনা আপনার প্রতি। নিরন্তর ভালো থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি ফু বা ঝাড়ফুঁক দেয়া কিংবা তাবিজ-কবজ, একেবারেই বিশ্বাস করিনা। এখনও না। শাহান চারটা নীল পাথর এনে যখন দিলো যদি বলতো পরতে, আমি মানা করে দিতাম। ও নিজে চারটা জায়গায় রেখে গেলো। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যদি আমি একা দেখতাম, তাহলে ভাবতাম এ আমার মনের ভুল। কিন্তু যখন তীর্থ, ঊর্মী ঠিক আমার মতোই দেখেছে, তখন বুঝলাম অবশ্যই কিছু আছে। যাক এখন আর নেই। এটাই শান্তির।
লেখাটির পাশে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। মন্তব্য পেলে প্রেরণা জাগে। ভালো থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
গল্প হিশেবে কষ্ট-মষ্ট করে চালানো যেতে পারে,
বানিয়ে-ছানিয়ে ভূতের গল্প বলা এত্ত সহজ না। আপনি বরং আপনি নিজে যা,
সেই শাঁকচুন্নির কাহিনী আমাদের শোনান।
বলে আপনি শান্তি পাবেন, আমরাও উত্রে যাব!!
নীলাঞ্জনা নীলা
বিশ্বাস করলেন না আপনি। কিন্তু আসলেই সত্যি। একবিন্দুও বানিয়ে লিখিনি। এখনও আলো জ্বালিয়ে ঘুমাই। যদিও কোনো কিছু নেই আর। তবে অভ্যাস হয়ে গেছে।
ভালো শাঁকচুন্নি আমি। কারো ক্ষতি-টতি করিনা। তবে কখনো বিগড়ে গেলে আর ভালো থাকিনা। \|/
ছাইরাছ হেলাল
ওহ, বুঝেছি,
এখন নিশ্চয়ই বিগড়ে আছেন!!
নীলাঞ্জনা নীলা
বিগড়ে থাকার কোনো কারণ কি আছে? ;?
রেজওয়ান
সত্যিই ভয়ংকর! সাবধানে থাকবেন আপি👌
নীলাঞ্জনা নীলা
এখন আর নেই ভাই। তবুও আলো জ্বেলে ঘুমাই। অভ্যেস হয়ে গেছে।
ভালো থাকুন। আর নতুন লেখা দিন।
মায়াবতী
আপু আপনি ভীষণ সাহসী একজন! আমি হলে না কান্না কাটি করে না জানি কি করতাম। ভালো লাগলো সত্যিকার ঘটনা টি।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রিয় মায়াবতী ভয় আমার এখনও আছে। তবে ঘাড়ে পড়লে কিছু কি করার আছে বলুন? আমি এখনও লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাই। 😀
ভালো থাকুন প্রতিনিয়ত।
রিতু জাহান
তুমি একবার বলেছিলে গল্পটা। উর্মি আপুর টুকুই অবশ্য। এখন পুরোটা পড়লাম। কি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে আসলে যার কোনো ব্যাখ্যা হয়না আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
সেই দিনগুলো যা গেছে না! তীর্থকে সাথে নিয়ে ঘুমাতাম আপু। তোমাকে পুরোটা বলিনি আগে?
নতুন লেখা দাও তো! আর ভালো লাগছেনা কিন্তু। ধৈর্য শেষ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আত্মারা ঘুরে বেড়ায় এটা সত্য।আমি যতটুকু জানি আপনি অনেক ভীতু এটা লিখলেন কি করে!সুন্দর সাবলিল বর্ননা আমারতো ভয় লেগে গিয়েছিল। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
মনির ভাই এখন উনারা নেই বলেই লিখতে পেরেছি। তাছাড়া আলো জ্বালিয়ে ঘুমাই এখনও। 😀
অনেক ভালো থাকুন।
জিসান শা ইকরাম
তুই একা দেখলে বা অনুভব করলে ভাবতাম মনের ভ্রান্তি। কিন্তু মেয়েটিকে তো অনেকেই দেখেছে। অতৃপ্ত আত্মা তাহলে থেকেই যায় এ জগতে ! জগতে কত যে রহস্য লুকিয়ে আছে!
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা আমি কিন্তু নিজেই ভাবতাম আমার মনের ভুল হয়তো। যেহেতু আমি ভয় পাই একলা ঘরে তাই মনে হয় অমন দেখছি, এ কথাই মনে হতো। ঊর্মী আর তীর্থ না দেখলে তো সেটাই মেনে নিতাম। শাহান আমাকে বাঁচিয়েছে আসলে। ও এও বলেছিলো আরোও যদি কিছুদিন এমন চলতো, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতো নিশ্চিত।
ভালো থেকো নানা। 🌺🌺