তেমন কোন প্লান ছিল না, হঠাৎ করেই ঘুরতে গিয়েছিলাম ব্রাক্ষনবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত আখাউড়া উপজেলাতে। সময় ছিল কম ভাবছিলাম এই অল্প সময়ে কি করা যায়। আগে থেকেই জানতাম আখাউড়া সীমান্ত এলাকা, বাংলাদেশের অন্যতম বড় স্থল বন্দর। সীমান্তের একপাশে বাংলাদেশের ব্রাক্ষনবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত আখাউড়া এবং অপর পাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। ইচ্ছে হল সীমান্তের আশপাশ ঘুরে দেখতে। এক রিকশাওয়ালাকে বললাম। রাজী হল সে। ব্যাটারি চালিত রিকশা। ফলে দ্রুত অতিক্রম করতে থাকি একটার পর একটা গ্রাম। দু পাশে যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সেই সবুজের বুক চিরে শ্বাশত মূর্তির মত দন্ডায়মান কালো কাঁটাতার, কাঁটাতারের ওপারে টহলরত বিএসএফ জওয়ান, তাদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে ফসলের শুষ্ক মাঠে ক্রিকেটে ব্যস্ত একদল গ্রাম্য কিশোর। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছিলাম সব কিছু। একসময় থেমে যায় রিকশা। রিকশাওয়ালা বলে-ভাই, এটাই শেষ মাথা। এরপর আর যাওয়া যাবে না। ও আচ্ছা বলে রিকশা থেকে নামি। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই নো ম্যান্স ল্যান্ডের দিকে। পিছন থেকে ভেসে আসে রিকশাওয়ালার সাবধান বাণী- ভাই আর যাইয়েন না, বিএসএফ গুলি করতে পারে। সেই সাবধান বাণীকে অগ্রাহ্য করে সামনে এগোনোর সাহস আর হয় না নগণ্য আমার। ফিরে এসে বাংলাদেশের ভুখন্ডে। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি- আপনি কি গিয়েছিলেন কখনো ঐ পারে? মুচকি হেসে সে উত্তর দেয় -আমার শ্বশুরবাড়িই ঐ পারে।
-তাই নাকি? শ্বশুড়বাড়িতে কি যাওয়া আসা হয়?
-হয় বছরে একবার। এইখানে তো কাঁটাতার, এই দিক দিয়ে যাওয়া যায় না। কুমিল্লার ঐদিকে কাঁটাতার নাই। ঐদিক দিয়ে যাই।
-ও আচ্ছা।
রিকশায় করে ফেরার সময় লোকটির জীবনের গল্প শুনি। কী বিচিত্রই না তার জীবন! বর্ডার চেক পোষ্টের সামনে লোকজনের বেশ বড় সড় জটলা দেখতে পাই। চেক পোষ্টের ঐ পারে কিছু ভারতীয়কেও দেখা যাচ্ছে। রিকশা থেকে নামি। এক বিজিবি সদস্যকে জিজ্ঞেস করি চেক পোষ্টের সামনের দিকে যাওয়া যাবে কি না। সে বলে-পৌনে ছয়টার দিকে এক সঙ্গে দু দেশের জাতীয় পতাকা নামানো হবে তখন যেতে পারবেন। অপেক্ষা করতে থাকে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার।
সেদিন ছিল রবিবার, ভারতের সাপ্তাহিক ছুটি। সঙ্গত কারণেই ওদের দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি। বিপরীতে আমরা বাংলাদেশীরা আর কত হব? বড় জোর পনের-বিশ জন। একদল স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে, পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা এক ভদ্র মহিলা ও তার সদ্য বিবাহিতা সুন্দরী মেয়ে (সিঁদুর পরিহিতা, যেটা না থাকলে হয়তো ক্রাশ ট্রাশ জাতীয় কিছু একটা খাইতাম!!!) আর আরো কয়েকজন স্বাভাবিক দর্শনার্থী। দু একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অনেকেরই কাছ থেকে সীমান্ত দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ক্যাম্প কমান্ডারকে পরিচয় বলেছিলাম সেই সুবাদে সামনে সারির এক চেয়ারে আসন পাই। একসময় শুরু হল দুই পক্ষের যৌথ মিনি কুচকাওয়াজ। বিউগলে সুর বেজে ওঠে। দুই পক্ষ থেকে চারজন জওয়ান প্যারেড করতে করতে এগিয়ে যায়। পুরোপুরি সামরিক কায়দায় একসঙ্গে নামানো হয় দুই দেশের জাতীয় পতাকা। এই সব সামরিক কুচকাওয়াজ আমাকে টানে না, টানেওনি কোন কালে। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে শুধু তাকিয়ে দেখি। কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েগুলোকে দেখলাম বেশ মজাই পাচ্ছে। আমিও ওদের মজার অংশীদার হই।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে দুই ক্যাম্প প্রধান হাত মেলায়। শুধু মাত্র সেসময় দুই পারের দর্শনার্থীরা কাছাকাছি আসতে পারে। আমরা এগিয়ে যাই, ওরাও এগিয়ে আসে। অদ্ভুত এক বিষন্ন দৃষ্টিতে ওরা তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে, যে দৃষ্টিতে একই সঙ্গে মিশে থাকে এক ঝাঁক কৌতূহল কিংবা প্লাবিত মায়া। কে জানে ওরাও হয়তো আমাদের চোখে খুঁজে পায় সেই একই বিপরীত বিষন্নতা, একই বিপরীত মায়া। জ্বলে ওঠে ক্যামেরার ফ্লাশ কিন্ত ফ্লাশের সাদা আলোও আড়াল করতে পারে না সীমানা বিহীন সেই মায়া, বিষন্নতা, কৌতূহলগুলোকে। এক সময় দুরত্ব মাত্র দু হাতে নেমে আসে। মাত্র দু হাত। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে সেই ছোট মেয়েটির হাত যে তার বাবার হাত ধরে রাজ্যের বিস্ময় চোখে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছা করে ঐ পারের সবুজ ঘাসের। আচ্ছা সেই ঘাসের ঘ্রাণ কি ভিন্ন হবে এ পার থেকে কিংবা ভিন্ন কি হবে সেই ঘাসের কোণায় জমে থাকা শীতের শিশিরবিন্দু? এক ঝাঁঁক প্রশ্নের জড়তায় আচ্ছন্ন আমি সেদিন হাতটাও বাড়াতে পারিনি। কে জানে দেশ জাতি, সীমান্তের ক্ষুদ্র সংকীর্ণতাগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরী চিরে বেরিয়ে এসেছিল কিনা। জীবনে প্রথমবার নিজেকে শৃঙ্খলিত কারাগারের বন্দী বলে মনে হয় আমার। উপলব্ধি করি সীমাবদ্ধ স্বাধীনতার মর্মবেদনা, অনুভব করি সেই বিভাজনের কষ্ট, যে কষ্ট যুগের যুগ ধরে বহন করছে সীমান্তের দুই পারের মানুষ। যে বিভাজন ভাইয়ের সাথে বোনের, মায়ের সাথে সন্তানের, এমনকি স্বামীর সাথে স্ত্রীরও। ক্লান্ত আমি শুধু একবার আকাশের দিকে তাকাই। সন্ধ্যা নামছে। কর্মব্যস্ত একটি দিন শেষে ঘরে ফিরছে মানুষ। দিগন্ত থেকে নীড়ে ফিরছে পাখিরাও, গোধূলি আকাশে উড়ে চলেছে দেশ, জাতি, সীমান্তের সকল বাঁধাকে তুচ্ছ করে। পাখিদের কোন দেশ নেই…
২৭টি মন্তব্য
আবু খায়ের আনিছ
পাখিদের কোন দেশ নেই, আমাদের দেশ আছে। পাখি বর্বর না, আমরা বর্বর।
ভালো লাগল ভাই, নিজের চোখে দেখেছি সীমান্ত কয়েকবার। নিজেকে বন্দী মনে হয় সীমান্তে গেলে।
অপার্থিব
ব্র্রিটিশ কর্মকর্তা সাইরিল র্যাডক্লিফের কলমের আঁচড়ে শুধু দেশটাই ভাগ হয়নি, ভাগ হয়েছিল মানুষ ভাগ হয়েছিল মানবিকতা। দেশভাগের সময় ছড়ানো ঘৃণা আর সাম্প্রদায়ীকতার আগুন আজ কয়েক দশক পরেও নুতুন মাত্রায় আরো বিস্তৃত ভাবে দুই দেশে টিকে আছে। এই ঘৃণা বা সাম্প্রদায়ীকতা থেকেই সীমান্তে গুলি চলে, ফেলানীরা কাঁটাতারে ঝুলে। এই দেশভাগের পরোক্ষ ক্ষতি আজও অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত ভোগ করছে।
অনেক ধন্যবাদ। -{@
আবু খায়ের আনিছ
শুভেচ্ছা আপনাকে।
খসড়া
পাখিদের দেশ আছে কিন্তু কোন সীমানা নেই।
অপার্থিব
দেশ গঠনের একটা মৌলিক শর্ত হচ্ছে সুনির্দিষ্ট সীমানা থাকা। পাখিদের উড়ার কোন সীমানা নেই , তারা কতটুকু উড়বে সেটা সম্পূর্ণরূপে তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। -{@
SHAMIM ANWAR
অনেক ভালোলাগলো লেখাটা
অপার্থিব
অনেক ধন্যবাদ। -{@
ইনজা
ভালো লাগা রইল আর শেষের লাইনখানি মন ছুঁয়ে গেল।
অপার্থিব
অসংখ্য ধন্যবাদ । -{@
মৌনতা রিতু
আমি বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ এলাকার মেয়ে। তাই কখনো দুই দেশের সীমান্ত বা বর্ডার দেখিনি। যখন বিয়ে হল সেই সৈয়দপুরে, তখন ট্রেনে করে আসা যাওয়ার সময় হিলি বর্ডার দেখতাম।
পাখি বা অন্যান্য প্রাণীরা তো আর বোঝেই না কোনটা কোন দেশ। হ্যাঁ, তবুও তাদের একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা আছে। এই বর্ডার পার হয়েই তারা নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছায়। কখনো কিছু প্রাণী নীড়ে আনতে প্রাণীর মালিক গুলি খেয়েও মরে। আর চোরাকারবারদের ব্যপার তো আছেই।
অনেকেই আপনার গল্পের রিক্সাওয়ালার মতো এপার ওপারে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
অনুভূতির প্রকাশ ভাল লেগেছে।
শুভকামনা জানবেন।
অপার্থিব
আমার হোমডিষ্ট্রিক্ট দিনাজপুর। হিলি সীমান্তেও কয়েকবার গিয়েছি। দেশভাগ পূর্বে হিলি বেশ বড়সড় মফস্বল শহর ছিল। দেশভাগের পর শহরের মূল অংশটা পড়ে যায় ভারতে আর রেল ষ্টেশনটা পড়ে বাংলাদেশে। পরে বাংলাদেশ অংশেও নুতুন শহর গড়ে উঠে।
ব্যক্তিগত অনুভূতি টাইপের লেখা এই প্রথম লিখলাম। আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ। -{@
স্বপ্ন
বিভাজন আমাদের আত্মাকে দিখন্ডিত করেছে। ভাল লেগেছে লেখা ভাইয়া।
অপার্থিব
বিভাজন শুধু আমাদের আত্মাকে দ্বিখণ্ডিতই করেনি , জন্ম দিয়েছে ঘৃণা ,সাম্প্রদায়ীকতা যার ফল সীমান্তের মানুষ এখনো ভোগ করছে।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। -{@
জিসান শা ইকরাম
রাজনৈতিক খেলায় পদদলিত হয় মানুষের মায়া, আবেগ, কান্না। কয়লা আনতে একবার গিয়েছিলাম সিলেটের সুতারকান্দি। কাটাতারের দুই পারে দুই ভাইয়ের সংসার। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন দুজনে, এরপরেও রোজ তাকিয়ে থাকেন কাটাতারের দিকে। কাটাতারের দুই পাশের পরিবার দেখেন মনের মাঝে।
বঙ্গ ভঙ্গ আমাদের হৃদয়কে কেটে দুইভাগ করে ফেলেছে।
অপার্থিব
এরকম দুই ভাইয়ের গল্প আরো আছে। পাকিস্তানের এক উচ্চ পদস্থ জেনারেল ছিল সাহেব জাদা ইয়াকুব আলী খান যার বড় ভাই সাহেব জাদা ইউনুস আলী ৪৭ সালে দেশ ভাগের পরও ভারতে থেকে যান । তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন । ৪৮ সালে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেই যুদ্ধে দুই ভাই একে অপরের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
জিসান শা ইকরাম
দেশ বিভাগ বড় নির্মম তবে অবধারিত বাস্তবতা।
লীলাবতী
রাজনীতির দাবা খেলায় সাধারণ মানুষের হৃদয় দুই ভাগ। ১৯৪৭ এ ভারত বিভাগের সময় তিনটি দেশ হলেই ভাল হতো। এর একটি বাংলা ( বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা নিয়ে)। ভাল লেগেছে লেখা।
অপার্থিব
দেশ গঠিত হওয়া উচিত ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে কিন্ত ৪৭ সালের ভারত ভাগ হয়েছে ধর্মের উপর ভিত্তি করে । ভারত বর্ষের প্রতিটি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক অঞ্চলগুলো নিয়ে যদি একাধিক আঞ্চলিক প্রদেশ গঠিত হত(স্বায়ত্বশাসনের অধিকার সহ) এবং তারা যদি একটা ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোয় যুক্ত থাকতো ( অনেকটা ব্রিটেনের মত) তাহলে সেটিই এই উপমহাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে ভাল হত।
ধন্যবাদ। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
পাখীদের কোনো দেশ নেই। কথাটি অনেক আগে পড়েছিলাম কোথায় জানি। ভুলে গেছি। কিন্তু কথাটি মনে বসে গেছে।
রাজনৈতিক পাশা খেলায় আস্ত একটি বাংলা দ্বি-খন্ডিত হলো। একই ভাষাভাষী হয়েও পাসপোর্ট লাগে অন্য খন্ডে যেতে।
অপার্থিব
দেশ ভাগ সীমান্তের দুই পারের মানুষের মধ্যে ঘৃণা সাম্প্রদায়ীকতার নুতুন মাত্রা উন্মোচন করেছে। ভিসা নিয়ে বৈধ ভাবে ঐ পারে গেলেও অনেক সময় হয়রানির স্বীকার হতে হয়। দেশ ভাগের প্রতিক্রিয়া আমরা এখনো বহন করছি, প্রতিনিয়ত… ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ভাল লেগেছে -{@
অপার্থিব
ধন্যবাদ। -{@
সকাল স্বপ্ন
ভালো লাগার অংশ—
অপার্থিব
কোনটা ? সেটা তো বললেন না!!! যাই হোক পড়ার জন্য ধন্যবাদ। -{@
ব্লগার সজীব
এমন অক্ষমতা নিজকে অত্যন্ত অসহায় লাগে। কিছুই করার থাকেনা। দেশ বিভাগ অমানবিকতার একটি দলিল, ইতিহাস।
অপার্থিব
দেশভাগ সাম্প্রদায়ীকতা , অমানবিকতার এক ভয়াবহ দলিল কিন্ত দুর্ভাগ্য বশত বাংলাদেশে দেশ ভাগ ও এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। অনেকেই দেশভাগ ও এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানে না। ইতিহাসের এই ভয়াবহ বিষয়ে আবারো নুতুন করে গবেষনা ও জরুরী।
ব্লগার সজীব
একমত আপনার সাথে। বাংলাদেশে অনেক কিছুরই তেমন প্রতিক্রিয়া নেই।