হ্যামিল্টন শহরটা যতোটা না ম্যান্যুফেকচারিং-এর জন্য বিখ্যাত, ততোটাই বিখ্যাত এখানকার আর্ট গ্যালারির জন্য। ১৯১৪ সালে আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওন্টারিও প্রভিন্সের তৃতীয় বৃহত্তম আর্ট গ্যালারি এই হ্যামিল্টনে অবস্থিত। এই গ্যালারিতে ৯০০০ আর্ট আছে যা তিনটি সময়কালে ভাগ করা হয়েছে। সেসব নিয়ে আলোচনা আরেকদিন হবে। ক্যাপশনের প্রসঙ্গেই ফিরে আসি।

“আর্ট ক্রল” শব্দটি প্রথম শুনি আমি গতমাসে। “Crawl” শব্দটির অর্থ জানতাম “হামাগুড়ি দেওয়া।” তাই একটু অবাক হয়েছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছি “ধীরে ধীরে চলা।”  যাক প্রথম পর্বে কিছুটা সে সম্পর্কে বলেছিলাম। এতোদিন পর দ্বিতীয় পর্ব লেখার কারণ হলো ভালো করে জেনে নিয়ে যাতে লিখতে পারি। এই আর্ট যে শুধু পেইন্টিং, তা নয়। যেহেতু আর্টের মানে শিল্প। আর শিল্পকলা তো বহুধরণেরই হতে পারে। ছবি আঁকা যেমন শিল্প, তেমনি রান্না করাও শিল্প। হ্যামিল্টন আর্ট ক্রল তেমনই একটি শিল্পমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেকে তার নিজস্ব শিল্পকলা প্রদর্শন করতে আসেন।

১৪ বছর হলো শুরু হওয়া এই  হ্যামিল্টন আর্ট ক্রল খুবই জনপ্রিয় এখানে। প্রতি মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার, উত্তর জেমস স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিকেল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলে, অবশ্য রাত বারোটাও বেজে যায়। প্রচুর ভীড় হয়, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে শুধু দেখতে শিল্পীদের শিল্পনৈপুণ্য। কেন এটি এতো জনপ্রিয়? এখানে যেসব স্টল বসে প্রত্যেকেই নিজেদের শিল্প-শৈলি প্রদর্শন করে। ৯৯.৯৯ ভাগ শিল্পীই স্থানীয়। কয়েকজন আসে বাইরে থেকে। এখানে যেমন থাকে পেইন্টিং, ঠিক সেভাবেই থাকে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় সঙ্গীত(অবশ্যই লিরিক্স এবং সুর তাদের নিজেদেরই সৃষ্ট), কেউবা সেলাই নিয়ে আসে, কেউ হাতে তৈরী জুয়েলারি, এমনকি নিজেদের তৈরী রেসিপিও পরিবেশন করেন। এই সমস্ত মিলিয়ে Hamilton Art Crawl. স্টলের কথা যে বললাম, কেউ কেউ চেয়ার-টেবিল নিয়ে আসে, কেউ কেউ তো পথের উপরেই বসে পড়ে। জেমস স্ট্রিটের দু’দিকের ফুটপাথেই এসব শিল্পীরা নিজেদের জায়গা করে নেয়। নাহ এ নিয়ে কোনো ঝগড়াঝাটি, চিৎকার বা চ্যাঁচামেচি শুনিনি।

ঈগলের চোখ…

আমি বেশ কয়েকজনের পেইন্টিং দেখলাম। অদ্ভুত সুন্দর! কেউ কেউ বাঁধাই করে নিয়ে আসেন। এবং তারা প্রত্যেকেই ওখানে বসেও আঁকেন। যদি সেই পেইন্টিং কেউ নিতে চায়, কিছুটা সময় চায়। তারপর শুকিয়ে গেলে দিয়ে দেয়। তেমন দাম ওরা নেয়না, কিছু কিছু পেইন্টিং আছে যার দাম $২০০-এর কম হবেনা। কিন্তু ৫০-এই সেটা পেয়ে যাওয়া যায়। অসাধারণ কিছু ফটোগ্রাফিও দেখলাম, চোখ ফেরানো যায়না। এই ভিজ্যুয়েল আর্টিস্টদের মধ্যে আরোও কয়েকজনকে দেখলাম যারা সিরামিক দিয়ে বিভিন্ন শোপিস, ফুলদানি ইত্যাদি তৈরী করে। হাতে বানানো মোম এবং দারুণ সুন্দর ডিজাইন চোখের সামনেই বানিয়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে শুধু চেয়ে দেখেছি। ওহ বলে নেই, আমার ছেলে নিজেও এসব বানিয়েছে, তবে স্কুলে। একটা সময় তীর্থ স্কুলে ভিজ্যুয়েল আর্টস নিয়ে পড়েছিলো।

আসলে এখানে সকলেই আসে এসব শিল্পীদের উৎসাহিত করতে। কেউ কেউ ক্রয় না করলেও সামনে দুই/পাঁচ ডলার রেখে যায়। সুতোয় বোনা হাতের কাজ, পুঁতির জুয়েলারি এসব বিভিন্ন কিছু সামনে থেকেই বিক্রেতার মনের মতো তৈরীও করে দেয়। স্থানীয় শিল্পীরা তাদের নিজস্ব ব্যান্ডের সাহায্যে, কিংবা কেউ শুধু এককভাবে গিটার/কিবোর্ড বাজিয়ে নিজেদের সৃষ্ট সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। সত্যি বলতে কী পরিবেশটা এতো অপরূপ হয়ে ওঠে যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সুরের সাথে কেউ কেউ নাচেন, যেমন আমিও নেচেছিলাম(অবশ্য ওয়াকার ড্যান্স)। যাক সেসব কথা। রাস্তার পাশেই কারো কারো নিজস্ব আর্ট গ্যালারি, স্থানীয় পোষাক ডিজাইনারদের বুটিক হাউজ, পারিবারিক রেস্টুরেন্ট(যেমন পর্তুগিজ, গ্রিক, ইতালিয়ান, মেক্সিকো পরিবারদের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি) আছে।

আসলে এই আর্ট ক্রল আমাদের দেশের মেলার মতো। শুধু এই মেলায় হাজার হাজার মানুষ ফুটপাত ধরে হেঁটে যায়, কিন্তু কারোর সাথেই কারো অযাচিত কিংবা অবাঞ্ছিত ধাক্কা লাগেনা। ভীড়কেও যে উপভোগ করা যায় নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়ে, তা এই মেলায় দেখতে পেয়েছি। শুক্রবারে সাধারণত বার কাম রেস্টুরেন্টগুলো খোলা থাকে রাত দুটো পর্যন্ত। বেশিরভাগ মানুষই কমবেশী এলকোহল পান করে। যারা একেবারে মাতাল হয়ে যায়, তারাও কাউকে বিরক্ত করেনা। কেউ কেউ কাগজে লিখে পাঁচ/দশ ডলার সাহায্য চায় বিয়ার কিনবে বলে। আমি জানিনা কেউ কি তাদেরকে টাকা দেয় কিনা! যদিও আমি দেইনি। আসছে সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে সবচেয়ে বড়ো আর্ট ক্রল হবে। বছরে একবার বিশাল বড়ো আকারের আর্ট ক্রল অনুষ্ঠিত হয়। একে বলা হয় “Supercrawl.”

কি দেয়া যায় ক্যাপশন?

যাক আর দীর্ঘায়িত করতে চাইনা। শুধু একজন ক্রিস্টিন আর্চারের কথা বলে শেষ করতে চাই। যাঁর নামের আগে বসানো হয় “lifelong Hamiltonian Kristin Archer.” যাঁর নিজস্ব একটা ব্লগ আছে, “I Heart Hamilton.” এখানে তিনি স্থানীয়দের উৎসাহিত করেন নিজের শহরকে ভালোবাসতে, যত্ন করতে। তাঁর চমৎকার একটা শ্লোগান আছে যা আমার মনে ধরেছে খুব, “Be a tourist in your own city.”

মনে পড়ে গেলো রবীন্দ্রনাথের কবিতা, যেখানে তিনিও বলেছেন–
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
দূর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।” (স্ফুলিঙ্গ ১৬৪)

যা লিখে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন নিজের দেশকে ভালোবাসার কথা। নিজের দেশের সৌন্দর্যকে আপন করে নিতে বলেছিলেন।

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৬ আগষ্ট, ২০১৮ ইং।

হ্যামিল্টন আর্ট ক্রল – অনন্য শিল্প নিপুণতা – আরম্ভ

৬৩৪জন ৬৩৪জন
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ