স্বাধীনতা সংগ্রামী মণীষা-৬ : কমরেড মনিসিংহ
(১৯০১-১৯৯০)
[মণিষীরা বলেছেন “যে জাতি তার বীর সন্তানদের মূল্য দিতে পারে না সে জাতির কোনোদিন বীর সন্তান জন্ম নিতে পারে না।”আমরা আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রামী আত্মদানকারী মণিষাদের সম্মন্ধে কত টুকুই বা জানি। যারা প্রবীণ তারা হয়তো কিছু কিছু জানে, কিন্তু আমাদের নবীন প্রজন্ম সেসব মণিষাদের সম্মন্ধে তেমন কিছুই জানে না।তাই সব শ্রেণির পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মণিষার জীবনী নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।]
-মাহবুবুল আলম
মণি সিংহ ১৯০১ সালের ২৮শে জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ছিলেন নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুর এলাকার জমিদার বংশের কন্যা।
২৬ সে জুন, তার জন্ম দিন। নেত্রকোনার পূর্বধলা শহরের দশভুজা বাড়িতে রয়েছে রাজা গোপিনাথ সিংহের বাড়ি। তিনি এই বাড়িতে দশভুজার একটি মূর্তি স্থাপন করে প্রতিদিন তাতে পূজা দিতেন। তাই স্থানীয়রা এই বাড়ির নাম দেয় দশভুজা বাড়ি। রাজা গোপিনাথ সিংহের পঞ্চম পুরুষ কালী কুমার সিংহের তৃতীয় পুত্র মনিন্দ চন্দ্র সিংহ ভারত উপমহাদেশের সাম্যবাদী কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিং নামে পরিচিত। মণি সিংহের বয়স যখন আড়াই বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। মা ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহাকুমার সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার বংশের মেয়ে। মণি সিংহের বয়স যখন ৭ বছর সেই সময় থেকে তাঁরা সুসং-দুর্গাপুরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই মণি সিংহ প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু ও শেষ করেন।
১৯১৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ব্রিটিশকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের সাথে যুক্ত হন। তারপর কমিউনিস্ট নেতা মণি সিং নেতৃত্ব দেন টংক আন্দোলন, পরবর্তীতে তেভাগা আন্দোলনের।পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত টানা ২০ বছর তাঁকে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়। এ সময় আইয়ুব সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।১৯২১ সালে মণি সিংহ মহাত্মা গান্ধীর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শরিক হন। ১৯২৫ সালে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হন। এসময় তিনি ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় আসেন। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেন। এজন্য ১৯৩০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাঁচ বছর পর ছাড়া পান, তবে আরো কিছুদিন অন্তরীণ হয়ে থাকতে হয়।
তিনি সুসংয়ে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। আবারো তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তবে গণ দাবির মুখে ১৯৩৭ সালে মুক্তি পান। ১৯৩৮ সালে মণি সিংহ আরো কয়েকজনের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। পার্টির সাংগঠনিক তৎপরতার ফলে সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলনে কৃষকেরা ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হয়। কৃষকদের এই আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হয়।১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবমুখী নীতি গ্রহণ করে। পার্টির নেতা ও কর্মীদের ব্যাপকহারে গ্রেপ্তার শুরু হয়। মণি সিংহ আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। তিনি পার্টি পুনর্গঠনের জন্য কাজ করতে থাকেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় অল্প কিছুদিন তিনি আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তান আমলের অনেকটা সময়ই তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হয়; এর মাঝেই কয়েকবার তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছে। তবে এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বামপন্থী সংগ্রাম ও গণআন্দোলন সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আর তারপরে ১৯৪৮ সালে হয় নাচোলের বিদ্রোহ।
৬৯ সালে জাতীয় অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে কমরেড মণি সিংহকেও গ্রেফতার করা হয়, ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর সকলের সাথে তিনিও মুক্তি পান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক, কুটনৈতিক সমর্থন ও সাহায্য সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের সময় মুজিব নগর সরকারকে পরামর্শ দেয়ার জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন মণি সিংহ। ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তিনি রাজশাহী জেলে বন্দী ছিলেন। এসময় তিনি জেল থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বামপন্থীদের সংগঠনে ও সমন্বয় সাধনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ দেয়ার জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন মণি সিংহ। এই পরিষদের অন্যান্য সদস্যের মাঝে ছিলেন মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। এ বছর ২৫ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারি হলে তিনি জুলাই মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার কমরেড মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সাহায্য-সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের অবদান ছিল অবিসংবাদিত। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
স্বাধীনতার পর কমরেড মণি সিংহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সোচ্চার হন। ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসের মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময় একদিন কমরেড মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে ছয় মাস অন্তরীণ রাখা হয়। সেই সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
তিনি ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন।১৯৯০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে প্রতি বছর তার মৃত্যু দিবসে নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুরে টঙ্ক স্মৃতি স্তম্ভ প্রাঙ্গণে সাতদিন ব্যাপী কমরেড মণি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
[সিরিজের শেষে তথ্যসূত্র দেয়া আছে]
২০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের জন্য কতকিছু দিয়ে যাচ্ছেন অকাতরে!!
পড়ে যাচ্ছি আর পড়ে যাচ্ছি।
মাহবুবুল আলম
হেলাল ভাই!
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভেচ্ছাজানবে।
জিসান শা ইকরাম
কমরেড মনিসিংহ তার কাজের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগনিত হয়ে গিয়েছেন।
তার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ধারাবাহিক ভাবে এমন পোস্ট দিয়ে সোনেলাকে সমৃদ্ধ করছেন আপনি। ধন্যবাদ ভাই।
শুভ কামনা।
মাহবুবুল আলম
জিসান ভাই বড়ই দুঃখের বিষয় মনি সিংহ এর মতো নেতাকে তার দলের নতুন প্রজন্মেরই অনেকে চিনে না!
শুভেচ্ছা জানাবে। ভাল থাকবে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
কৃতজ্ঞতা দাদা।
গুণীজন সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারছি।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ দাদা!
ভাল থাকবেন সব সময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ওনার সম্পর্কে আমার এতো কিছু জানা ছিলো না। আজ আপনার আন্তরিকতায় জানতে পারলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাইয়া। আপনার জ্ঞানের পরিসীমা অসীম। আমি চেষ্টা করলেও এর বিন্দু ছুঁতে পারবোনা। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন শুভ কামনা রইলো
মাহবুবুল আলম
প্রিয়সুহৃ! আপনাকে পাশে দেখলে ভীষণ ভাল লাগে। আপনার মূল্যবান মন্তব্যেে অনেক হৃদ্য হই।
শুভেচ্ছা জানবেন।ধন্যবা।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
একজন ভালো মানুষের প্রতিকৃতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ ভাই ।
মাহবুবুল আলম
পাশে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ চৌধুরী সাহেব!
শুভেচ্ছা জানবে।
তৌহিদ
কমরেড মনিসিংহ সম্পর্কে বলতেগেলে তেমন কিছুই জানতামনা যা আজ আপনার লেখার মাধ্যমে জানলাম। ধন্যবাদ আপনার অবশ্যই প্রাপ্য ভাই।
ভালো থাকুন সবসময়।
মাহবুবুল আলম
অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয়জন তৌহিদ ভাই!
শুভেচ্ছা জানাবে। ভাল থাকুন।
সুপায়ন বড়ুয়া
কিংবদন্তী তুল্য কমরেড মনিসিংহকে তুলে আনার জন্য
কৃতার্থ বন্ধু। সোনেলার পাঠকরা হই ধন্য
আপনি জাতীয় বীর দের নিয়ে লেখার জন্য।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
মাহবুবুল আলম
দাদা! অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন
সবসময।
হালিম নজরুল
এইসব লেখা নিয়ে আপনার একটা বই চাই।
মাহবুবুল আলম
নজরুল ভাই!
বই করার ইচ্ছা আছে। ধন্যবাদ পরামর্শের জন্য।
ধন্যবা। শুভেচ্ছা জানবে।
সাবিনা ইয়াসমিন
জানার মাঝে আনন্দ থাকে। স্বচ্ছ সত্য জানার মাঝে আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আপনার কষ্টার্জিত লেখাগুলো সার্থকতা পাক, শুভ কামনা রইলো। ভালো থাকুন প্রফেসর সাহেব। 🌹🌹
মাহবুবুল আলম
আমি আপনাকে যুগপৎ ভয় ও সন্মান এবং শ্রদ্ধা করি। বাপরে বাপ! যেভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মন্তব্য ও করে ছাড়েন।
হাহাহাহ। তবে বিরক্ত নই
উপভোগ করি, শত হোক প্রিয়দর্শিনী বলে কথা।
ইমোজিদেয়ার সুযোগ থাকলে দিতাম
একটু মজা করলাম! ধন্যবা।
মাহবুবুল আলম
আমি আপনাকে যুগপৎ ভয় ও সন্মান এবং শ্রদ্ধা করি। বাপরে বাপ! যেভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মন্তব্য ও লেখা আাদায় করে ছাড়েন।
হাহাহাহা। তবে এতে বিরক্ত নই
উপভোগ করি, শত হোক প্রিয়দর্শিনী বলে কথা।
ইমোজি দেয়ার সুযোগ থাকলে দিতাম
একটু মজা করলাম! ধন্যবাদ।
মাহবুবুল আলম
আমি আপনাকে যুগপৎ ভয় ও সন্মান এবং শ্রদ্ধা করি। বাপরে বাপ! যেভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মন্তব্য ও লেখা আাদায় করে ছাড়েন।
হাহাহাহা। তবে এতে বিরক্ত নই
উপভোগ করি, শত হোক প্রিয়দর্শিনী বলে কথা।
ইমোজি দেয়ার সুযোগ থাকলে দিতাম
একটু মজা করলাম! ধন্যবাদ।