সেকালঃ
মোহাচ্ছন্ন মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। পুরোহিত গন ভীষন ব্যাস্ত। শয্যা প্রস্তুত। কাঠের গুড়ির উপর শুয়ে আছে স্বামী। কাঠের গুড়ির মাঝে চন্দন কাঠও আছে। চন্দন কাঠ, ধুপ এর গন্ধ, ধোয়া, কাছা দেয়া ধুতি পরা খালি গায়ের মন্ত্রকের মুখের মন্ত্র, ব্যাস্ত সমস্ত চিতায় আগুন দেয়ার মানুষজনের উল্লাসিত পদক্ষেপ, চিতাকে ঘিয়ে দাঁড়ানো বড় সড় একটা ভিড়ের সার্কেল, নদী পারের শ্মশান ঘাটকে আলাদা পরিবেশ এনে দিয়েছে । সুষমাকে কয়েকজন ধরে নিয়ে আসছে । স্বামীর পাশেই যে শয্যা আজ তাঁর। ঘোরের মধ্যে থাকা অনিচ্ছুক সুষমা চলৎশক্তিহীন অবস্থায় এগিয়ে যাচ্ছে শয্যার দিকে । এটিই তাঁর স্বামীর সাথে জাগতিক শেষ শয্যা। জোড় করে শুইয়ে দিয়ে দড়ি দিয়ে হাত পা বাঁধা হয়েছে তাঁর। এরপর শুকনো কাঠে আগুন।
হরি হরি বোল, হরি বোল– দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সুষমার চিৎকার বাঁচাও বাঁচাও । মায়ের কান্না শুনে সুষমার পাঁচ বছরের মেয়ে চিৎকার করছে। কেউ সুষমাকে বাঁচাতে এলো না। কেন বাঁচাবে ? এটিই তো নিয়ম। হাত পায়ের দড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে পুড়ে যায়। অগ্নি দগ্ধ শরীর নিয়ে সুষমা লাফ দিয়ে নামে চিতা থেকে। দৌড়ে পালাচ্ছে । বেশী দূর যেতে পারেনা সুষমা। এত বড় বিদ্রোহ , এত বড় অনাচার ? মন্ত্র পড়া বাদ দিয়ে একজন পুরোহিত সুষমার দিকে ছুড়ে মারে পাথর। মাথায় আঘাত পেয়ে সুষমা পরে যায় মাটিতে। আগত ধর্মীয় রীতি রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ মানুষ পিটিয়ে অচেতন করে সুষমা। পিটিয়ে মেরে ফেলা যাবেনা, তাতে যে সহমরণ হবে না।
অচেতন সুষমাকে হাত পা ধরে তুলে নিয়ে এসে চিতায় নিক্ষেপ করা হলো। সতী মা কি জয় ধ্বনিতে আকাশ প্রকম্পিত । বংশ সম্প্রদায় এবং পরিবারের গর্ব হয়ে থাকে সে ‘সহমরণের একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে। নেপালের সুষমা তোমার অনিচ্ছায় তুমি পরিবারের অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইলে।
সুষমা, নিজেই নাকি ঝাঁপ দিয়ে স্বামীর চিতায় গিয়েছো। তুমি দেবী, তুমি নমস্য, তুমি বংশের মর্যাদা। তবে তোমার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি আমি একজন পুরুষ হয়ে।
একালঃ
জয় আপাত আধুনিক একজন মানুষ। বেশ স্মার্ট, শিক্ষিত, সঙ্গীত ভক্ত, গানও গায় বাসায় প্রাণ খুলে। হিমি জয়ের স্ত্রী। হিমির পরিচয়টা সমাজে এভাবেই। শুধু হিমির বাসায় এবং পরিচিত মহলে জয় এর পরিচয় হিমির স্বামী হিসেবে। অন্য সব স্থানে হিমি জয়ের স্ত্রী। হিমি মনে মনে রং দিয়ে ছবি আঁকে, গান গায়, কবিতা লেখে, আনমনে দক্ষিনা বারান্দায় বসে স্বপ্ন দেখে নীলাকাশ, টলটলে নদীর জল, সমুদ্র, পাহাড় হাতছানি দেয়। পাখি হয়ে আকাশে উড়ে । প্রকাশিত হতে চায় সে। ফুলের পাপড়ি যখনই প্রকাশিত তখনই বিপত্তি। আপাত আধুনিক জয় এর ভিতরের এসব গুন অনেক আগেই মৃত, সে তো চাইবেই হিমির এসব গুন তাঁর সাথে চিতার আগুনে জ্বলুক। মরে যাওয়া জয়ের সুকুমার বৃত্তির সাথে হিমির সুকুমার বৃত্তির সহমরণ হয় একসময়। মানুষ জানে হিমি খুব লক্ষ্মী একজন স্ত্রী, অনুকরণযোগ্য।
হিমি, তোমার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি আমি একজন পুরুষ হয়ে।
জয় হতে পারে এখানে পুরুষের সিম্বল, কখনো বাবা, কখনো স্বামী, কখনো ভাই। হিমি হতে পারে এখানে নারীর সিম্বল- কখনো মা, কখনো স্ত্রী, কখনো বোন।
নারী তোর মুক্তি নেই। হাজার বছর আগেও তুই জ্বলেছ, এখনো জ্বলছো। পার্থক্য শুধু চিতার আগুন আর পুরুষের আগুনের।
৩৯টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
জ্বলার জিনিস জ্বলুক।
নিভানোর জঝন কেউ নেই, তখন জ্বলতেই হবে।
একাল আর একাল
নাই নাই কেউ নাই।
জিসান শা ইকরাম
আমরাই তো জ্বালাচ্ছি। জ্বলতে বাধ্য করছি।
মোঃ মজিবর রহমান
কারণ আমরা নিরবাক। কেউ করছি,
কেউ সহযোগিতা করছি।
যে প্রতিবাদ করছে তাকে ধ্বংস করছি আমরাই।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সৃষ্টিতেই নারী পুরুষের পর….খুব ভাল ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন হিন্দু ধর্মাবলীর সমাধী সাথে নারীকে তুলে ধরেছেন নির্যাতীত।
জিসান শা ইকরাম
পুরুষ সব সময়ই নির্যাতনকারী, ধর্ম যাই হোক
অতীতে এবং বর্তমানে,
নির্যাতনের রূপ পাল্টেছে মাত্র।
সঞ্জয় কুমার
সতীদাহের মত কু প্রথা অনেক আগেই সনাতন ধর্ম থেকে সংষ্কারের মাধ্যমে বাদ দেয়া হয়েছে । আরও একটা মৃত্যু পরবর্তী প্রথা বাদ দেয়া দরকার সেটা নিয়ে বিস্তারিত লিখব । সামান্যতম বানান বিকৃতি করে ধর্ম কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায় । পুরাকালের পুরোহিত রা সেটাই করেছেন অত্যন্ত নিপুন ভাবে ।
জিসান শা ইকরাম
নারীদের উপর নির্যাতন তেমনই আছে,
তাঁদের ইচ্ছে, চিন্তাকে একই ভাবে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে
পার্থক্য শুধু পোড়ানোর পদ্বতিতে।
লিখুন, অপেক্ষায় থাকলাম।
বনলতা সেন
একালে মারতে চাই ,মরতে চাই না।
জিসান শা ইকরাম
চাইলে কাজ হপে ? আমরা তো আপনার চাওয়াকে চিতায় দিয়ে দিচ্ছি।
সীমান্ত উন্মাদ
মামা চমৎকার একটা বিষয়িক পোষ্ট। আর কেনজানি যুগের পর যুগ ঘৃন্য বাস্তবতা হয়ে আমাদের সমাজে ফিরে ফিরে আসে।
জিসান শা ইকরাম
আগুনের রূপ শুধু পাল্টেছে , আর কিছু না ।
খেয়ালী মেয়ে
কুসংকারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা থেকে আদৌ কি মুক্তি মিলেছে? কিংবা কখনো মুক্তি মিলবে?…
জিসান শা ইকরাম
এখন যে প্রজন্ম জীবিত আছে, তাঁরা থাকা অবস্থায় এ থেকে মুক্তি মিলবে না । এটাই বাস্তবতা ।
ছাইরাছ হেলাল
এখন তারাও পোড়াতে শিখে গেছে।
জিসান শা ইকরাম
খুবই সামান্য। ব্যতিক্রম। তেঁতুল হুজুররা থাকতে ভরসা নেই।
মেহেরী তাজ
এটা থেকে মুক্তির কোন উপায় আছে কি….?
হৃদয়ের স্পন্দন
হ্যা সম্মিলিত প্রচেষ্টা যদিও কষ্টসাধ্য
জিসান শা ইকরাম
উপায় আছে, তবে একদম যারা শিশু, তাঁদেরকে যদি সচেতন করা যায়, তাহলে সম্ভব। তবে সচেতন করার ইচ্ছে আপাতত নেই সমাজের।
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
ভালোই উদাহারন দিলেন। অভাগা নারীরা এখনো জ্বলন্ত চিতায়। তাঁদের ইচ্ছে গুলোকে চিতায় পুড়িয়ে দেয়া হয়।
হৃদয়ের স্পন্দন
সহমত
জিসান শা ইকরাম
‘ অভাগা নারীরা এখনো জ্বলন্ত চিতায়। তাঁদের ইচ্ছে গুলোকে চিতায় পুড়িয়ে দেয়া হয়। ‘ (y)
হৃদয়ের স্পন্দন
সত্যি আমি ক্ষমা চাচ্ছি একজন পুরুষ হয়ে, নারীরা আজো বন্দি, হয়তো সতিদাহ উচ্ছন্নে গেছে চোখের দেখায়, কিন্তু মনের কালিতে আজো যায়নি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, ভালো লিখেছেন, এমন লেখা আরো আশা করছি
জিসান শা ইকরাম
ইচ্ছে, স্বাধীনতা, অধীকার হত্যা তো একই কথা। আগুনের ভিন্ন রূপ। লিখতে চেষ্টা করবো।
রিমি রুম্মান
চিতার আগুনে জ্বলার (সহমরন) যুগ ফুরিয়েছে আরও আগেই, পুরুষের আগুনে জ্বলার যুগ ফুরাবে না হয়তো 🙁 🙁 🙁 🙁
জিসান শা ইকরাম
আপাতত কোন সম্ভাবনা নেই ……।
মরুভূমির জলদস্যু
আমর ধারণা পরিবেশ আর নিজেদের হীনমন্যতাই নারীদের এই যায়গায় ঠেলে দেয়।
জিসান শা ইকরাম
নারী নিজে নিজে বলীয়ান হয়ে কি করবে ?
শুন্য শুন্যালয়
মৃত্যুর আসলে অনেক রূপ। কি বিভত্স ছিলো মানুষ!!!! বর্ননাতে মন অবশ হয়ে আসে। সেই পৈশাচিকতা আর নেই তবু যেন রুপ পাল্টে রয়ে গেছে। নানু বাড়ি পাশের বাসায় এক হুজুর পরিবার। কেউ সে বাড়ির মেয়েদের দেখিনি। বাইরে যদি কোনদিন গিয়েছে শাড়ি দিয়ে সমস্ত রিকশা জড়িয়ে রাখা। এ কেমন বেঁচে থাকা কে জানে।
হিমির মৃত্যু টা মনের। এটা অনেক বেশি যন্ত্রনাদায়ক কারো কাছে। বেঁচে থাকা আর সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা এটুকুই পার্থক্য। আপনি ক্ষমা চাইছেন, কেউ এটা ভুল ই ভাবেনা।
লেখাটা বেশ ভালো হয়েছে। সীতার লেখাটার সিরিয়াল। এমন লেখা বন্ধ দেখতে চাইনা।
জিসান শা ইকরাম
এমন মন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ এখনো আছে, যাদের বাড়ীর মেয়েরা বাইরে বের হননা ?
অবাক হলাম।
মন নিয়ে বেঁচে থাকা, আর মন হীন বেঁচে থাকার মাঝে অনেক ব্যবধান।
একটি জীবন, অন্যটি মৃত্যুর সমান।
সীতার লেখাটার সিরিয়াল হতে পারে এটি, মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে।
ব্লগার সজীব
শারীরিক মৃত্যুর চেয়ে ইচ্ছের মৃত্যু তো আরো কষ্টের। শরীর পুড়ে গিয়ে একবারেও সব শেষ। আর ইচ্ছে পোড়ানোর আগূন জ্বলন্ত থাকে আজীবন। +++++
জিসান শা ইকরাম
আমরা তো সেভাবেই পোড়াচ্ছি এখন।
মিথুন
ভাইয়া প্রথম ফটোটা কি সত্যি ? ফটো দেখে আঁতকে উঠলাম। সেকাল আর একালের মিলটা ভালোভাবেই দেখাতে পেরেছেন। এমন লেখা আরো চাই।
জিসান শা ইকরাম
ওটা নেট থেকে নেয়া। প্রথম ঘটনাটি সত্যি। দেবো ।
লীলাবতী
নারীদের মুক্তি নেই আসলে। সেকালে একালে ভবিষ্যতেও এমনই থাকবে। সময় পালটাবে, নির্যাতনের ধরন পাল্টাবে শুধু। ভালো লেগেছে ভাইয়া। আরো লিখুন এমন।
জিসান শা ইকরাম
সত্যি বলেছেন। লেখার ইচ্ছে আছে।
নুসরাত মৌরিন
জিসান ভাই,খুব দারুন ভাবে লিখেছেন,আসলেই সেকাল আর একালে খুব একটা পার্থক্য কিন্তু নেই।একালেও নারীকে তার সবটুকু স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে হয়।আগে হয়ত শুধু অনলে হাড়-মাংস পুড়তো,এখন যে আত্মাকেই কখনো কখনো চিতায় তুলতে হয়…।
জিসান শা ইকরাম
শরীরকে কিছুক্ষনের মধ্যে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়া হতো
আর এখন নারীর আত্মাকে, ইচ্ছে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, যা আরো কষ্টকর।
আমৃত্যু নারী এই দগ্ধ হবার যন্ত্রনা বয়ে বেড়ায়।
নওশিন মিশু
নারীদের ভাল থাকতে নেই,
তাহলে যে বুদ্ধের ধ্যানও ভেঙ্গে যাবে ….!!!
হে পুরুষ, ভাল থাক তোমরা খুব ভাল …….. 🙂
জিসান শা ইকরাম
সেকালে পুড়িয়েছি নারীদের
এখনো পোড়াচ্ছি আমরা।
এ থেকে মনে হয় বের হয়ে আসতে পারবোনা কোনোদিন।
আপাতত কোন লক্ষন দেখছিনা।