টিকেট কেটে বাসের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। রাত তখন প্রায় ৮টা। গুলিস্তান হতে নারায়ণগঞ্জ যাবো। এই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বাস রয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি এসি বাসের অপেক্ষায়। যদিও শীতকাল চলছে। প্রতিটি কাউন্টারের সামনে বিশাল লাইন। আমি যথারীতি টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ঠিক পেছনেই এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। বয়সটা আনুমানিক ৫০/৫৫ হবে। লাইনে দাঁড়িয়েই তার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো। আমাদের সামনে যে পরিমাণ যাত্রী তাতে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটি পরিপূর্ণ হয়ে অবশিষ্ট যাত্রীকে অপেক্ষা করতে হবে পরের বাস এর জন্য। পেছনের লোকটি একবার বলে উঠলো “বাপরে যে বড় লাইন তাতে এই বাসে আমাদের জায়গা হবে না”। আমি পিছনে ঘুরে ওনার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিলাম। ওনাকে বুঝালাম আমিও তার মতই একজন অপেক্ষমান যাত্রী। এরপর উনি বললেন, “দেখবেন ১০ টার আগে বাস আসবে না”। আমি চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ পর আবারও কথাটি পুনরাবৃত্তি করলেন। “১০ টার আগে বাস আসবে না”। আমি এবারও চুপ। মাত্র আটটা বাজে। ২ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ওনার অস্থিরতা একটু বেশই মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অন্য কোম্পানির বাস আসলো। এবার পিছনের লোকটি বলল, “অন্য বাস আইসা গেলো আর আমাদের বাসের খবর নাই। বললাম না আমাদের বাস রাত ১০ টার আগে আসবে না”। আমি তখন মুখ খুললাম। বললাম, “আপনি কি সিউর যে ১০ টার আগে বাস আসবে না?” লোকটি আমার দিকে চোখ ছোট করে তাকালেন। বললেন, “আমার তো তাই মনে হচ্ছে”। এরপর আমি ওনাকে বললাম, “দশটার আগে যেহেতু বাস আসবে না সেহেতু আপনি এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে অন্য বাসে গেলেও তো পারেন”। লোকটি আমার কথা শুনে এবার চুপ হয়ে গেলেন। আমিও আমার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ লাইনের পাশ দিয়ে এক হকার “এই পানি-চিপ্স, এই পানি-চিপ্স” বলতে বলতে যাচ্ছিল। পেছনের লোকটি এবার হকারকে ডেকে বললেন,
-“ড্রিংকস আছে ড্রিংকস?”
-“জি আছে। আলু চিপ্স আছে”। লোকটি এবার রাগান্বিত হয়ে বললেন,
-“তোরে জিগাইছি ড্রিংকস আছে কিনা আর তুই কস চিপ্স। যা ব্যাটা”।
-“পানি আছে, দিমু?”
-“কোক পেপসি নাই?”
-“না নাই”।
-“না থাকলে সামনে থিকা সর”।
আমি এতক্ষণ হকার আর লোকটির কথোপকথন শুনছিলাম আর মনে মনে হাসছিলাম। লোকটি পেছন থেকে আবারও বলে উঠলেন, “নাহ দশটার আগে বাস পামু না”। বারবার লোকটির মুখে একই কথা শুনে এবার একটু বিরক্ত হলাম। সময় কাটানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেইসবুকের নোটিফিকেশন দেখছি। এদিকে পিছনের লোকটা বিড়বিড় করে বকবক করেই যাচ্ছেন। নোটিফিকেশন দেখতে দেখতে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি আরও একটি হকার আমাদের দিকেই আসছে। পেছনের লোকটি এবার হাঁক ছেড়ে ডাকলেন-
-“তোর কাছে ড্রিংকস আছে”।
-“মিনারেল ওয়াটার আছে ছার। দিমু?”
-“আচ্ছা তোরা কি ড্রিংকস ফ্রিংস চিনস না? কইলাম ড্রিংকস এর কথা আর তুই কস পানির কথা”।
-“ছার পানিরেও তো ড্রিংকস বলা যায়”।
-“মিষ্টি কোনও পানি নাই? কোনও এনার্জি ড্রিংকস নাই তোর কাছে?”
-“খালি মাম পানি আছে”।
-“আচ্ছা দে। মিঠা পানি তো নাকি?
-“ছার এই পানিতে ঝাল, টক, তিতা, নোনতা নাই এইডা সিউর”।
লোকটি পানি পান শেষে বোতলটি ছুড়ে ফেললো ফুটপাতের পাশে। এক পথচারীর গায়ে অল্পের জন্য লাগলো না।
-“কি মিয়া এম্নে কেউ বোতল ফালায়?
-“সরি ভাই খেয়াল করি নাই”।
-“খেয়াল করলে বোতল কি আমার মাথার উপর মারতেন? আজাইরা পাবলিক দিয়া ভইরা গেছে দেশটা”।
আমি পেছনে ঘুরে লোকটার দিকে তাকালাম। দেখলাম লোকটি সেই পথচারীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি সামনের দিকে ঘুরতেই লোকটা জিজ্ঞাসা করলো,
-“ভাই কোথায় যাবেন?”
-“একজনের বাড়ি যাবো”।
-“কার বাড়ি ভাই?”
-“আমার বাড়ি”।
-“দেখসেন কতক্ষণ ধইরা দাঁড়াইয়া আছি বাসের কোনও খবর নাই। এইবার আমি সিউর ১০ টার আগে বাস আসবে না”।
কথোপকথন শেষ হতে না হতেই আমাদের রুটের বাসের সন্ধান মিলল। যাক দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টের অবসান হবে এবার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ০৮:২২ বাজে। পিছনের লোকটি চুপচাপ আছেন। লোকটিকে বললাম-“বাস কিন্তু ১০ টার আগেই আসলো”। লোকটি কোনও জবাব দিলেন না। পকেটে রাখা টিকেটটি বের করে সামনে দিকে আগাচ্ছি বাসে উঠবো বলে। লোকটিও আমার পেছন পেছন আসছে। সুপারভাইজার আমার টিকেটটি চেক করল। আমি বাসে উঠলাম।
-“আপনি টিকেট ছাড়া তো যাইতে পারবেন না। টিকেট কাইটা আসেন”।
-“আরে মিয়া আমারে আগে উঠতে দাও। টিকেট তুমি কাইটা দিও”।
বাসে উঠেই পিছনে ঘুরে দেখি ঐ লোকটাকে বাসে উঠতে দিচ্ছে না সুপারভাইজার। টিকেট কাটা হয়নি তার। এবার আমি হাসি মুখে লোকটিকে বললাম, “ভাই আপনার বাস ১০ টার আগে আসবে না”। লোকটি কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। ততক্ষণে অন্যান্য যাত্রীরা বাসে উঠা শুরু করেছে। আমি লোকটিকে একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে আমার আসনে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিল। বাস চলছে গুলিস্তান ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে। আমার কানে ভাসতে থাকল, “১০টার আগে বাস আসবে না”।
৩১টি মন্তব্য
অন্বেষা চৌধুরী
হা হা হা হা হা
বেচারা থাক এখন। রাত দশটার বাসের অপেক্ষায়।
দারুণ লিখেছেন রম্য রচনা।
রুমন আশরাফ
অনেক ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইলো।
ত্রিস্তান
পরে কি ঐ ভদ্রলোক উঠতে পেরেছিলেন?
রুমন আশরাফ
হয়তো পরের কোনও বাসে।
ফয়জুল মহী
চমৎকার , পাঠে মুগ্ধতা রেখে গেলাম।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ ভাই। ভাল থাকবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হা হা হা । ভালোই পারেন আপনি। ভালো থাকুন শুভ কামনা রইলো
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ। আপনিও ভাল থাকুন।
মনির হোসেন মমি
হা হা হা ১০ টার আগে বাস আসবে না।চলমান রাস্তাঘাটে সাধারণত এরকম লোকের অভাব নেই। আর হকাগো কতাতো ঐ ওর যা আছে তা আগে বলবে। চমৎকার।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ প্রিয় বড় ভাই।
কামাল উদ্দিন
তাড়াহুড়া করে লোকটার মনে হয় টিকেট কাটতেই মনে ছিল না।
রুমন আশরাফ
হয়তো। ভীষণ তাড়াহুড়ো ছিল ওনার।
কামাল উদ্দিন
হুমম, ভীষণ তাড়া
জিসান শা ইকরাম
হা হা হা , চলতি পথে এমন দু একজন লোকের দেখা মেলেই। এরা সব কিছুতে আতেলামি দেখাতে গিয়ে নিজেরাই ফেসে যায়।
রুমন আশরাফ
হা হা হা। ঠিক বলেছেন ভাই।
তৌহিদ
লেখাটি পড়েছি আগেই। আশ্চর্য লোক সে, টিকেট না কেটেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে অপেক্ষারত আপনি চারিদিক পর্যবেক্ষণ করেছেন বেশ উপভোগ্যভাবেই।
ভালো থাকবেন ভাই।
রুমন আশরাফ
আপনিও ভাল থাকবেন ভাইয়া।
রেহানা বীথি
কিছু মানুষকে দেখি টিকেট না কেটে বাসে ওঠার জন্য সুপারভাইজারের সাথে অকারণেই ঝামেলা বাধায়। এরা বোধহয় ঝামেলা পছন্দ করে। যাইহোক, লেখা ভালো লেগেছে।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ আপু।
অন্বেষা চৌধুরী
হা হা হা হা
নে বেটা থাক রাত দশটার বাসের অপেক্ষায়
দারুণ লিখেছেন ।
রুমন আশরাফ
হা হা হা
ধন্যবাদ ভাই।
অন্বেষা চৌধুরী
হা হা হা হা হা
নে বেটা রাত দশটার বাসের অপেক্ষায় থাক
দারুণ লিখেছেন
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
নৃ মাসুদ রানা
গল্পটা ফেসবুকে পড়েছি। সত্যি! অসাধারণ।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ মাসুদ ভাই।
মোহাম্মদ দিদার
যা লিখলেন ভাই।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ ভাই। শুভ কামনা রইলো।
সুরাইয়া পারভীন
হা হা হা হা হা হা
বেচারা পথচারী
খুব ইচ্ছে ১০টার বাসে ঘরে ফিরবে।
অবশেষে ইচ্ছে পূরণ হলো বলুন😛😛
রুমন আশরাফ
হা হা হা
এস.জেড বাবু
হাহাহা
এতোটা অস্থির যে টিকিট কাটতেই ভুলে গেল। সে দশটা পর্যন্ত থাক।
ভালো লেগেছে
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ বাবু ভাই।