ইতিহাসখ্যাত অসাধারন এক বস্ত্রশিল্পের নাম “মসলিন” । এই মসলিনকে নিয়ে রয়েছে হাজারো কাহিনী আর গল্প গাঁথা। সেই সাথে মসলিনের প্রতিটি পরোতে পরোতে মিশে আছে বাঙালি তাঁতিদের নৈপুণ্যতা, পারদর্শিতা আর গর্বের ইতিহাস। ঠিক তেমনি ভাবে আবার এই মসলিনকে ঘিরেই রয়েছে এক হৃদয় বিদারক কাহিনী। সেকালে যেসব তাঁতিরা মসলিন তৈরি করতেন সেসব তাঁতিদের প্রতি অত্যাচারের কাহিনী, আঙুল কেটে ফেলার ইতিহাস- এসব আমাদের সবারই কম বেশি জানা।
বেশ কিছুদিন ধরেই চিন্তা করছিলাম বাঙালির অন্যতম গৌরবের জিনিস এই “মসলিন” নিয়ে লিখবো কয়েকটা লাইন। আর সেই ইচ্ছের প্রতিফলনই হল এই লেখাটি।
কিভাবে উদ্ভব “মসলিন” শব্দটিরঃ-
হেনরি ইউল এর প্রকাশিত অভিধান হবসন জবসন থেকে জানা যায় যে- মসলিন শব্দের উদ্ভব ‘মসূল’ থেকে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে-
The Muslin was famous for fine cotton textures. Sense as our word, quoting the Arabian Nights (Macnaghten’s ed., i. 176, and ii. 159), in both of which the word indicates the material of a fine turban. [Burton (i. 211) translates ‘Mosul stuff,’ and says it may mean either of ‘Mosul fashion,’ or muslin.] The quotation from Ives, as well as that from Marco Polo, seems to apply to a different texture from what we call muslin. 1298. — “All the cloths of gold and silk that are called Mosolins are made in this country (Mausul).” – Marco Polo, Bk. i.
ইরাকের এককালের নামি ব্যবসা কেন্দ্র মসূলে তৈরি হত সূক্ষ্ম সব কাপড় । যতদূর জানা যায়, ইংরেজরা আমাদের এই সূক্ষ্ম কাপড়কে নামকরণ করে মসলিন হিসেবে । এই ‘মসূল’ এবং ‘সূক্ষ্ম কাপড়’ -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় ‘মসলিন’। অবশ্য বাংলার ইতিহাসে ‘মসলিন’ বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একপ্রকার কাপড়কে।
আবার অনেকে বলে থাকে যে- যে উত্তর ভারতীয় বন্দর শহর মসলিপাটনাম থেকে প্রাচীন গ্রীসের বনিকরা কিনে নিয়ে যেত,ঐ শহরকে Maisolos নামেও ডাকা হত।অনেকে ধারন করেন Maisolos মসলিন শব্দটি এসেছে। আবার অনেকে ধারনা করেন মসলিন কাপড় বিক্রির জন্য প্রশিদ্ধ হওয়ায় ঐ স্থানের নাম মসলিনের নামে করা হয়েছে। বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কোপোলো এই অঞ্ছলে মসলিন কাপড়ের কথা বলেছেন। নামের উৎপত্তি নিয়ে যতোই মতভেদ থাকুক না কেন মসলিনের উৎপত্তিস্থল কিন্তু এই বাংলাতেই।
এবার মসলিনের জন্ম থেকে বিলুপ্তির ইতিহাসে আসা যাকঃ-
বহু প্রাচীনকাল থেকে এই দেশের তাতীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উত্তম কার্পাস থেকে মিহি তন্তু উত্পাদন করে সুতিবস্ত্র বয়ন করে আসছেন। এর মধ্যে মসলিন বস্ত্র তার সূক্ষ্মতা ও নান্দনিকতায় বিশ্বের বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। অনেক বরেণ্য ব্যক্তিরা লিখেছেন, ঈসা নবীর জন্মের প্রথম শতাব্দীকাল থেকেই বঙ্গদেশে বয়নশিল্প গড়ে উঠেছিল। বংশপরম্পরায় অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই শিল্প দ্রুত উত্কর্ষ লাভ করে। প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে । সম্রাট, নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথমভাগেও সেখানে একাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় একশ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর- ওখানে জন্মাতো উচুঁমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে দু’শ বছর আগেও বিদেশী বণিকেরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রপ্তানী করতো। ওখানকার প্রায় দেড়হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করতো ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে যখন মসলিনের উপর একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ তখন পড়তির দিকে; অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনও সাতশ’ ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এই কাজে।
লস এঞ্জেলেস কাউন্টি মিউজিয়াম অব আর্টে প্রদর্শিত আনুমানিক ১৮৫৫ সালে ইউরোপীয় নারীর জন্যে মসলিনের তৈরী পোষাক
মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা, ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে। একদম ভাল মানের কার্পাস উৎপন্ন হত মেঘনার পশ্চিম তীরে। শ্রীরামপুর, কেদারাপুর, বিক্রমপুর, রাজনগর ইত্যাদি স্থানগুলো ফুটি কার্পাসের জন্য বিখ্যাত ছিল। আজকের যে কাপাসিয়া নামটি আমরা জানি তা এসেছে এই কারপাস হতে। মেঘনা এমনিতেই খুব বড় নদী, তার উপর সমুদ্রের কাছাকাছি আবার বর্ষাকালে নদীর দু’কূল ভেসে যেত। তার ফলে যে পলি জমতো তার কারনেই ফুটি কার্পাসের উৎপাদন খুব ভাল হতো এসব স্থানগুলোতে। কিন্তু একজন কার্পাস চাষী একবিঘা জমিতে ভালমানের মসলিন তৈরির জন্য মাত্র ছয় কেজির মতো তুলা পেত। তাই মসলিনের চাহিদা যখন খুব বেড়ে গেল, সেই সময় ভারতের গুজরাট হতেও তুলা আমদানি করা হতো- কিন্তু ওগুলো দিয়ে ভালমানের মসলিন তৈরি করা যেত না- যা হতো তা খুব সাধারন মানের হতো।
সাধারনত, মহিলারাই সুতা কাঁটা আর সূক্ষ্ম সুতা তোলার মত পরিশ্রম এবং ধৈর্যের কাজে নিয়োজিত ছিল। সুতা তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকালের পরে এ কাজ করা হতো। মজার ব্যাপার হলো- আর্দ্রতার খোঁজে অনেক সময় এমনকি নদীতে নৌকার ওপর বসে সুতা কাটার কাজ চলত। একজন মহিলা এভাবে প্রতিদিন সুতা কেটেও মাসে মাত্র আধা তোলা সুতা তুলতে পারতেন। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজের কারণে দক্ষ সুতা কাটুনির সংখ্যা অনেক কমে আসতে থাকে উনিশ শতকের শুরু থেকেই। জানা গিয়েছে- এই রকম সূক্ষ্ম সুতা কাটার কাজ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও এতোটা ভাল হতো না । এর কারণ ধরা হয় দু’টো- ঢাকার ফুটি কার্পাস আর শ্রমিকের দক্ষতা ও পরিশ্রম।
বিভিন্ন সুত্র হতে যা জানা যায়- ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ঢাকা হতে কিছু মসলিন পাঠানো হয়। সেখানে এক পাউন্ড সুতা দেখানো হয়েছিলো যা প্রায় আড়াইশো মাইল ছিল !! আরও মসলিন সম্বন্ধে, “মর্নিং ক্রনিকল” পত্রিকায় লিখা হয়- হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখন্ড মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স !!
আজ এইপর্যন্তই। পরবর্তী পর্বে মসলিন তৈরীর প্রক্রিয়া এবং আরো কিছু আনুসাঙ্গিক বিষয় বর্ননা করবো।
সেইসাথে সবাইকে রইলো নতুন বছরের শুভেচ্ছা -{@
২১টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
মসলিন সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।
একপাউন্ড মসলিনের সুতা ২৫০ মেইল দীর্ঘ
দশ গজ মসলিন কাপড়ের ওজন মাত্র ৩ আউন্স এসব ভাবাই যায় না।
লিখুন আরো।
শুভ নববর্ষ।
ফাতেমা জোহরা
আমি খুবই দুঃখিত এতো দেরীতে মন্তব্যের উত্তর দেবার জন্য 🙁 ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। নববর্ষের আমেজ এখনো যায় নি আমার, তাই শুভ নববর্ষ 😀
নুসরাত মৌরিন
বাংলার হাজারো বছরের ঐতিহ্য মসলিন সম্পর্কে জেনে ভাল লাগছে।
নববর্ষের শুভেচ্ছা।শুভ হোক আগামী দিনগুলো।
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ আপু 🙂 নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো 🙂
লীলাবতী
গত রাতেই পড়েছি পোষ্ট।এতকিছু জানতাম না পূর্বে।আপনার পোষ্ট মানেই তথ্যে পরিপুর্ন এক পোষ্ট। ধন্যবাদ আপু।
শুভ নববর্ষ 🙂
ফাতেমা জোহরা
দেরীতে হলেও নববর্ষের শুভেচ্ছা নিন। আমরা আমরাই তো 🙂
শুন্য শুন্যালয়
মসলিন সম্পর্কে ছোটবেলা পাঠ্যবইয়ে যেটুকু পড়েছিলাম জ্ঞান বলতে ওইটুকুই। অনেক কিছু জানলাম আপনার লেখা পড়ে। বাংলার গর্ব এটি।
বাংলা নববর্ষে বাংলার অহংকার নিয়ে লিখলেন,ধন্যবাদ জানুন। শুভ নববর্ষ।
ফাতেমা জোহরা
আসলেই অহংকার আমাদের মসলিন। আমার খুব সৌভাগ্য হয়েছে যে সেগুনবাগিচায় জাদুঘরে গ্লাসবন্দী একটুকরো মসলিন দেখার 🙂 যদিও ধরে দেখার সুযোগ হয়নি 🙁
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
দারুন পোষ্ট।হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে খুজে ফিরি।
ফাতেমা জোহরা
হ্যাঁ আসলেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে খুজে ফিরি অবিরত।
কৃন্তনিকা
আপনাকেও শুভ নববর্ষ 🙂
অনেক কিছু জানলাম, পরের পোস্টের অপেক্ষায় রইলাম।
ফাতেমা জোহরা
হ্যাঁ আজকেই প্রকাশ করবো পর্বটি। ধন্যবাদ আপু 🙂
ছাইরাছ হেলাল
অপেক্ষা করব পরের পর্বের জন্য।
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ এমন পোষ্টের জন্য।
ফাতেমা জোহরা
আপনাকেও ধন্যবাদ আপু লেখাটা পড়বার জন্য 🙂
হিলিয়াম এইচ ই
পরের পর্ব চাই
ফাতেমা জোহরা
অবশ্যই দিবো 🙂
মরুভূমির জলদস্যু
আমাদের গৌরবের জিনিস গুলি একে একে সবই হারিয়ে গেলো।
ফাতেমা জোহরা
ঠিক বলেছেন 🙁
খেয়ালী মেয়ে
অনেক কিছু জানলাম, যা আগে জানতাম না–পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম…
শুভ হোক নববর্ষ…