বেনীমাধব…

রিমঝিম বর্ষা ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, সোমবার, ১২:২৪:০৪অপরাহ্ন বিবিধ ৬ মন্তব্য

 

বেনীমাধব বেনীমাধব তোমার বাড়ি যাব
বেনীমাধব তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?

২৩শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় আমি আর হাসান বেশ ঘুরাঘুরি করে রাত ১১টায় বাসায় ফিরলাম। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসতেই হাসান বললো “আমার মনে হয় আমাদের একসাথে থাকার সময় শেষ হয়ে এসছে।“ আমি স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম ওর দিকে। আমার আপ্রান চেষ্টা ছিলো সেই দৃষ্টি যেন পুরোপুরি নিস্প্রান থাকে। আমার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হোল কিনা বোঝার আগেই দেখলাম হাসান পায়ের কাছের বিশাল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলোয় ফর্সা আকাশ তার মায়াবী আলোয় আমাদের নিওন রঙ্গের ঘরটাকে ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। হাসানকেও রহস্যময় লাগছে। আমার এক পলকের জন্য মনে হোল ও দুষ্টুমী করছে। করতেই পারে। আজ রাতটা তেমনি একটা রাত। এই রাতে আমরা একে অপরকে নানা ভাবে মুগ্ধ করার চেষ্টা করি। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি নিরুচ্চারে। গত চারটা বছরের এই সময়টাতে আমরা এমনটাই করে এসেছি। আগামীকালের চাইতে আজকের রাতটাই আমাদের দুজনের কাছে শ্রেষ্ঠ সময়। আমরা দুজন এক হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আজকের রাতটায়। আগামীকাল আমাদের বিয়ে বার্ষিকী।

– তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আমরা এক হয়েছিলাম কোন একসময় আলাদা হবো জেনেই।

স্বগতোক্তির মত করে হাসান বলে। আমি বোধহয় একটু কেঁপে উঠি। হাসান এর ভীষণ প্রিয় আমার ঠোঁটদুটিতে কথা বলার মত কোন শব্দ খুঁজে পাইনা তখনও।

– চলো শুয়ে পরি।

আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে হাসান আমার পরিবর্তে কোলবালিশটাকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পরে। ঘুমিয়েও পরে হয়তো। আর আমি অনভ্যাসের প্রথম রাতটি নির্ঘুম কাটিয়ে বোঝার বয়সের এই প্রথম ভোরের আলো গায়ে মাখা থেকে বঞ্চিত হই।

ঘুম ভাঙ্গে মুনিয়া-র ডাকে। যারা লোকের বাড়িতে ঝি-গিরি করে জীবনযাপন করে তাদেরও যে এত সুন্দর নাম থাকে আমি জেনেছিলাম মুনিয়া-কে চেনার পর থেকে। মুনিয়া সপ্তাহের দুটি ছুটির দিনের পুরো দিন আমার এখানে কাটায়। আমিও যেহেতু চাকরী করি তাই অন্যান্য দিনগুলোর সকাল বা সন্ধ্যা’র অল্প সময়টুকুর একটুও তুতীয় কারো দ্বারা মাতিয়ে রাখা আমার বা হাসানের কারোই পছন্দ ছিলোনা। ঘুম ভেঙ্গে প্রথমেই ভাবলাম মুনিয়া ঢুকলো কি করে। আজ ছুটির দিন। হাসান এর তো ঘুম থেকে ওঠার কথা না দুপুরের আগে। হাসান এর কথা মনে হোতেই গত রাতটা এক লাফে মনের দরজায় হাজির হোল। হৃতপিন্ডটা কি বড্ড বেশি জোড়ে স্পন্দিত হচ্ছে! আমি বিছানা থেকে নামলাম। তার আগে বিছানায় হাসান এর জায়গাটায় একবার তাকালাম। তাকালাম ওর পাশের সাইড টেবিলটার দিকে। আমি কি আশা করছিলাম যে ও কোন চিঠি লিখে রেখে যাবে? চিঠির পুরো পাতা জুড়ে থাকবে হাসান এর প্রিয় দুটি লাইন…..

“প্রগাঢ় অন্যায় কোন ঘটে গেছে মনে হয় যেন
কিছু কি দেবার কথা কিছু কি করার কথা ছিলো?”

কাল রাতে অত স্পষ্ট কথার পরে ওর চিঠি লিখে রেখে যাওয়ার কোন কারণ থাকতে পারেনা। মুনিয়া-কে চা দিতে বলি। মেয়েটা চমৎকার চা বানায়।

মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে বাজিয়েছিলে
আমি তখন মালতী স্কুলে;
ডেস্কে বসে অংক করি ছোট্র ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমনির পাশে দিদিমনির বর।
আমি তখন নবম শ্রেনী আমি তখন শাড়ি
আলাপ হোল বেনীমাধব সুলেখাদির বাড়ি।

দীপার গায়ে হলুদে কাঁঠাল চাপা রঙ্গের শাড়ির সাথে বকুল ফুলের গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে যখন আমি হাজির হোলাম তখন দীপা চোখ রাঙ্গিয়ে আমাকে বললো বরপক্ষ নাকি আমাকে দেখলেই এই বিয়ে নাকচ করে দেবে যেকোন অযুহাতে। আমি কপট রাগে ওকে ধমকালাম। দীপা হাতে গোনা সুন্দরীদের মধ্যে একজন। যেকোন পুরুষ তো বটেই, অনেক মেয়েও ওর প্রেমে পরে যায়। বন্ধু হোতে চায় ওর। সুন্দরী হোলেই যেন অহংকারী হোতেই হয়। দীপাও তার ব্যতিক্রম না মোটেও। কেমন কেমন করে এই অহংকারী মেয়েটিই আমার মত সাদামাটা মেয়ের প্রানের বন্ধু হয়ে গেল। প্রানের বন্ধু এবং একমাত্র বন্ধু। বরপক্ষ আসার সাথে সাথেই জমে উঠলো পুরো বাড়ি বিয়ের উৎসবে। হঠাৎ রুচিরা চেঁচিয়ে উঠলো ওর আহ্লাদী কন্ঠে “হাসান ভাই, প্লিজ একটা কবিতা শোনান।“ আজ যেন সব ভালো লাগার দিন। দীপার এই ন্যাকা বোন রুচিরার ভীষণ বিরক্তিকর এই আহ্লাদীপনাটাও যেন আজ না হলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটাই জমতোনা। সাদার উপর সাদা কারচুপি কাজ করা হাফ সিল্কের পাঞ্জাবী আর চুড়িদার পরা এক যুবক যেন মাটি ফুঁড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। পুরো হলরুমটাকে নিঃশব্দে ভাসিয়ে সে আবৃত্তি করে গেল আমার প্রিয় কবি রাজলক্ষী দেবীর একটি কবিতা ……

“জানি আমি একদিন বুড়ো হবো। চশমার ফাঁকে
উলের কাঁটার ঘর গুনে গুনে কাটবে সময়।
যদিও অনেক লোক আসে, যায় – দুটো কথা কয় –
মনে মনে জানা রবে, কেউ তারা খোঁজেনা আমাকে।
এমনি মেহগ্নি আলো বিকেলের জানালাকে ছোঁবে।
নরম চাঁদের বল ফের উঠে আসবে আকাশে।
বাতাস সাঁতার দেবে সবুজ ঢেউয়েরই মত ঘাসে।
আকাশের বুক ভরে তারারা বিছানা পেতে শোবে।
শাদা চুল নেড়া দাঁত, আয়নায় ভ্যাংচানো ছায়াকে
তখনো বলবো আমি রাজচ্যুত রাজ্ঞীদের ভাষা।
-জানিস, আমার ছিলো সে এক আশ্চর্য ভালোবাসা।
তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবে সে পাওয়াকে?-“

বেনীমাধব বেনীমাধব লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে আমার রং কালো
তোমায় দেখে এক দৌঁড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেনীমাধব আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু ফুটেছে মঞ্জুরী
সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসে অংকে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেনী আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে বেনীমাধব লুকিয়ে দেখা হোল।

দীপার কাছেই জানলাম হাসান অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়ে এসেছে শুধুমাত্র দীপার বিয়েটা এ্যাটেন্ড করবে বলে। ভীষণ মেধাবী হাসান আবৃত্তি করে অসাধারণ। আবৃত্তি কেমন করে সেটা আর কারো কাছ থেকে শোনার প্রয়োজন পরেনা। হলুদের স্টেজ ছেড়ে বাইরের লন এ এসে দাঁড়ালাম। এরকম একটা আবৃত্তি শোনার পর ওই হট্রগোলের মধ্যে আমার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিলো। বাইরে বৃষ্টির পরের বয়ে যাওয়া বাতাসের শীতলতা। চোখ বন্ধ করে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিলাম। হাসান এর কন্ঠ আমার সর্বাঙ্গে শিরশির করছে। “হইচই পছন্দ না?” আমি চোখ না খুলেও বুঝতে পারি হাসান পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ খুলেও তাকাতে পারিনা ওর দিকে। তাকাই ওর উল্টোদিকে….আমার ডানপাশে। যেখানে অর্কিডের ঝাড়। যার পাশে একটা দোলনা ঝুলছে। আমি একটুও অস্থিরতা অনুভব করিনা। ভীষণ শান্তভাবেই টের পাই আমি হাসান-কে ভালোবেসে ফেলেছি। জীবনের বাকী স্টেপগুলো ওকে ছাড়া চালিয়ে নেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। যেকোনকিছু বাজি রেখে আমি ওকে পেতে চাই।

বেনীমাধব বেনীমাধব এতদিনের পরে
সত্যি বলো সেসব কথা এখনো মনে পড়ে!
সেসব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে অপূর্ব সে আলো
শিকার করি দুজনকেই মানিয়েছিলো ভালো;
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম ওদের ভালো হোক।

দীপা সব শুনে আমাকে বলেছিলো “হাসান-কে ভালোবাসা যায়, বিয়ে করা যায়না।“ আমার তখন অতশত ভাবার মত অবস্থা নেই। থাকলে হয়তো টের পেতাম দীপার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। আমি তখন যদি আমাকেই হারিয়ে না বসতাম তাহলে হয়তো দেখতে ভুল হোতনা প্রিয় বান্ধবীর চোখের মণিতেই বসতি গেড়েছিলো হাসান। বিয়ের পর দীপা ওর বরের সঙ্গে স্টেটসে চলে যায়। প্রথম প্রথম ফোনে যোগাযোগ ছিলো। সেটাও কমে যোগাযোগটা কেবল আমার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের উপরে দীপার দেয়া ফটোফ্রেমেই বন্দী হয়ে থাকে।

রাতে এখন ঘুমোতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা জ্যোসনা এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো, চোরা পথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানিনা আজ কার সঙ্গে থাকে।
আজ জুটেছে কাল কি হবে
কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমনি।

আজ আবার ২৩শে ডিসেম্বর। অফিস থেকে বের হতে ইচ্ছে করছেনা আমার। গত বছরের প্রত্যেকটা দিন আমি চরম অনীহা নিয়ে বাড়িতে ফিরেছি। ফিরতে বাধ্য হয়েছি। আমার টিপটপ সাজানো ফ্ল্যাটের কোনায় কোনায় এখন মাকড়সার ঝুল। গতকাল রাতে দীপার একটা মেইল পেয়েছি। মেইল না বলে ম্যাসেজ বলাই ভালো। ছোট্র দুটো শব্দ পুরো টেক্সটা বডিতে… “মাফ করিস”। অফিসটা মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেলে মোবাইলে বিজয়া মুখোপাধ্যায় এর কবিতাটা লাউড স্পিকারে অন করে আমি চোখ বন্ধ করি……

“বাড়ি ফিরে দেখি বাড়িতে বাড়ি নেই
একটা বড় দরজা
কয়েকটা বখাটে জানালা।
নড়ে চড়ে জিজ্ঞেস করলো
কাকে চাই?
ভেবে দেখতে হবে কাকে চাই।
বাড়ি ফাঁকা, বাড়িতে বাড়ি নেই।
কাঠের চেয়ারে ভাড়াটের মত
অনাহত অতিথির মত
বুঝে ফেলি।
চোখে দ্বিধা, পায়ে ভর কম।
একা।
আমার বাড়িতে বাড়ি নেই।“

হাসান এর পাগলামি ভরা আদরে মাংশাসী হয়ে ওঠা এই আমি গত একটা বছর কোনরকম শারীরিক তাড়না অনুভব করিনি। কিন্তু আজ হাসানকে বড্ড মনে পরছে। আজ আমার খুউব কষ্ট হচ্ছে। আজ আমার হাসানকে নিকৃষ্টতম ভাষায় গালি দিতে ইচ্ছে করছে। শরীরের কষ্টে আমার চোখ জ্বালা করছে।

“কি খবর বর্ষা? এখনও অফিসে!”

অফিসের বিগ বস্ ……… যিনি গত এক বছর ধরে নিরুচ্চারে আমার শরীর কামনা করে গেছেন দিনের পর দিন।

তবু আগুন বেনীমাধব আগুন জ্বলে কই
কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?

৯৭৫জন ৯৭৫জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ