বাদশাহ হুমায়ূন ছিলেন এক বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেননা, সেখানে সারাজীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টা ছিলো অদ্ভুত। সম্রাট বাবরের প্রথম পুত্র হুমায়ূন ছিলেন অলস ও আরামপ্রিয়। সে ঘর দরজা বন্ধ করে একা থাকতে পছন্দ করতো। কিন্তু একাকীত্ব রাজপুরুষদের মানায় না।
ইব্রাহীম লোদির কোষাগার এবং রাজধানী দখল করতে সম্রাট বাবর তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁকে পরাজিত করে, হুমায়ূন বাবার জন্য উপহার এনেছিলেন ‘ কোহিনুর ‘ নামক হীরা। কিন্তু পিতা সম্রাট এই উপহার পেয়ে এতো খুশি হয়েছিলেন যে, আবার তাঁকেই এই উপহার দিয়েছিলেন।
লোদির রাজকোষ পেয়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হুমায়ূন অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে পিতার কোষাগার দখল করে সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
সবচেয়ে মজার বিষয় ছিলো তাঁর নাম যখন নকীব ঘোষণা করতো। ” আল সুলতান আল আজম ওয়ল খাকরে আল মুকাররম, জামিই সুলতানাত – ই- হাকিকি ওয়া মাজজি, সৈয়দ আল সালাতিন, আবুল মোজাফফর নাসির উদ্দীন মোহাম্মদ হুমায়ূন বাদশাহ, গান্জি জিলুল্লাহ।”
বাগানের ভিতরে একটি দোতালা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তিনি থাকতেন। প্রচুর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ছবি আঁকতেন। একটা জানালার সামনে
তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা যেতো।
একবার হুমায়ূন খুব অসুস্থ হয়েছিলেন। দিল্লীর চিকিৎসক ঘোষণা দিলো তিনি চিকিৎসার অতীত। একজন সুফি সাধক তাঁর বাবাকে বলেছিলেন “আপনার প্রিয় কিছু দান করেন, তাহলে হয়তো তাঁর জীবন রক্ষা হবে।”
বাবর তাঁর প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। পুত্রের কালান্তর রোগ শরীরে ধারণ করে তিনি মারা গেলেন। আর হুমায়ূন সুস্থ হওয়ার তিনদিন পর সিংহাসনে বসেছিলেন।
সম্রাট হুমায়ুন গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে বিচার করাকে রাজকার্যের অংশ ভাবতেন। পোশাকও পরতেন গ্রহ বিবেচনা করে। রবিবার রাজ্য পরিচালনার সময় হলুদ পোশাক। সোমবার গীতবাদ্য হতো, ঐদিন আনন্দে থাকতেন তাই সবুজ পোশাক, মঙ্গলবার যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে আলোচনা হতো, মেজাজ থাকতো উগ্র, পরতেন লাল পোশাক।
সভা শুরুর আগে, তিনি শের আবৃত্তি করতেন। ” মুরদই লাখ বুড়া চাহে তো কেয়া হোতা হ্যায়, ওই হোতা হ্যায় যো মন্জুরে খোদা হোতা হ্যায়।” অর্থ:শত্রুরা আমার যতই অনিষ্ট কামনা করুক তাতে কিছুই হবেনা। ঈশ্বর যা মন্জুর করবেন তাই হবে, আমার ভাগ্যলিপি।
বাহদুর শাহকে আক্রমণ করার সময় একটি টিয়া পাখি পেয়েছিলেন। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে বড়?
তোতা বলল,” আল্লাহ আকবার।”
এই পাখিকে স্বর্গীয় পাখি উপাধি দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন।
সম্রাট যুদ্ধ বিরতিতে যা খেতেন——পোলাও পাঁচ ধরনের, রুটি সাত প্রকার, পাখির মাংস, কিসমিসের পানিতে ভেজানো পাখি ঘিতে ভেজে দেয়া, ভেড়ার আস্ত রোস্ট, পাহাড়ি ছাগের মাংস, পল, শরবত, মিষ্টান্ন এখনও পুরান ঢাকার কিছু রেস্তোরা সম্রাটের প্রধান বাবুর্চি নকি খানের উদ্ভাবিত খাবার গ্লাসি পাওয়া যায়।
শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে যখন তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শের রচনা করেছিলেন।
আমরা বাস করি সুন্দরের মধ্যে
সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর
যেমন পুণ্যের চারিদিকে থাকে
পাপের শক্ত খোলস।
ভাগ্যবান সেইজন যে অসুন্দরের পর্দা ছিঁড়ে সুন্দর দেখে, পুণ্যের কাছে যায় শক্ত খোলস ভেঙ্গে।
পরে বৈরাম খাঁ তাঁকে উদ্ধার করে আগ্রায় নিয়ে যান।
হুমায়ূনের ছিলো চার স্ত্রী। বেগা বেগম, মাহচুচুক, গুলজার বেগম, মেওয়াজান, হামিদা বানু। হামিদা বানুর গর্ভেই জন্ম নেয় আকবার দ্যা গ্রেট।
হুমায়ূন নিয়তি বিশ্বাস করতেন। একের পর এক যুদ্ধে হেরেও ; তিনি সূরা বনী ইসরাইল থেকে বলেছেন,”আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়েছি।”
হুমায়ূনের আর একটি বিখ্যাত শের হলো,” একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্র হলো তার প্রেমিকার মুখ, জোসনা হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস।
হুমায়ূন তাঁর ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বার বার সিংহাসন চুত্য হন। কাবুল জয়ের সময় বৈরাম খাঁর বুদ্ধির কারণে মীর্জা কামরানের হাত থেকে বেঁচে যান। কিন্তু যুদ্ধে ছোটভাই হিন্দোল নিহত হন।
এরপর হুমায়ূন সিংহাসনে বসেন ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এবং ঘোষণা করেন, যেকোন সময় আমি দুনিয়া থেকে চলে যাবো। আকবর যতদিন বয়োপ্রাপ্ত না হন, ততদিন বৈরাম খাঁর নির্দেশে হিন্দুস্তান চলবে। বৈরাম খাঁ কথা রেখেছিলেন।
হুমায়ূুন আহমেদ সুচারুভাবে রাজনীতির মারপ্যাঁচ পিছনে রেখে, সফলভাবে বাদশাহ হুমায়ূনকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। বাদশাহর বর্ণনাময় ও আড়ম্বরময় জীবন আমাদের উপভোগ্য করে তুলেছে। পাঠক হিসেবে প্রথম থেকে শেষ লাইন এক নিঃশ্বাসে পড়ে মনকে আনন্দ দেবার অতুলনীয় একটি উপন্যাস।
২৩১ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে রিভিউ লিখা অনেক কঠিন। তারপরেও চেষ্টা করলাম। এটা পড়ে, ভালো লাগা থেকে যদি বইটা পড়ে দেখেন ; তাহলে আমার লিখাও সার্থক।
৩৫টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হাজিরা দিলাম
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ
তৌহিদ
এ উপন্যাসটি আমি তিনবার পড়েছি। যতবার পড়েছি ততবারই ভালো লেগেছে। মোঘলদের ইতিহাস আমার খুব পছন্দের। আর লেখক এত সাবলীলভাবে বইটি লিখেছেন যা আসলেই মুগ্ধকর।
ধন্যবাদ আপনাকে এ বইটি নিয়ে রিভিউ লেখার জন্য।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা। আপনার কমেন্ট উৎসাহমূলক সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
ভালো উপস্থাপন দিদি।
বুক রিভিউয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
যদি এই বইটি আমার এখনো পড়া হয়নি।
নিশ্চয় বইটি সংগ্রহ করে পড়বো।
ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ আমার অনেক।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ, দাদা। পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করলাম।ঐতিহাসিক তবে মজাদার।
নাজমুল আহসান
হুমায়ূনের সেরা সৃষ্টি না হলেও, সেরাগুলোর একটা “বাদশাহ নামদার”। ইতিহাস, রাজনীতি বিষয়গুলোকে হুমায়ূন সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এর মধ্যে যেগুলো বের হয়ে এসেছে, সেগুলো সবই মাস্টারপিস।
ইতোমধ্যে না পড়ে থাকলে, “দেয়াল” পড়ে নিন।
আর, চমৎকার লিখেছেন। অভিবাদন গ্রহণ করুন।
আরজু মুক্তা
দেয়াল পড়েছি। যে কোন সময় রিভিউ পাবেন।আপনাকে ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য।
জিসান শা ইকরাম
বুক রিভিউ ভালো হয়েছে।
রিভিউ চালু রেখো, এতে তোমার সাথে পাঠকেরও পাঠাভ্যাস তৈরী হবে।
আর যারা বইটি পড়েন নি, তারাও আগ্রহী হবে পঠনের জন্য।
বইটি আর একবার পড়তে হবে।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ, চেষ্টা করবো। আপনার কমেন্ট বরাবরি উৎসাহ জোগায়।
নীরা সাদীয়া
বাহ অনেক মজার তথ্য জানতে পারলাম। তোতা পাখি, সিংহাসন লুট, বিশাল বড় নাম।
আর হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু আমারও প্রিয় লেখক।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ, সময় করে পড়ার জন্য।
নিতাই বাবু
হুমায়ূন আহমেদ-এর লেখা “বাদশাহ নামদার” বইটি আমার সংগ্রহে আছে। তবে আজ থেকে কয়েকমাস আগে আমার এক বন্ধু “কানাই” ভারত থেকে আমার এখানে বেড়াতে আসে। বইটি দেখেই ভারত যাবার সময় বইটি নিয়ে যায়। আমি বইটি দুইবার পড়েছি। সত্যি ভালো লাগার মতো বই। এমনিতেই আগেকার দিনের রাজা বাদশাহদের কাহিনী পড়তে জানতে আমার খুবই আগ্রহ। তাই সংগ্রহ করেছিলাম।
আরজু মুক্তা
দাদা, সময় করে পড়েছেন জন্য ধন্যবাদ। এটা শুধু ঐতিহাসিক তা নয় মজাদার ও।
আকবর হোসেন রবিন
আপনার লেখাটা পড়ার সময় আমার থেকে কেন জানি মনে হলো আমি বুক রিভিউ পড়ছি না, একটা গল্প পড়ছি। আপনি আমার মধ্যে বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরি করছেন না। বরং একটা গল্প বলে দিচ্ছেন।
হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই পড়া হলেও এটি পড়া হয়নি। পরে কখনও সময় করে পড়বো। এটা আমার নিজের জন্য হলেও পড়তে হবে। আমাকে ভাইবাতে শুধু রাজা বাদশাদের জীবনী থেকে প্রশ্ন করে।
আপু, আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।
আকবর হোসেন রবিন
ভাইভা*
আরজু মুক্তা
একেকজন একেকরকম ভাবে লিখে। আমি চেষ্টা করেছি। এই ভালোলাগা থেকে বইটি পড়লে লিখাটাও সার্থক।আর বইটা পড়ে সুন্দর সমালোচনা করবেন, এই অপেক্ষায়।
আকবর হোসেন রবিন
ওকে চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
বইটি পড়েছি ২০১৪তে। হুমায়ুন আহম্মেদ এর বেশির ভাগ বইই পড়া হয়েছে। আমার কাছে বইটির মুলভাব কিছুটা ভিন্নরুপে উপস্থাপন হয়েছিলো। এখন ঐ প্রসংগ বাদ 🙂
আপনার বুক রিভিউ এক কথায় দারুন হয়েছে। আরও কিছু তথ্য দেয়া গেলে পূর্নাঙ্গ রুপ পেতো। আপনার পঠিত বই সম্পর্কে আরো জানার অপেক্ষায় রইলাম। শুভ কামনা অবিরত 🌹🌹
আরজু মুক্তা
না, আপু। আপনার কাছ থেকে ঐটাই জানতে চাইবো, ঐ ভিন্নতা। পঠক হিসেবে কৌতূহল কাজ করবে। এখন ভালো লাগে, সুন্দর লিখেছেন। এমন মন্তব্য ভালো লাগেনা। আপনারা যারা ভালো লিখেন, ভালো বুঝেন। তাদের কাছ থেকেই তো শিখবো।
বুক রিভিউ লিখা খুব কঠিন। নিজের কাজ, চাকুরী সব শেষ করে মাথা ঠাণ্ডা রেখে লিখতে হয়।
চেষ্টা করবো। শুভকামনা।
মোঃ মজিবর রহমান
বইটি ঢাকার কোন বাসিন্দা থাক্লে ধার দিবেন দয়া করে।
আর এই বুক রিভিউতে সব বাস্তবতায় ভরা বা পরিপুর্ন। অনেক অনেক ভালবাসা রইল।শুভেচ্ছা অবিরত।
আরজু মুক্তা
ধার না কিনে পড়েন। সময় করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
এখন সম্ভব নারে বোন,।
ছাইরাছ হেলাল
ভক্ত পাঠক না হয়েও এই বইটি লাইনে দাঁড়িয়ে কিনেছিলাম।
ইতিহাসের প্রতি আকর্ষন আছে, কিন্তু এই বইটি একটু ভিন্ন আনন্দ দিয়েছে।
আরও লিখুন এমন কিছু।
আরজু মুক্তা
সেই বইমেলায় গেটে ঢুকেই দেখি, ওনার এই বই। দেরি করিনি, কিনে ফেলেছি।
আসলেই ইতিহাসের বাঘা বাঘা কথা থেকে, এরকম মজা পাওয়া বই মনে হয় কমই আছে।
ভালো লাগলো।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আপনার রিভিউ পড়ে বইটি পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হল। প্রথমে বইটি কিনতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ, আরো রিভিউ লিখুন।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা। পড়েই, দারুণ একটা সমালোচনা চাচ্ছি।
মনির হোসেন মমি
চমৎকার বুক রিভিউ পড়লাম খুব ভাল হয়েছে। বইটি পড়া হয়নি পড়ব আশা করছি।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ। বইটি পড়বেন, সেই আশায় রাখছি।
ইঞ্জা
বাদশাহ হুমায়ুনের গল্প, এক সময় প্রচুর পড়েছি, যেন সব চোখে ভাসে।
আপনার বুক রিভিউটা ভালো হয়েছে, আরও বিষদ লিখলে আরও ভালো হতো আপু, কিন্তু যা লিখেছেন তাও কম নয়।
আরজু মুক্তা
সুন্দর কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ
ইঞ্জা
শুভকামনা আপু
আরজু মুক্তা
এখন তো হাত পাকাচ্ছি। সামনে হয়তো ভালো লিখবো।
ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য।
রেহানা বীথি
বইটি গতবছর পড়েছি। আমি হুমায়ূন ভক্ত। যদিও তাঁর অনেক বই পড়েছি, তবে ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসটি পড়ে অভিভূত হয়েছি। আপনার রিভিউও ভালো লাগলো খুব।
আরজু মুক্তা
ঐতিহাসিক কিন্তু মজাদার।
শুভকামনা আপু।