1. হুমায়ুন আহমেদের অনেক বই আমার পছন্দ। তার মধ্যে ঐতিহাসিক কাহিনী সমৃদ্ধ বাদশাহ নামদার অন্যতম। এই বইটি ২০১১ সনের “একুশের বইমেলায়” প্রথম প্রকাশিত হয়।

বাদশাহ হুমায়ূন ছিলেন এক বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেননা, সেখানে সারাজীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টা ছিলো অদ্ভুত। সম্রাট বাবরের প্রথম পুত্র হুমায়ূন ছিলেন অলস ও আরামপ্রিয়।  সে ঘর দরজা বন্ধ করে একা থাকতে পছন্দ করতো। কিন্তু একাকীত্ব রাজপুরুষদের মানায় না।

ইব্রাহীম লোদির কোষাগার এবং রাজধানী দখল করতে সম্রাট বাবর তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁকে পরাজিত করে, হুমায়ূন বাবার জন্য উপহার এনেছিলেন ‘ কোহিনুর ‘ নামক হীরা। কিন্তু পিতা সম্রাট এই উপহার পেয়ে এতো খুশি হয়েছিলেন যে, আবার তাঁকেই এই উপহার দিয়েছিলেন।

লোদির রাজকোষ পেয়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হুমায়ূন অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে পিতার কোষাগার দখল করে সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

সবচেয়ে মজার বিষয় ছিলো তাঁর নাম যখন নকীব ঘোষণা করতো। ” আল সুলতান আল আজম ওয়ল খাকরে আল মুকাররম,  জামিই সুলতানাত – ই- হাকিকি ওয়া মাজজি, সৈয়দ আল সালাতিন, আবুল মোজাফফর নাসির উদ্দীন মোহাম্মদ হুমায়ূন বাদশাহ,  গান্জি জিলুল্লাহ।”

বাগানের ভিতরে একটি দোতালা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তিনি থাকতেন। প্রচুর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ছবি আঁকতেন। একটা জানালার সামনে
তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা যেতো।

একবার হুমায়ূন খুব অসুস্থ হয়েছিলেন। দিল্লীর চিকিৎসক ঘোষণা দিলো তিনি চিকিৎসার অতীত। একজন সুফি সাধক তাঁর বাবাকে বলেছিলেন “আপনার প্রিয় কিছু দান করেন, তাহলে হয়তো তাঁর জীবন রক্ষা হবে।”

বাবর তাঁর প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। পুত্রের কালান্তর রোগ শরীরে ধারণ করে তিনি মারা গেলেন। আর হুমায়ূন সুস্থ হওয়ার তিনদিন পর সিংহাসনে বসেছিলেন।

সম্রাট হুমায়ুন গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে বিচার করাকে রাজকার্যের অংশ ভাবতেন। পোশাকও পরতেন গ্রহ বিবেচনা করে। রবিবার রাজ্য পরিচালনার সময় হলুদ পোশাক।  সোমবার গীতবাদ্য হতো, ঐদিন আনন্দে থাকতেন তাই সবুজ পোশাক, মঙ্গলবার যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে আলোচনা হতো, মেজাজ থাকতো উগ্র, পরতেন লাল পোশাক।

সভা শুরুর আগে, তিনি শের আবৃত্তি করতেন। ” মুরদই লাখ বুড়া চাহে তো কেয়া হোতা হ্যায়, ওই হোতা হ্যায় যো মন্জুরে খোদা হোতা হ্যায়।” অর্থ:শত্রুরা আমার যতই অনিষ্ট কামনা করুক তাতে কিছুই হবেনা। ঈশ্বর যা মন্জুর করবেন তাই হবে, আমার ভাগ্যলিপি।

বাহদুর শাহকে আক্রমণ করার সময় একটি টিয়া পাখি পেয়েছিলেন। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে বড়?

তোতা বলল,” আল্লাহ আকবার।”

এই পাখিকে স্বর্গীয় পাখি উপাধি দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন।

সম্রাট যুদ্ধ বিরতিতে যা খেতেন——পোলাও পাঁচ ধরনের,  রুটি সাত প্রকার, পাখির মাংস, কিসমিসের পানিতে ভেজানো পাখি ঘিতে ভেজে দেয়া, ভেড়ার আস্ত রোস্ট, পাহাড়ি ছাগের মাংস, পল, শরবত, মিষ্টান্ন এখনও পুরান ঢাকার কিছু রেস্তোরা সম্রাটের প্রধান বাবুর্চি নকি খানের উদ্ভাবিত খাবার গ্লাসি পাওয়া যায়।

শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে যখন তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শের রচনা করেছিলেন।

আমরা বাস করি সুন্দরের মধ্যে

সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর

যেমন পুণ্যের চারিদিকে থাকে

পাপের শক্ত খোলস।

ভাগ্যবান সেইজন যে অসুন্দরের পর্দা ছিঁড়ে সুন্দর দেখে, পুণ্যের কাছে যায় শক্ত খোলস ভেঙ্গে।

পরে বৈরাম খাঁ তাঁকে উদ্ধার করে আগ্রায় নিয়ে যান।

হুমায়ূনের ছিলো চার স্ত্রী। বেগা বেগম, মাহচুচুক, গুলজার বেগম, মেওয়াজান, হামিদা বানু। হামিদা বানুর গর্ভেই জন্ম নেয় আকবার দ্যা গ্রেট।

হুমায়ূন নিয়তি বিশ্বাস করতেন। একের পর এক যুদ্ধে হেরেও ; তিনি সূরা বনী ইসরাইল থেকে বলেছেন,”আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়েছি।”

হুমায়ূনের আর একটি বিখ্যাত শের হলো,” একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্র হলো তার প্রেমিকার মুখ, জোসনা হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস।

হুমায়ূন তাঁর ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বার বার সিংহাসন চুত্য হন। কাবুল জয়ের সময় বৈরাম খাঁর বুদ্ধির কারণে মীর্জা কামরানের হাত থেকে বেঁচে যান। কিন্তু যুদ্ধে ছোটভাই হিন্দোল নিহত হন।

এরপর হুমায়ূন সিংহাসনে বসেন ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এবং ঘোষণা করেন, যেকোন সময় আমি দুনিয়া থেকে চলে যাবো। আকবর যতদিন বয়োপ্রাপ্ত  না হন, ততদিন বৈরাম খাঁর নির্দেশে হিন্দুস্তান চলবে। বৈরাম খাঁ কথা রেখেছিলেন।

হুমায়ূুন আহমেদ সুচারুভাবে রাজনীতির মারপ্যাঁচ  পিছনে রেখে, সফলভাবে বাদশাহ হুমায়ূনকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। বাদশাহর বর্ণনাময় ও আড়ম্বরময় জীবন আমাদের উপভোগ্য করে তুলেছে। পাঠক হিসেবে প্রথম থেকে শেষ লাইন এক নিঃশ্বাসে পড়ে মনকে আনন্দ দেবার অতুলনীয় একটি উপন্যাস।

২৩১ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে রিভিউ লিখা অনেক কঠিন। তারপরেও চেষ্টা করলাম। এটা পড়ে, ভালো লাগা থেকে যদি বইটা পড়ে দেখেন ; তাহলে আমার লিখাও সার্থক।

১৫৮৩জন ১১৩৯জন
0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ