আমাদের পরিবার যৌথ এবং খুব বড় ছিলো। আমাদের বড় পরিবারটা দিনের বেলায় আরও বড় হয়ে যেত। আত্মীয়-স্বজন, গ্রাম-গঞ্জের মেহমান আর প্রতিবেশীদের আনাগোনায় বাসায় হৈচৈ, থৈথৈ পরিবেশ থাকতো। এর মধ্যে নিয়মিত পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটতো না তেমন। তবে পরীক্ষার সময় এগিয়ে এলে আমি ব্যস্ত হতাম সব বাদ দিয়ে পড়াশোনা নিয়ে। নিজে নিজে নোট বানাতাম, সিলেবাস দেখে আসন্নবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতাম।

নোট বানানো শিখে ছিলাম সিনিয়র ভাই/ আপুদের কাছ থেকে। তখন যার‍যার নোটবুক নিজে বানিয়ে পড়াশোনা করার একটা বাড়তি মর্যাদা ছিলো। নোট কম্পিলিট হয়ে গেলে শুরু করতাম পড়া। রাত বাড়তে থাকতো, পড়ায় নিমগ্ন হওয়ার পরিবেশ আরও অনুকূলে আসতো। আমার বাবা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আমার পাশে থাকতেন। আমায় ডিস্টার্ব করতেন না কখনো। টেবিলে বসে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে মনেমনে পড়া আওরাতাম। তখন বাবা বলতেন, ” মা এত কষ্ট করে নোট বানিয়ে তোমার পড়ার দরকার নেই। আমি তোমাকে বাজার থেকে নোটবুক কিনে দিবো “…..

আমরা ৮০/৯০তে যখন পড়াশোনা শুরু করেছি তখন বইয়ের দোকানে পপি গাইড নামের একটা নোটবুক পাওয়া যেতো। দেড়/দু’শ পৃষ্ঠার গাইডবুকটা তখন খুব বেশি শিক্ষার্থীদের হাতে দেখা যেতো না। দু’চারজন কিনলেও লুকিয়ে রাখতো। ভুলেও কারো সামনে বের করতো না। কারন স্যার/ ম্যাডামরা যদি কোনভাবে জানতে পারতো ঐ স্টুডেন্ট গাইড দেখে পড়াশোনা করছে, তাহলে পরীক্ষার খাতায় তার নাম্বার কাটা যেতো। শিক্ষকদের বক্তব্য ছিলো নিজে যা পারবে তাই লিখবে, যেটা না পারো/ না বুঝো সেটা আমাদের জিজ্ঞেস করবে, আমরা শেখাবো। তাই আমরা সব সময় চেষ্টা করতাম নিজেদের স্যার/ ম্যাডামদের সাথে সংযুক্ত রাখতে।

আসলে তাদের অনেক জিজ্ঞেস করতে হতো না, ক্লাসের পড়া আর বইগুলো কন্টিনিউ পড়তে পড়তে পড়াটা কম্পিলিট হয়ে যেত এক সময়।

নতুন বছরের শুরুতে ছেলেমেয়ে দের স্কুল/ কলেজে ভর্তি করার পাশাপাশি অভিভাবকদের আরও কিছু কাজ করতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী নতুন ড্রেস, জুতা, ব্যাগ থেকে শুরু করে স্কুলের বুক লিস্ট দেখে বই খাতা, কলম ইত্যাদি সবই যোগাড় করে দিতে হয়। সন্তানের পড়াশোনা নির্বিঘ্ন রাখার জন্যে বাবা-মা, অভিভাবকরা সাধ্য অনুযায়ী এগুলোর যোগাড়যন্ত সানন্দে করে দেন। পাঠ প্রতিষ্ঠান যেমন হোক, পড়াশোনার গতি ঠিক রাখতে হলে শিক্ষার্থীদের এসব লাগেই।

প্রচলিত পাঠ্যবই ছাড়াও স্কুলের চাহিদা মেটাতে বাড়তি কিছু বই কিনতে হয়, যেগুলো স্কুল প্রদত্ত বুকলিস্ট দেখে কিনতে হয়। এর সাথে আরেকটি জিনিস অলিখিত ভাবেই কেনার তালিকায় যুক্ত হয়ে যায়, তা হলো গাইডবুক। বিভিন্ন নামি-বেনামি প্রকাশকরা তাদের প্রকাশনালয় থেকে বছরের একটা সময় এইসব গাইডবুক প্রকাশিত করেন। যা সারা বছর বিক্রি তালিকার প্রথম অবস্থানে থাকে। স্বেচ্ছায় / অনিচ্ছায় / অপারগতায় শিক্ষার্থীরা এগুলো কিনতে বা অভিভাবকদের দ্বারা কিনে নিতে অনেক সময় বাধ্য হয়। আর এই তথাকথিত গাইডবুক এর আর্থিক মুল্য প্রচলিত পাঠ্যবই এর থেকে যে বেশি তা বলা বাহুল্য।

বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার অঘোষিত নিয়ম থাকে নির্দিষ্ট লেখক/ প্রকাশনীর গাইড কেনার। না কিনলে ঐ শিক্ষার্থীর দূর্গতির সীমা থাকে না। কারা লেখেন এইসব গাইডবুক! এগুলো স্কুল/ কলেজের অধ্যক্ষ/ শিক্ষকদের নিজগুণে লেখা নোট সমুহ, যা গাইডবুক নামে প্রকাশিত হয়।

আমার মনে যে প্রশ্নটা আসে, এগুলো কি আদৌ খুব দরকারী? শুধু পাঠ্য বই পড়ে কি ভালো রেজাল্ট করা একেবারেই অসম্ভব? তাহলে ক্লাসে শিক্ষকরা কি পড়ান? শিক্ষার্থীদের কিভাবে বোঝানো হয়? ছেলেমেয়ে দের গাইডবুক পড়েই যদি সব বুঝতে/শিখতে হয় তাহলে ক্লাস করে কি লাভ! শিক্ষার মেরুদন্ড গড়ার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা যদি মেরুদণ্ড সোজা করার প্রাক্কালেই সাপোর্ট সিস্টেম ব্যবহার করেন, তাহলে ঐ জাতির মেরুদণ্ড কতক্ষণ দৃঢ় থাকবে?

১৫৫৮জন ১৩০৫জন
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ