পরিবারের প্রথম সন্তান বোধ করি একটু সহজ সরল হয়। আপা এমনই এক সহজ সরল মানুষ। চাহিদা নেই। যা দেয়া হয়, তাই হাসিমুখে মেনে নেয়। কিন্তু আমার তা নয়। যা কিছু চাই, চাই-ই চাই। দুঃখী, করুন চেহারা করে, এটা সেটা বলে আব্বাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আদায় করে নিতাম সব। তবুও সেই সময়গুলোতে আমার বদ্ধমূল ধারনা ছিল জীবনভর কেবল ঠকেই এসেছি আমি, আর আপা না চাইতেই সব পেয়ে যায় ! এখন এই বড়বেলায় এসে বুঝি, আসলে তেমনটি ছিল না।
ছুটিতে চাঁদপুর এলে বাসায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সহ কতো কাজ করে আপা একাকি ! আমি অলস ঘুমিয়ে, শুয়ে, বসে আরাম করি দিনভর। সামান্য তিরস্কারের স্বরে আপা বলতো, এমন এক সময় আসবে জীবনে, কাজ করে কূল পাবিনা। তবুও আমি খাটে বসে পা দোলাতে থাকি। কাজ শেষে দুপুরে শুয়ে শুয়ে ভার্সিটি, হোস্টেল, ওখানকার ডায়নিং এর খাবার নিয়ে নানান গল্প শুনাতো। আমি গভীর আগ্রহে সেইসব শুনতাম। এক ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসবার সময় ডায়নিং এ দেয়া ভাজা মাছ প্যাকেটে মুড়িয়ে নিয়ে আসে আমাদের দেখাবে বলে। পাঁচ সদস্যের পরিবারের আমরা সকলেই জটলা করে সীমাহীন বিস্ময়ে তা দেখি। অশ্রুসজল হয়ে উঠি। অস্ফুটে বলি, “এতো ছোট টুকরা ” ! হোস্টেলে ডালে কব্জি ভিজিয়ে ভাত খাওয়ার বর্ণনা আরো বেদনাবিধুর করে তোলে পরিবেশ। ছুটি শেষে আপার ফিরে যাবার দিনে আম্মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ব্যাগে চাল, ডাল, বিস্কিট সহ এটাসেটা পোটলা পুঁটলি দিতে থাকে, দিতেই থাকে।
ভার্সিটি জীবনের একেবারে শেষ সময়টায় আমায় সাথে নিয়ে যায় দেখাতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মনোরম গাছপালা, পাহাড় পরিবেষ্টিত। ডায়নিং এ কিংবা টিভিরুমে যেখানেই যাই, কেমন করে যেন সকলেই চিনে ফেলে আমায়। “তুমি লিপি’র ছোট বোন ?” এমন প্রশ্নে বিস্ময়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতাম। যদিও আমাদের দু’বোনের চেহারায় কোন মিল ছিল না। আপার সাথে এক সপ্তাহের হোস্টেল জীবনে বিকেলে ওর বন্ধুরা সহ একসাথে ঘুরতে যাওয়া, গলা ছেড়ে গান গাওয়া, পিকনিকে যাওয়া, সবমিলে জীবনের শ্রেষ্ঠতম কিছু সময় ছিল। শেষদিনে তল্পিতল্পা গুটিয়ে অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে আপা এবং তাঁর ক্লাসমেট বন্ধুরা অশ্রুজলে একে অপরের কাছ হতে বিদায় নেয়। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য ! আমি সেই বেদনাবিধুর দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম।
এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য জীবনে আরেকবার দেখেছি আমার দেশ ছেড়ে আসবার দিনে। ততোদিনে আপা ধানমণ্ডিতে নিজের সংসারে। আট/নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা আপা স্বামীসহ আমায় বিদায় জানাতে আসে এয়ারপোর্টে। পুষ্টিহীনতায় ভোগা রোগীর মতন চোখজোড়া কোটরে। ক্ষণে ক্ষণে চোখ মুছছিলো। আমি দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অসহায় চাহনিতে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
পাঁচ বছর বাদে যখন দেশে ফিরলাম, সবকিছুই কেমন বদলে গেলো, বদলে গেলাম আমিও ! যে আমি আগে প্রায় প্রতিদিনই নানান প্রয়োজনে নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের চৌরাস্তা অনায়াসে পার হতাম, সেই আমি ছোটখাটো রাস্তাও পার হতে পারি না ! এতো মানুষ, রিক্সা, গাড়ি বেপরোয়া ছুটে চলে ! রিক্সায় বসলে আপাকে খামচি দিয়ে ধরে থাকি। মনে হতো উল্টে পড়ে যাচ্ছি। রাস্তা পার হবার সময় ভয়ে আতংকে চুপসে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। এক পা এগোলে তিন পা পিছিয়ে আসি। আপা একরকম টেনে হিঁচড়েই হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয় !
এতোকিছু লিখেছি যে কারনে__ সব কাজ শেষে করোনা এভিনিউ ধরে বাড়ি ফিরছি যখন, তখন সামনে সন্ধ্যার রক্তিম আকাশ। উত্তরে একঝাঁক পাখি উড়ছিলো। একঝাঁক দক্ষিনাকাশে। দু’টো ঝাঁক এক হয়ে মিছিলের মতো উড়ে গেলো সামনে, দূরে, বহুদূরের আকাশে। পাখিরাও কি ব্যস্ততায় উড়ে গেলো ? আপা ঠিকই বলতো, ” এমন এক সময় আসবে জীবনে, কাজ করে কূল পাবি না “। দু’দিন আগে জন্মদিন গেলো আপা’র। আমার উইশ করা হয়নি তাঁকে ! বিদেশ বিভূঁইয়ের ভয়ানক ব্যস্ততার মাঝে কতো কি ভুলে যাই আজকাল !
জীবন এগিয়ে চলুক জীবনের নিয়মে।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
লেখাটি একটু বেশীই ভাল লাগলো। দুবার পড়লাম।
কত সহজ করে জীবন থেকে নিয়ে এমন ভাবে লিখে ফেলেন, তাই ভাবি অবাক বিস্ময়ে।
জীবন এমনই,
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লেগেছে আমারও ভাল লাগছে , দাদাভাই ।
শুন্য শুন্যালয়
আমার বেলায় উল্টো ছিলো। আমার বোন ছিলো খামখেয়ালি, যা চাই তা দিতেই হবে তাকে। আর আমার খেয়াল সারাদিন খেলাধূলা। কোনদিন ঈদের শপিং এ আমি যাইনি, আমার সবকিছু আমার বোনের পছন্দে পড়তাম। ও ছিলো চরম আলসে, আমি চটপটে কাজের। আমার বোনকে নিয়ে পুরো একটা লেখা লিখে জমা করে রেখেছি পোস্ট করা হয়নি। মনে হয়েছে হয়তো নিজেকে বেশি হাইলাইট করা হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে দিয়েই দেব একদিন। নিজেকেই নাহয় পড়াবো। অনেক কথা বললাম আপু।
আপুর জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
আপনার কোন লেখাই কী কখনো খারাপ হবেনা?
রিমি রুম্মান
দিয়ে দাও আপু তোমার লেখাটি। পড়ার আগ্রহে রইলাম। তুমি হাইলাইট তো আর ইচ্ছে করে হও নাই, অটোমেটিক।
নীহারিকা জান্নাত
বড় আপার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ব্যাস্ততা মানুষকে এভাবেই গিলে খাচ্ছে।
বোনের আবেগ বোনেরাই অনুভব করতে পারে।
অনেক ভালো লাগলো আপা।
রিমি রুম্মান
আপাকে শুভেচ্ছা পৌঁছে দিলাম। একটু লজ্জা পাইসে মনে হইলো। 🙂
নীহারিকা জান্নাত
🙂
গাজী বুরহান
কালকের ঘটনা। লাঞ্চ সেরে রেস্ট নিচ্ছিলাম। এমন সময় দরজায় নক করছে কেউ। খোলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি একটি প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল, ভাইয়া আপনার বই। আমি তো খুশিতে আত্মহারা। কারণ এখানে আপনার লেখা বই দুইটিই আছে। রকমারি তে অর্ডার দিছিলাম আরো কয়েকটি বইয়ের সাথে “পূবের আকাশে ভোরের অপেক্ষায়” বইটি।। তারা বলল এই লেখকের আরেকটি বই আছে (আমি জানতাম না)। দেরি না করে দুইটাই কনফার্ম…।
.
.
রিমি রুম্মান
বাহ্ ! জেনে ভাল লাগলো ভীষণ । পড়ে ভাল মন্দ মতামত দিবেন কিন্তু।
বায়রনিক শুভ্র
আমিও পরিবারের ছোট । চাহিদা আদায়ে সব সময়েই আমি ১ নম্বরে । এদিক দিয়ে আমার বড় ভাই অনেক নমনীয় ।
রিমি রুম্মান
আহারে বড়ভাই ! বড়রা এমনই নমনীয় !
আবু খায়ের আনিছ
আমি বড় সন্তান কিন্তু আমার চাওয়া তো অনেক, ছোট বোনদের কাছ থেকেও চেয়ে নিই। ব্যস্ততার পরে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না, কোথায় যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই ব্যস্ততা।
ইকরাম মাহমুদ
পরিবারের প্রথম সন্তান বোধ করি একটু
সহজ সরল হয়।
একেবারে খাঁটি কথা।আমার বড় ভাইটা তেমনই। আমিও কেঁদে-কেটে আদায় করতাম সব কিন্তু বড়ভাইয়া না চেয়েও পায়।
ব্যস্ততার কথা বললেন তো!
সোলস ব্যান্ডের একটা গানের লাইন মনে পড়লো ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর”
সত্যিই তাই, ব্যস্ততা আমাদের অবসর কেড়ে নিয়েছে কিন্তু মনের ভীতরে যে ভালোবাসা তা কিন্তু একটু কমেনি। শুভেচ্ছা বড় আপুকে।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রথমেই বড় আপুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
আমি জানিনা আমি কি রকম, তবে আমি বড়ো। 😀
তবে আমার চাওয়া হয়ে ওঠেনা কখনো, কিন্তু পেয়ে যাই।
রিমি আপু যদি অনুমতি(এক্সিডেন্টের কেস চলছে) পাই দেশের বাইরে যাবার, তাহলে নিউইয়র্ক আসবো সামারে।
ভালো রেখো। -{@
রিমি রুম্মান
এসো এসো স্বাগতম । দেখা করো কিন্তু ।
নীলাঞ্জনা নীলা
জানাবো যাবার আগে। তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে আপু।
মেহেরী তাজ
আপনার লেখা পড়ে খুব করে মনে হচ্ছে বড় হিসেবে আমার আর একটু গোছানো হওয়া উচিৎ ছিলো! অথচ এর সমস্যা সেই সমস্যা করে করে আমিই বরং গা ছাড়া উল্টো দিকে আমার ৮ বছরের ছোট বোন টাই বড্ড গোছানো।
আপনি সব সময় এতো ভালো লিখেন কিভাবে আপু!?
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর বর্ণনায় লেখাটি ভালো লেগেছে। -{@