খুলে যাচ্ছে একটি বিশাল সম্ভাবনার দরজা । বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে গঠিত হচ্ছে আঞ্চলিক ইকোনমিক করিডর। এ করিডর গঠনের প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত। আর এ করিডর গঠিত হলে বাংলাদেশ বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে। এতে করিডরে অংশগ্রহণকারী চারটি দেশের মধ্যে বছরে ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। আর ওই বাণিজ্য বৃদ্ধি থেকেই বাংলাদেশ সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে।

নতুন এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি ‘বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার’ (বিসিআইএম) নামেই অধিক পরিচিত। ইতোমধ্যে এ ফোরাম গঠনে আগ্রহী চার দেশের মধ্যে প্রথম সরকারী পর্যায়ের বৈঠক গত ২১ ডিসেম্বর চীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডর গঠনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এ করিডর অর্থনীতি ও বাণিজ্য ছাড়াও চার দেশের মানুষের মধ্যে নিবিড় সংযোগ স্থাপন করবে।

কানেকটিভিটির মাধ্যমে এশিয়ার এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প সেই রকম একটি প্রেক্ষাপটের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ আফগানিস্তান থেকে সওদাগররা উপমহাদেশে এক সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। মধ্য এশিয়া থেকে উপমহাদেশ হয়ে চীন পর্যন্ত বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল। তখন এ রুটে পণ্য বলতে সিল্কের আনাগোনা ছিল। সে কারণে মধ্য এশিয়া থেকে উপমহাদেশ হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ রুট ইতিহাসে ‘সিল্ক রুট’ নামে পরিচিত।
কালের পরিক্রমায় রাজনৈতিক বিবর্তনে সিল্ক রুট এখন নেই। তবে এশিয়ায় চীনের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উত্থানে এবং ভারতে পুঁজি বিকাশের ধারায় সেই সিল্ক রুট নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। মন্দায় আক্রান্ত বিশ্বে এশিয়াকেই আগামীর অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র বিবেচনা করা হচ্ছে।

ঐতিহাসিক সিল্ক রুট কিংবা নতুন সিল্ক রুট যাই বলা হোক না কেন- বৃহত্তর ক্যানভাসে বিবেচনা করলে বিসিআইএমকে ওই কানেকটিভিটির অংশ বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, ভারত যেভাবে তার এক অংশ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য নিতে বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট চাইছে তারও অনেকখানি পূরণ হবে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরে।

এ বিবেচনায় বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে।
বিশেষ করে চীন ও ভারতের মতো অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা এ অঞ্চলের দেশগুলোর বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে। তাই দুই বড় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগ দিয়ে তার অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে অধিক তথ্য ও জ্ঞান আহরণকে বাংলাদেশ যৌক্তিক মনে করছে। এতে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে নিজ দেশের জন্য অর্থনৈতিক লাভালাভের একটি উপযুক্ত অবস্থান প্রণয়ন করতে পারবে।
উল্লেখ্য, বিসিআইএম দেশগুলোতে দুই দশমিক আট বিলিয়ন জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। অর্থনীতির আকার ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিসিআইএম নিয়ে স্টাডিঃ চারটি দেশের মধ্যে যদি বাণিজ্য নীতি আংশিক উদারীকরণ করা হয়, তাহলে সর্বনিম্ন ৩ হাজার ১২০ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। আর সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া সব মিলিয়ে এই চার দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং নেটওয়ার্ক অন ট্রেডের সমীক্ষায় দেখা যায়, বিসিআইএম হলে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে ৫৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য অবশ্য সব দেশের বাণিজ্য নীতি উদারীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য নীতি পরিমিত উদারীকরণ হলে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে ৪১০ কোটি মার্কিন ডলার এবং আংশিক উদারীকরণ হলে বাণিজ্য বাড়বে ২৭০ কোটি ডলার। ওই স্টাডিতে বলা হয়, বিসিআইএম হলে বিসিআইএমের বাইরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য তৈরি হবে সর্বোচ্চ ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার এবং সর্বনিম্ন ১৮০ কোটি ডলারের। পাশাপাশি বাণিজ্য বিকেন্দ্রীকরণ বা বহুকরণ হবে সর্বোচ্চ ১৮০ কোটি ডলার এবং সর্বনিম্ন ৯০ কোটি ডলার। বিসিআইএমের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ফ্রি ট্রেড এ্যাগ্রিমেন্ট অতিরিক্ত যুক্ত হলে এবং সঙ্গে চীন ও মিয়ানমার থাকলে এই বাণিজ্য ১২০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। তবে বাণিজ্য নীতি পরিমিত উদারীকরণ হলে বাণিজ্য বাড়বে ৯০০ কোটি ডলারে।
বিসিআইএমে অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৭০ কোটি মার্কিন ডলার (দেশীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা) এবং সর্বনিম্ন ৪০ কোটি ডলারের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। তবে বলা হয়, যে দেশের অর্থনীতির আকার বড় ওই দেশ এই শুল্ক সুবিধা বেশি ভোগ করতে পারবে। সে হিসাবে ভারত সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ৩৬০ কোটি ডলারের শুল্কমুক্ত সুবিধার বাণিজ্য করতে পারবে। চীন শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা নিতে পারবে ৬০ কোটি ডলার থেকে ১২০ কোটি ডলার এবং মিয়ানমার ভোগ করতে পারবে ৩০ লাখ থেকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত।

চারটি দেশের মধ্যে কল্যাণমূলক সুবিধার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকছে বাংলাদেশ। বিসিআইএমের মধ্যে কল্যাণমূলক সুবিধা ভোগ করবে ভারত। আর্থিক দিক থেকে এ সুবিধার মূল্যমান হচ্ছে প্রায় ২৭ কোটি মার্কিন ডলার। সবচেয়ে কম সুবিধা পাবে মিয়ানমার। তাদের ক্ষেত্রে কল্যাণমূলক সুবিধার আর্থিক মূল্য হচ্ছে ৫০ লাখ ডলার। তবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ কল্যাণমূলক আর্থিক সুবিধা ভোগ করতে পারবে ৭ কোটি মার্কিন ডলারের।
বিসিআইএম অঞ্চলে রফতানির জন্য ১৫টি পণ্যকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রয়েছে শস্যকণা, চামড়া, শুকনা খাবার, ছাগলের মাংস, হস্তশিল্প ও সিনথেটিক ফেব্রিক্স। এটি মূলত চীনের বাজারে রফতানির জন্য শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি ভারতের বাজারের জন্য শনাক্ত করা হয়Ñ এন হাইড্রোঅক্সাইড এ্যামোনিয়া, লিড এ্যাসিড, সবজি, পাট ও টেক্সটাইল পণ্য।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে কানেকটিভি জোরদারে এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল কৌতুহলী। যুক্তরাষ্ট্রও উদ্যোগটিকে সমর্থন জানিয়েছে।
‘অর্থনীতির দিক থেকে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে বিসিআইএম। বিসিআইএম হলে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াও যুক্ত হতে পারবে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তানও যুক্ত হবে।’

এই সিল্ক রুট কি হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক জোনের প্রথম পদক্ষেপ ? 

বিস্তারিত পড়ুন এখানে

৮২৯জন ৮২৮জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ