নুরু মিয়া গত তিন দিন ধরে ঔষুধ বিক্রি করতে যান না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়েন।
বউয়ের সাথে এসব নিয়ে বিরতি দিয়ে ঝগড়াও হয়েছে ক’বার ।
“কতা বার্তায় খিল দিয়া কি এক বেশ নিছেন কয় দিন ধইরা !দানা-পানি কি আসমান ফাইরা নামব?”
এমন অভিযোগ তুলে বউ সুর উঠালেই রেগে যায়। বাঁধে হট্টগোল।
.
বউয়ের উদ্বিগ্নতার কারণ সে বুঝে। কিন্ত মন যে নিরুপায় ! সব কিছুতেই অনাগ্রহ। দু’বছরও হয় নি এই পেশায় এসেছে। এমন ধাক্কা খেতে হবে জানলে কিছুতেই আসতো না।
বিড়বিড় করে বলে-” মইরা গেলো? বউডা মইরা গেলো?”
আট বছরের মেয়ে এসে কাঁধ ঝাঁকায় – ” আব্বা , ও আব্বা ছিলহি হুনুম। কও । নাইলে মোবাইল ছাইড়া দেও। ”
নুরু মিয়া মেয়েকে ধমক দেয়।পিতার অচেনা গলায় মেয়ে হতভম্ব হয়ে বাইরে পা দেয়। চৌকাঠ পেরিয়ে সুর তুলে –
” ইঁদুর তোমার রেহাই নাই, ধরা পড়লে জামিন নাই। ইঁদুরের বংশ করে দেব ধ্বংস….. ”
নুরু মিয়া কান চেপে ধরে, ভেতরে পুঁড়ায়।এমন কেন হলো !নিজেকে অপরাধী লাগে। বউটা একবার তাঁকে যদি বলতো কি জন্য ঔষুধ কিনছে ! জানলে কিছুতেই তাঁর কাছে ঔষুধ বেচতো না।মরতেও নিষেধ করতো।
মাঝে মাঝে মোড়ের টং দোকানে বসে চা-পান খেতো সে। এখন ওখানেও যায় না। মৃত মানুষটা নিয়ে কতো কথা ! শুনলেই অন্তরে মোচড় দিয়ে উঠে।
.
বিষ মুখে তুলবার আগে
বউটা কি তাঁকে অভিশাপ করেছিলো ! কতো দুঃখ বুকে জমলে মানুষের কাছে জীবন বোঝা হয়ে উঠে ! জানালায় উদাসী দৃষ্টি দিয়ে নুরু মিয়া ভাবে।
.
সন্ধ্যায় বাক্স খুলে বসে। মানুষকে আকৃষ্ট করবার জন্য রেকর্ড করা কথাগুলো মুছে ফেলে। উপদ্রবকারীর জীবন মূল্যবান লাগে তাঁর কাছে। একটা প্রাণ কতো ছটফট তুলে বেরিয়ে যায় দেহ থেকে !
.
পাড়ার কলিমুদ্দিনের বউ ইঁদুরের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। দুই সন্তানের মা।নুরু মিয়াকে পথে থামিয়ে বিষ কিনেছিলো ।সেই বিষ খেয়ে। সংসারের নানান অশান্তি,সামাজিক সমস্যা,অভাব-অভিযোগ হাঙরের মতোন ধেয়ে আসছিলো। একটা পথই পেয়েছিলো পালিয়ে যাবার। মৃত্যু। অথচ , বেঁচে থাকবার কতো কতো পথ ছিলো! দুঃখী আর অভিমানীর কাছে সেই পথগুলো হয়তো দৃষ্টিগোচর হয় না। বেঁচে থাকার সৌন্দর্য দুর্বিষহ লাগে। বুকের যাতনা কাউকে বুঝাতেও পারে না । আহারে , অভিমান! একবার নিজেকে ভালোবাসলে বেঁচে থাকবার হাজারটা কারণ সামনে চলে আসে।আর বোঝা হয়ে উঠলে ! তবুও , বেঁচে থাকাই আনন্দের।
.
মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় সে, ইঁদুর মারার বিষ বিক্রি করবে না। হঠাৎ করে জীবের জীবনও অমূল্য লাগে।হোক তা উপদ্রবকারী….
১৩টি মন্তব্য
প্রহেলিকা
করুণ গল্প! হরহামেশাই ঘটছে আমাদের আশেপাশে। কেন জানি গত দুতিন ধরে এই আত্মহত্যা শব্দটা বেশ নজরে আসছে।
নুরু মিয়ার নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে আছে, যদিও তিনি জানতেন না কোন উদ্দেশ্যে কিনছে। তাসমিয়া শান্তা নামের মেয়েটির কথা মনে পড়লো। দুদিন আগেও সেও ইঁদুরের ওষুধ খেয়েই আত্মহত্যা করেছে। 🙁
রুম্পা রুমানা
হুম। মেয়েটা ভালো লিখতো। কেন যে এমন হয় ! ধন্যবাদ আপনাকে।
নীরা সাদীয়া
প্রাত্যহিক জীবনের এক করুণ চিত্র অঙ্কিত হল। এভাবে যেন ইঁদুরের বিষের জ্বালায় আর কোন নুরুমিয়া না জ্বলে। আর যেন ঝড়ে না পরে কোন তাজা প্রাণ অভিমানে আর অবহেলায়।
রুম্পা রুমানা
বেঁচে থাকা সুন্দর। কেন এমন করে মেয়ে ছেলেগুলা! যদিও কষ্টেই করে। তবুও হেরে যাওয়া উচিত না।
জিসান শা ইকরাম
নুরু মিয়ার আত্মপোলন্দি এই গল্পের প্রান। আত্মহনন ঠিক না কোন মতেই।
রুম্পা রুমানা
এগুলো বুঝানো যায় না বা বুঝেও কিছু করার ইচ্ছে জাগে না যারা আত্মহনন করে তাদের। অনেক বিখ্যাত মানুষই এমন পথ বেছে নিয়েছে। কি আর বলার !
নীলাঞ্জনা নীলা
আত্মহত্যা কেন যে করে মানুষ, আমি বুঝিনা। পৃথিবীতে সুখী কি কেউ আদৌ আছে?
আপনি কিন্তু খুব ভালো গল্প লেখেন।
রুম্পা রুমানা
অবিমিশ্রিত সুখ বলে কিছু নাই। কিন্তু আবেগ আসলে ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দেয়। সমস্যাটা এখানেই। ধন্যবাদ আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
লিখে চলুন।
ভালো থাকবেন।
নীহারিকা
কখন, কি যে মানুষকে আমুল পালটে দেয় আমরা জানি না।
তবে যার আত্মপোলব্ধি ঘটে তিনিই মানুষ।
গল্প ভালো হয়েছে।
মিষ্টি জিন
আত্মহনন কিছুতেই মানা যায় না।
আত্মোপোলব্দি যে হয়েছে এই যথেষ্ট।
আপনার গল্প লেখার হাত বেশ ভালো।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ভালো হয়েছে। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দক্ষ হাতের অংকন বলতে হবে।
আমির ইশতিয়াক
ভালো লিখছেন। শুভ কামনা রইল।