খাবার পর দোকানদার মামা বললো,
-মামা, রাত তো অনেক হল, আজ যদি গরীবের বাড়িতে আপনি থেকে যেতেন। আপনার মামী কাল সকালে চিতই পিঠা বানাবে বলছিল।
তৃপ্ত বললো,
-মামা, আমি আপনাকে এমনিতেই বিপদে ফেলে দিলাম। আর কেন কষ্ট করবেন ?
দোকানি বললো,
-মামা, আমরা গরীব মানুষ, এইটা ঠিক, কিন্তুক তাই বইলা কি আমগো এমনে লইজ্জা দিবেন ? আমার তো আর খাট পালঙ্কন নাই, চৌকি আছে, আপনের থাকতে কষ্ট ই হইবো, থাউক, চলেন আপনেরে আগাই দেই।
মনটা খারাপ হয়ে গেল তৃপ্ত’র। না বুঝে ও কষ্ট দিয়ে ফেলেছে গরীব কিন্তু বড় মনের এই মানুষটিকে। ও বললো,
-মামা, থাকবো, কিন্তু মামী কে ডাকেন, আগে নাস্তার মেনু ঠিক করি।
দোকানী হাসলো, কিছু বললো না, এই কারনেই সে তৃপ্ত কে এত পছন্দ করে। তৃপ্ত আখাউড়াতে আসে ফেন্সিডিল খেতে, সে নেশাখোর, কিন্তু এই মানুষ কে যেভাবে সম্মান করতে জানে সে, তা অনেক সৎ বা শিক্ষিত মানুষ ও পারবে না। ছেলেটা কি চমৎকার ভাবে তার স্ত্রী কে মামি বলে ডাকছে, তার ছেলেটাকে নিয়ে খেললো,এমনকি তার দেড় বছর বয়সী মেয়েটা যখন তৃপ্ত’র কোলে প্রসাব করে দিল, তখন সে বললো “দেখছেন মামা, টুকটুকি আমাকে কি পছন্দ করছে ? আমার কোলে এসেই হিসু করে দিল, বাচ্চারা সবার কোলে হিসু করেনা, যাকে ভালবাসে তার কোলেই হিসু করে”।
দোকানী চলে গেল তার স্ত্রী কে ডাকতে, আর বিরবির করে বলে চললো “আল্লাহ, আমার ছেলেটা যেন এর মতই হয়” ।
চলছে তৃপ্ত আর মামির কথা,
-মামী, কাল নাকি চিতই পিঠা বানাবেন ?
-হুম, হাসের মাংস দিয়া চিতই পিঠা বানামু তর লাইগা (তৃপ্ত মানা করায় সে ওকে “আপনি” সম্মোধন করে না, তুমি সে কাউকেই বলতে পারেনা, তাই সরাসরি তুই)
-কিন্তু মামী, হাসের মাংস তো চালের গুঁড়ার রুটি দিয়ে মজা, আমি শুটকি ভর্তা ছাড়া চিতই পিঠা খাবোনা, শুটকি ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা আর সরষে ভর্তা। সাথে বেশি করে আদা দিয়ে লাল চা।
-কস কি ? শুটকি তো ঘরে নাই, আমি আরও তর মামা রে হাঁস জবাই করতে কইলাম, হে কইল বিয়ান রাইতে হাঁস জবাই দিব।
-আমি’ত এই সব জানিনা মামী, আমার ভর্তাই চাই, ঘুম থেকে উঠবো ১২ টায়, ঊঠে ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাবো, আমার ভাগের গুঁড়ি রেখে দিবা আলাদা করে, আমি চুলোর কাছে বসে খাবো, তুমি ভাজবা আর দিবা, এখন গেলাম ঘুমোতে, একটা বই পড়বো আজ, স্টেশন থেকেই কিনেছি। দেখো তোমার টুকটুকি যেন আবার কোলে হিসু করার জন্যে আমাকে সকালে ঘুম থেকে না জাগায়।
মামীর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে তৃপ্ত চললো ঘুমোতে, একটা চৌকি তে দু’ পরতা কাঁথা ফেলে বিছানা করা হয়েছে, দেখেই বোঝা যায় এতে মমতার কি নিপুণ ছোঁয়া লেগে আছে। মোমের আলোতে বই পড়ছে তৃপ্ত। “দি রোড ব্যাক” দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটা বিখ্যাত উপন্যাস যা এক সাথে বিশ্বের ২৫ টি ভাষায় মুদ্রিত হয়ে রেকর্ড করেছে। বইটা ভালই, যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের নিয়ে লেখা। খুব আবেগি একটা বই। পড়তে পড়তে তৃপ্ত’র মনে হল, যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ জাঁদরেল একটা উপন্যাস ইংরেজি তে লিখতো তবে এই বইটার লেখক এরিক মারিয়া রিমার্ক লজ্জায় লাল হয়ে যেত তার উপন্যাসের যুদ্ধবাজ সৈনিকদের দুর্বলতা আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বীরদের লড়াই ও ত্যাগ দেখে। তবে একটা ব্যাপার, তার বইয়ের যুদ্ধ পরবর্তি অবস্থা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তিকালীন অবস্থার খুব মিল। সে বইয়ে ও যুদ্ধের পর সত্যিকার যোদ্ধা সৈনিক’রা আমরণ অবহেলিত আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর ও আমাদের সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা রা চরম ভাবে অবহেলিত।
ঘুমের এক পর্যায় তৃপ্ত’র হঠাৎ ওর মনে হল ও স্বপ্ন দেখছে, “এক সুন্দরী রমনী তৃপ্ত’র পাশে বসে ঔষধ খেতে গিয়ে ফেলে দিল, ভয়ে ভয়ে ঔষধটা ঊঠাতে গিয়ে ফেলে দিল পানির গ্লাসটাও, ভিজে গেল ওর বুকের এক পাশ” স্বপ্নরা দ্রুত পরিবর্তন হয়, এখানেই তাই হল, তৃপ্ত এখন স্বপ্নে ঐ সুন্দরীর হাত ধরে কোথাও ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু একি বুকের কাছটা ভেজা ভাজেই মনে হচ্ছে কেন ? ভেঙ্গে গেল ঘুম, আর উদ্ঘাটিত হল বুকটা ভেজা থাকার রহস্য। টুকটুকি কোন এক ভাবে ঠিক ই ওকে খুঁজে বের করে ওর বুকে উঠে বসেছে আর যথারীতি হিসু ও করেছে। জীবনে এই প্রথম তৃপ্ত ঘুম থেকে উঠে দেখলো একটা বাচ্চা পরী ওর বুকে বসে আছে, দু’হাত দিয়ে পিচ্চিটা কে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
– কিরে তোর কি হিসু করার আর কোন যায়গা ছিলনা ?
কি জানি কি বুঝে টুকটুকি খিলখিল করে হেসে উঠলো ।
তৃপ্ত বিছানা থেকে নেমে টুকটুকি কে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো, মামী মামী বলে হাঁক ছেড়ে দিয়ে টুকটুকির সাথে কথা বলায় মগ্ন হয়ে গেল,
-এই টুকটুকি তুই বড় হয়ে কি হবি রে ? তুই কি একটা ভেবলা টাইপ ছেলে বিয়ে করে সংসারী হবি ? আর সারাদিন তার পিত্তি জ্বালাবি ? নাকি তুই লেখাপড়া করে অনেক বড় কিছু হবি ?
টুকটুকির তো আর এত বোঝার ক্ষমতা নেই, সে হাসছে আর অবোধ্য কিছু শব্দ করে যাচ্ছে, যার কিছুই তৃপ্ত বুঝতে পারছে না, আবার তৃপ্ত কিছু বলছে আর টুকটুকি হাসছে, কতটা হাঁসি কথা বুঝে আর কতটা কাঁধে চড়ার মজায় তা সৃষ্টি কর্তাই জানেন। ওরা একে অন্যের কথা বুঝতে পারুক আর না পারুক দুজনের প্রতি দুজনের গভীর মমতা ওরা ঠিকই উপলব্ধি করে চলেছে।
৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আপনি তো দেখছি সত্যিই সুন্দর করে লিখছেন ।
আপনি কি এর আগেও উপন্যাস লিখেছেন ?
আবু জাঈদ
হুম আগেও আরেকটা লিখেছিলাম, তবে পরিপূর্ণ উপন্যাস এটাই প্রথম
খসড়া
চলুক 🙂
জিসান শা ইকরাম
দারুন লাগছে পড়তে
ছোটখাট বিষয়গুলো তুলে ধরছেন , যা একটি ভালো উপন্যাসের জন্য জরুরী ।