কতটা পানির ফোটা দিয়ে সৃষ্টি হয় একটি ঝর্না !! অশ্রু বিন্দু দিয়ে সৃষ্টি হয় যদি কোন নদী , তবে নিশ্চয়ই সে নদীর পানি হবে জগতের সবচেয়ে নীল নদী।  যুগযুগ ধরে দ’দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ১৫২ টি চোখ। সে চোখের অশ্রুবিন্দু এক করা গেলে ঝর্না হয়ে যেত অবশ্যই। কতটা অশ্রু বিন্দু দিয়ে গড়ে উঠে একটি নীল সাগর !!

ছিট মহল । বেশ কষ্টের একটি শব্দ। অধিকারহীন মানুষেরা আমরণ অনশন করেছেন , তাঁদের ন্যূন্যতম মানবিক চাহিদা পুরনের জন্য। বিভিন্ন সময়ে ছিটমহলবাসীর যে তিনটি দাবী করে আসছেনঃ
১. ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে  ছিটমহল বিনিময় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে ৷
২. ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দ্বিমতের কারণ স্পষ্ট করে জানাতে হবে ৷
৩. যদি রাজ্য সরকার অতিরিক্ত জমি বাংলাদেশকে দিতে না চায় তবে  রাজ্য বাজেটে বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নাগরিকত্ব এবং পূর্ণাঙ্গ আইন-শৃঙ্খলা স্থাপন করতে হবে ৷ ছিটমহলবাসীদের সকল দায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে বহন করতে হবে ৷ ছিটমহলের মুসলিম বাসিন্দাদের হজ্বে যাওয়া এবং হিন্দু সমপ্রদায়ের ধর্মীয় কাজ সম্পাদন বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে ৷
তাঁদের এই যৌক্তিক স্বপ্নের দাবী , যে স্বপ্ন তাঁরা দেখে আসছেন ১৯৪৭ এর পর থেকে , তা শুধু স্বপ্নেই থেকে গেছে। চোখের পানি গাল বেয়ে নেমেছে আর শুকিয়েছে এতগুলো বছর।

ছিটমহল , যেন এক একটি অশ্রু বিন্দু
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কুচবিহারের রাজা ছিলেন জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। যার কিছু জমিদারি স্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মধ্যে। অপরদিকে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারের কিছু তালুক ছিল কুচবিহার সীমানার মধ্যে। জমিদার-দ্বয় এ নিয়ে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হন। ফলে ভারতের অভ্যন্তরে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু ভূখণ্ড আর পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পড়ে ভারতের কিছু ভূখণ্ড। যা পরে ছিটমহল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

ফোটা গুলো দু দেশের মধ্যে অন্য দেশের ছিট মহল। ১৯৪৭ এর পর থেকে হয়ে আছে অশ্রু বিন্দু।

বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম এবং কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি ও ভুরুঙ্গামারী থানার কিছু জমি ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা কুচবিহারের অন্তর্গত। জমিগুলো বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। অন্যদিকে কুচবিহার জেলার কিছু জমি বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ, নীলফামারীর ডিমলা, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম এবং কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার অন্তর্গত। এসব জমিও ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা।
ভারতের অভ্যন্তরে সবুজ বিন্দু গুলো বাংলাদেশের ছিটমহল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হলুদ বিন্দু গুলো ভারতের ছিট মহল।

ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি। অপরদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল হচ্ছে ১১১টি। বেসরকারি তথ্য মতে, এসব ছিটমহলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার।
এক নজরে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলঃ
বাংলাদেশের ৫১টি ছিট মহলের আয়তন ৭,১১০.০২ একর , জনসংখ্যা প্রায় ৭০,০০০ ।
ভারতের ১১১ টি ছিট মহলের আয়তন ১৭,১৫৮.০৫ একর , জনসংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০ ।

দুঃখের দিন শুরু

যে সবুজ জমিন ছিল নিজেদের একান্ত পরিচিত , তা হঠাৎ হয়ে গেল এক একটি দ্বীপ। ছোট ছোট দ্বীপের চারিদিকে অন্য দেশ। অবরুদ্ধ দ্বীপবাসীদের অন্যায় এই যে , তাঁরা ওই জমিনে থাকতেন। একই মাটি হঠাৎ আলাদা হয়ে গেল, ডানা ভেঙ্গে গেল আকাশে ওড়া পাখীদের। তাঁরা এখন বাংলাদেশি বা ভারতীয় ছিটমহলের জনগণ , কিন্তু অধিকারহীন। শিক্ষা , চিকিৎসা আইনের শাসন বঞ্চিত নাগরিক। এমনকি মেয়েদের বিয়ে দিতেও সমস্যায় পরছেন এর অধিবাসীরা ।

সমস্যা সমাধানের উদ্যেগ
ছিটমহল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে । কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর উভয় দেশই এসব ভূমির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গঠন করা হয় র‌্যাডক্লিফ মিশন। শেষ পর্যন্ত এ মিশন চূড়ান্ত মিমাংসায় আসতে ব্যর্থ হয়।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর মাঝে বেরুবাড়ি ছিট মহল নিয়ে একটি চুক্তি হয় সেটি ব্যার্থ হ্য় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের এক আদেশে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ছিটমহল সমস্যা সমাধানকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ১৯৭৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় , যা ইন্দিরা মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো অতি সত্বর বিনিময় করতে হবে।’ চুক্তিতে আরো বলা হয়, ‘ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং-১২ এর দক্ষিণ দিকের অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলোর অধিকারী হবে, যে এলাকার পরিমাণ ২.৬৪ বর্গমাইল। বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের অধিকারী হবে। বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে ‘তিন বিঘা’ নামে (১৭৮×৮৫) মি. এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে।’
অবশেষে ১৯৯০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন বিঘা করিডোরের অনুমোদন দিলে ১৯৯২ লের ২৫ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও আবার একটি চুক্তি করেন। এর মাধ্যমে এক ঘন্টা পরপর এক ঘন্টা করে খুলে রাখার সিদ্ধান্ত হয় কড়িডোর। যা মুল ভুখন্ডের সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ,যদিও রাতের বেলা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। ২৪ ঘন্টার জন্য খুলে দেয়ার কথা থাকলেও তা আজো হয়ে উঠেনি।

প্রধান বাঁধা
যে কোলকাতায় বাস করতেন মাদাম তেরেসা, সেই কোলকাতাতেই বাস করেন এক বাঙ্গালী। যিনি মাদাম তেরেসার মানবতার জন্য সেবাকেই ভুলন্ঠিত করার শপথ নিয়েছেন। তিনি মমতা ব্যানার্জি । ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, যে কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট হলেও ছিটমহল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু মমতার আপত্তিতে এখনও সংবিধান সংশোধনী বিলে অনুমোদন দিতে পারেনি কেন্দ্র। ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম ” চুক্তি আনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করেই তার বাস্তবায়ন হবে ” এমন কথা বললেও মমতা পশ্চিমবঙ্গের জমি বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে একেবারেই রাজি নন বিধায় এখন পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হয়নি।

অধিকার আদায়ের দাবী/ আন্দোলন চলছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু মানবতার এই অধিকার আদায়ের দাবী / আন্দোলন বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে রাজনীতির কুটিল মারপ্যাঁচে । এটি ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রধান বাঁধা। এমনটা মনে করেন ভারতীয় সাংবাদিকগণ ও ।

আশার আলো এবং স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন এই বঞ্চিতরা। বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২ টি ছিট মহলের যৌথভাবে হেড কাউন্টিং শুরু হওয়ায় । এরপর ভারতের অনুসমর্থন পাচ্ছে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি এই সংবাদ ছিট মহলের মানুষদের মনে যুগ যুগ ধরে চাপা পরে যাওয়া স্বপ্ন পরনের ক্ষণে উপস্থিত হয়। কিন্তু মমতার কারণে যা পিছিয়ে যাচ্ছে।

দু একটি ব্যতিক্রম বাদে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিট মহলের অধিবাসীরা থাকতে চান ভারতের সাথেই। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিট মহল অধিবাসীরা থাকতে চান বাংলাদেশে। মানবতা বিপন্ন সেখানে। বিপন্ন মানবতাকে রক্ষা ও সম্মান করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

সর্বশেষ খবর : মমতা ব্যানার্জি অবশেষে রাজি হয়েছেন সিট মহল হস্তান্তরে। আশা করা যায় আগামী বিজয় দিবসের পুর্বেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।   এমন খবর প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশের এবং ভারতের টিভি চ্যানেল গুলোতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বঙ্গোপধ্যায়ের ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন বিল পাশে চলতি লোকসভা অধিবেশনে একত্বতা ছিটমহলবাসির মাঝে হাসির ঝিলিক পড়েছে। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসের উপহার স্বরুপ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছিট মহল উপহার দিবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মুদি।

৫৯১জন ৫৯১জন
0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ