মফঃস্বল শহরের এক মহল্লার সব চেয়ে মিশুক, খোলামেলা মনের ছেলেটি লেখাপড়ায় ‘ডাব্বা’ মেরে বড় ভাইয়ের কল্যাণে এক সময় দুবাই চলে যায় । দুই বছর বাদে যখন সে দেশে ফিরল সম্পুরন ৩৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে তার সব কিছুর পরিবর্তন।
কি কথা বার্তায়, কি চলনে বলনে আর কি ভাবসাবে । যে ছেলে শুধু মাত্র তার মিশুক স্বভাবের কারনে পাড়ায় এতো পপুলার ছিল যাদের কাছে , আজ যেন কাউকে চিন্তেই পারছে না অথবা ভাবে গতিকে ‘তোদের সাথে মিলছে না তাই একা একা চলার নীতি’ যেন বেছে নিয়েছে ।
ধরা যাক ছেলেটির নাম আমির ।
তো যাই হোক, আমির দেশে ফিরে এখন শহরের মানুষ গুলোর চলাফেরা নোংরা মনে হয়, ভাষা তো একদম সহ্য করতে পারছে না । ভাব খানা এমন যে এই ভাষায় কোন মানুষ কিভাবে কথা বলে – তা যেন সে ভেবেই পায় না!!
যা হোক, একদিন পাড়ার এক বন্ধুসুলভ বড় ভাইএর দোকানের সামনে একটু জটলা ধরনের দেখে আমি একটু এগিয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখি বড় একটা ঝুড়িতে প্রায় ভর্তি এক ঝুড়ি ছোট ছোট চিংড়ি মাছ, সবাই দরাদরি করছে । তো, আমির সেখানে এসে হাজির এবং যথারীতি অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলঃ হে, এ গুলো কি রে ?
মাছ ওয়ালা বল্লঃ বাইডি, চিঙ্গইর দুরা ।
আমিরঃ কি ????// !!!!!! এর মানে কি ? এটা আবার কেমন মাছ !!!এগুলো মানুষ খায় নাকি ?? …!! যতোসব ছোটলোকি কারবার !! এই মাছের নামও তো শুনিনি কোনদিন !!
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধুসুলভ সেই বড় ভাই ক্ষেপে গেল !
এ আমির্যা হোগার পো’ তুই চিঙ্গইর দুরা চেন না আয় ?? তুই কোম্মে গোনে আইছ আয় !!! হারা জীবন এই মাছ খাইয়া বড় হইছ আর এহন আইছ জমিদারী দ্যাহাইতে ???
হালার পো হালা, তুই কি দুবাইর সুলতানের মেহ্মান হইয়া আছিলি নাহি, জমিদারের পো’ ???
আমির মুখ ভ্যাংচি দিয়ে ওখান থেকে প্রস্থান করতে করতে বল্লঃ ছোটলোক কোথাকার! ভদ্রভাবে কথাও বলতে জানে না !
যাহোক, এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর, আমিও শহর ছাড়লাম। নিজের শহরে যাওয়া হয় না বহুদিন । ঢাকাতে করমব্যাস্ত দিন কাটাই। প্রায় বেশ কয়েক বছর পর নিজের শহরে গেলাম। বাইরে বের হতেই আমিরের সাথে দেখা ।
আরে বাইডি, কেমন আছো ? মোগো কি বুইল্যা টউইল্যা গেলা নাহি। তোমার লগে তো অনেকদিন বাদে দেহা হইল ( আশ্চর্য ! আমিরের ভাষা পুরাই চেঞ্জ !!) সেই আগের আমির- প্রাণবন্ত খোলা মেলা । ভালো লাগলো ।
হঠাৎ দেখি এক মাছ ওয়ালা পাশ দিয়ে যাচ্ছে । আমির ডাক দিলঃ ো মেয়া বাই, হাজি(ঝুড়ি) তে কি ?
-যে, বাইডি, দুরা মাছ !
~ আরে মেয়া আম্নেরেই তো মুই খুঁজি ! নামায়েন দেহি ।
আমি একটু টিটকিরি মারলাম চাঞ্চ পেয়ে ! আরে আমির ভাই, আপনি এই মাছ কিনবেন ! এই টা মানুষে খায় !! এইটা না ছোট লোকের খাবার !
– আরে ধুর মিয়া, মোরে লজ্জা দেও ক্যা ?? এই মাছ পাডায় বাইট্যাঁ যদি বড়া বানাইয়া খাওয়া যায়, এয়ার লগে কোন কিছুর তুলনা আছে ??! কি কও মেয়া !!
আমি হাস্লাম …চলে যেতে যেতে ভাবছি …যাক তুমি ভাইডি লাইনে আইছ তাইলে – ভালো ভালো ।
বল্লামঃ যাই আমির ভাই, দুপুরে বাসায় এসে চিংগইর মাছের বড়া দিয়া ভাত কামুনে- ভাবীরে বইল ।
* চিঙ্গইর দুরা = ছোট ছোট চিংড়ি মাছ কে বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুরা মাছ বলে।
*আমির কিন্তু আর কোনদিন দুবাই ফিরে নাই বা ফিরতে পারে নাই ।
১০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
দুই দিনের যুগী ভাতেরে কয় অন্য–
এমন আমির আমাদের দেশে প্রচুর আছে, যারা নিজের স্বকীয়তা উপেক্ষা করে তথাকথিত ভদ্দরনোক হতে চায়।
এই কাকের ময়ুর হতে চাওয়া নিজের সাথে এক ধরনের প্রতারনাও।
হাস্য রসের মাধ্যমে আপনি খুব ভালো বার্তা দিতে পারেন।
অনেকদিন পরে বরিশালের কিচু শব্দ পেলাম আপনাএ লেখায়
ইচ্ছে করছে বলি- মুইও চিংগুইর ধুরার ভর্তা খুব ভালো পাই 🙂
কবীর হুমায়ুন
\|/ আমার আম্মা চিংড়ি গুঁড়া মাছ পাটা- পুতায় বেটে এক ধরনের গোল গোল বড়া বানিয়ে নারকেল দুধ দিয়ে পাতলা ঝোলের মধ্যে বড়া গুলোকে রান্না করতেন । কি যে অসাধারণ স্বাদ সে খাবার – তুলনাহীন ! ঠিকই বলেচ্ছেন, এটা এক ধরনের নিজের সত্ত্বার সাথে প্রতারনা । ঘটনাটি কিন্তু কাল্পনিক নয় – বাস্তব । এই আমির ( প্রকৃত নাম নয় ) এখনো আমাদের মহল্লায় থাকে। এই ঈদেও তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল । 😀
জিসান শা ইকরাম
আসলেই এমন রান্না করা খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু । খুবই সফট খাবার।
মেহেরী তাজ
দুবাই থেকে এসে আকাশে উঠেছিলেন, আকাশে দেখেন তিনি একা আকাশে, ভয় পেয়ে আবার মাটিতে নেমে এলেন। ভালো লিখেছেন ভাইয়া।
কবীর হুমায়ুন
আপনি যথার্থই বলেছেন ।
মোঃ মজিবর রহমান
কবির ভাই, একদিন খয়ান না। আমার বাড়ী কুষ্টিয়ায় ,
আমরা শুধু ঝল রান্না আর ভত্তা খাই।
তবে আমাদের অনেকেই বিদেশ থেকে এসে এরকম আকাশে উঠে আবার থুপ কইরা অধপতন ঘটে।
সুন্দর ভাল লাগলো।
কবীর হুমায়ুন
ইউ আর মোস্ট ওয়েল কাম । \|/
সীমান্ত উন্মাদ
দারুন মজার জীনিস ভাই। জীহ্বা লকলকাইতেছে
ছাইরাছ হেলাল
শব্দের ব্যাবহারে চমৎকৃত ও আনন্দিত।
কবীর হুমায়ুন
ধন্যবাদ আপনাকে