বাসের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এই অবরোধ এ বাস কোথায় পাব? এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় আম জনতার যেমন পেটে লাত্থি, ঠিক তেমনই আমার পায়ে কুড়াল। জায়গাটা খুবই নির্জন। আশেপাশে বাড়িঘর তো দূরের কথা সামান্য চায়ের দোকানটাও নাই। তাহলে ত একটা সিগারেটের উপর আক্রোশ টা নিভাতে পারতাম। এই এক যাত্রী ছাউনি আর সামনে একটা পিচঢালা রাস্তা। ব্যস। আর কিছু নাই। চারপাশ প্রায় মরুভূমি। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম একটা মেয়ে এদিকেই আসছে। আমিও মনে মনে খুশি হলাম। যাক বাবা, কাওকে তো পেলাম। আর এদিকে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা করা শুরু করেছে। ভাবলাম একটু বসা যাক। কিন্তু মেয়েটা এসেই ২ টা সিটের ১ টাতে বসে পড়লো।
— আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?
চকলেট কালারের ফতুয়া আর জিন্স পরা মেয়েটি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিন্তু কিছুই বললো না। পাশের সিট হতে ব্যাগটা সরিয়ে নিল। তার মৌন সম্মতিতে আমিও সায় দিলাম। তার পাশে বসে পরলাম। মেয়েটা ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। সাথে তার চশমাটাও। বিভুতিভূষন বন্দোপাধ্যায় এর চাদেঁর পাহাড় বইটা খুলতে খুলতে ডান হাত দিয়ে চশমাটা পড়লো। সুন্দরী মেয়েরা লাল কালো ফ্রেমের চশমা পড়লে তাকে আরও সুন্দর দেখায়। আমি বরং নজর সরালাম। কোনোই কাজ নেই। অলস বসে আছি। আর কত? মেয়েটার সাথে একটু কথা বলা যাক।
— আচ্ছা, কয়টা বাজে?
মেয়েটা বই পড়াতে মগ্ন ছিল, মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো, কালো চুলের ভীড়ে আমার দিকে যেভাবে প্রশ্নাতুর চোখে তাকালো, তাতে মনে হল, সত্যিই আমার একটা DSLR এর প্রয়োজন। আমার কল্পনার রাজ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে মেয়েটি বইয়ের দিকে তাকিয়ে পড়া শুরু করে দিল। আমিও উল্টা মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। “মেয়েটি কি বোবা? নাকি গলা ব্যথা? নাকি ভয় পায়? নাকি কথা বলতে চায় না।” — ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে মেয়েটি মুখ খুললো।
— আপনার কাছে কি ঘড়ি বা মোবাইল ফোন নেই?
আমি বড়ই অবাক হলাম। মেয়েটি কথা বলছে, এই ভেবে না বরং তার কন্ঠস্বর শুনে। এতো সুন্দর কন্ঠস্বর একজন মানুষের, কিভাবে সম্ভব। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম, দিব্যি বই পড়ে যাচ্ছে।
— না মানে আমি ত ঘড়ি ব্যাবহার করি না। আর ওদিকে মোবাইল আনতে ভুলে গিয়েছি।
কিভাবে যেন হুড়মুড় করে মিথ্যাটা বলে ফেললাম। একদমই বুঝলাম না। মোবাইল ত আমার ডান পকেটেই ছিল। মোবাইল ছাড়া ত আমি বেরই হই না। তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধারত সৈন্য আর মোবাইল ছাড়া কর্মরত তানজিল একই কথা।
মেয়েটা কালো ব্যাগে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করলো।
— সাড়ে ১২ টা বাজে।
— ও আচ্ছা, ধন্যবাদ।
ছাউনির নিচে আমি আর মেয়েটি। মরুভূমির মতো জায়গায় দুপুরের তপ্ত রোদ আর সাথে শীতল বাতাসের মিশ্রণ এক অপরূপ মাদকতার সৃষ্টি করেছে। শীতল বাতাস বয়েই যাচ্ছে। আর মেয়েটির ঘন কালো চুলগুলো আমার মুখে জ্যাকেটে আছড়ে পরছে। মনে হচ্ছিল, ওরা কোন কিছুর আবেদন করছে। হঠাৎই বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। চুলগুলো আমার জ্যাকেটের ভাঁজে ভাঁজে আটকে রইলো।আমি বরং ওইভাবেই রেখে দিলাম। থাক না, ভালোই ত লাগছে।
— আচ্ছা, আপনি থাকেন কই? আশেপাশে কোথাও? ওহ্, আশেপাশে ত কোন বাড়িঘর নেই। তাহলে?
মেয়েটি কোন সাড়া দিল না। দিব্যি পড়েই যাচ্ছে। আমি অপমানবোধ করছিলাম। মেজাজটাও চরমে যাচ্ছিলো।
— আমি অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলি না।
কোকিলকণ্ঠী মেয়েটা একটু গম্ভীর হয়েই কথাটা বললো। এর উপযুক্ত উত্তর কি হবে ভাবতে লাগলাম, মেয়েটি বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টালো।
— একটা বাচ্চা যখন জন্ম নেয়, তখন তার মাও জানে না যে এটা তার সন্তান। পরে বাচ্চার হাতে লাগানো ট্যাগ অথবা কোড দেখে বুঝতে পারে এটা তার সন্তান। কিংবা নার্স তাকে দেখিয়ে দেয় “এইযে আপনার ছেলে/মেয়ে হয়েছে।”তারপর সেই মা তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার কষ্টের ধন। তাকে কতইনা স্নেহ করে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, পৃথিবী তে সবাই একসময় অপরিচিত থাকে, এমনকি সন্তান তার মায়ের কাছেও।
কথাটা বলেই তার দিকে তাকালাম, সে ত বই পড়াতেই আছে, আমার দিকে তাকালো না। চেহারায় তেমন কোন ভাবও দেখলাম না। সাড়া না পেয়ে মনে হল, আমার যুক্তিটাই বুঝি গঙ্গায় গেল। আবারও নীরবতা চারিদিকে আঁকড়ে ধরলো।
—ভালোই ত যুক্তি দিতে পারেন। বিতার্কিক নাকি?
মেয়েটা আমার দিকে তাকালো, তার মায়াবী চোখজোড়া দেখতে চশমাটা কোন বাধাঁর সৃষ্টি করে না। সর্বোপরি এক মায়ার নেশা আমাকে গ্রাস করতে লাগলো।
—হ্যাঁ, বিতর্ক করেছিলাম। যখন কলেজে পড়তাম তখন। Remians Debating Society তে ছিলাম। এখন আর পারি না।
মেয়েটি খুব সুন্দর একটা হাসি দিল। এতক্ষণে বুঝলাম, মেয়েটি কেন এতো চুপচাপ থাকে। আল্লাহ যাদেরকে এই হাসি দেয় তাদের আর কোন কথা বলার প্রয়োজন হয় না।
— আপনার বাসা কই?
— ঝিগাতলা।
বড্ড লাজুক মেয়েটা আর সাথে বইপ্রেমীও।
— আপনার নাম কি দ্বীপা?
মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তার চেহারার ভাষাই যেন ঠোঁট যুগল কে অলস বানিয়ে দিচ্ছে।
—আপনি কিভাবে জানলেন?
ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। আমিও তার দিকে তাকিয়ে আছি। চোখাচোখি। মেয়েটির প্রশ্নাতুর চাহনি অনেক সুন্দর লাগছিলো।
—আর আপনার বাবার নাম নিশ্চয়ই শফিক আহমেদ?
মেয়েটি এবার আরও অবাক হলো। একটু অসস্তি বোধ করছিল।
— আপনি কি আমাদের চিনেন? আপনার বাসা কোথায়? কি করেন?
— বললাম না? সবাই অপরিচিত। পরিচিত হবার পালায় থাকে।
— কিন্তু তাই বলে আমার নাম জানবেন কিভাবে?
আমি বরং তাকে কিছুই বললাম না। একটা হাসি দিয়ে চোখ সরালাম। মেয়েটা বড্ড ভড়কে গেল। আমার দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
— আপনি আমাকে কিভাবে চিনেন?
আমি আবারও হাসতে হাসতে তার দিকে তাকালাম। মেয়েটার ভয় আর অবাকের সাথে আমার হাসি অঘোষিত যুদ্ধ করছে। একসময় আমার হাসি হার মানলো। ধীরে ধীরে হাসির মাত্রাটা কমিয়ে আনলাম। এবার না হয় আসল কথাটা বলা যাক। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করলাম। ভোটার আইডি কার্ড। তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই তার ভীত চেহারা টা রাগে ভরে গেল। কপালে উঠে যাওয়া ভ্রু নিমিষেই চোখকে ঢেকে দিতে চাইলো। ঈগলপাখির মতো ছো মেরে কার্ড টা হাত থেকে নিয়ে গেল। এই ফাকে তার আঙ্গুলের স্পর্শ পেলাম। সেই স্পর্শে কোথায় আমার স্বর্গে ভাসার কথা ছিল তা ত হলোই না বরং ঝাড়ি শুনতে হল।
—শুনুন মিষ্টার, এভাবে মেয়ে পটানো যায় না, বুঝলেন?
—কি করবো বলেন, আপনি কই থাকেন তাই বলতে চান না। নাম জানবো কিভাবে?
—নাম জানার বোধহয় খুব সখ?
—জানলে ক্ষতি কি?
— আগে বলেন এটা পেলেন কই?
কন্ঠে আরও জোর নিয়ে বললো। আমি মনে মনে বললাম, তানজু, মেজাজ কিন্তু গরম। বি সিরিয়াস।
— আপনি যখন বই টা বের করলেন, তার সাথে কার্ডটিও বের হয়ে গেছে। মাটি থেকেই তুললাম।
—হয়েছে হয়েছে। আর ভালোমানুষী দেখাতে হবেনা। by the way, এটা আমার কার্ড না। বুঝলেন? চেহারা দেখেও বুঝেন না?
আহারে, অবাক করতে গিয়ে দেখি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
— ভোটার আইডি কার্ডে আবার মানুষের চেহারা, হাহাহা, কেওই ত বুঝে না। আর আমি বুঝবো কিভাবে? আচ্ছা, তাহলে কার্ডটা কার?
— আমার বোনের।
মেয়েটা রাগান্নিত কন্ঠে এগুলো বলছিল, কিন্তু কোকিলকণ্ঠীর রাগান্নিত সুর অসাধারণ লাগছে। তার চোখ জোড়া বইতে পড়লো।
—তাহলে তো আপনার বাবার নাম ঠিক আছে। আচ্ছা, আপনার নামটা কি?
—নীপা
সাথেসাথেই অবাক হয়ে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছিল, কোন পাপ করে ফেলেছে। মেয়েটি আমাকে তার নাম বলতে চায় নি। কিন্তু অলস ঠোঁটে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে বুঝাই গেল। ধীরে ধীরে বইয়ের দিকে তাকালো।
যাক বাবা, আর কথা বাড়াইলাম না। কি না কি হয় আবার। ইতোমধ্যেই একটা বাস এসে পড়লো। আহ! কি শান্তি। দাড়ানো কোন লোক নেই সবাই বসা। মনের সুখে উঠে দাড়ালাম। মেয়েটার ওইদিকে কোন খেয়ালই নেই।
— বাস এসেছে, যাবেন না?
—না আমি যাব না। আপনি যান।
একটু রাগত স্বরেই বললো। তিনি আমার উপর অনেক রাগ করে আছেন।
—আপনি যেই বাসে যাবেন আমি সেই বাসে যাব না।
—ঠিক আছে, আমি যাব না। আপনি যান তাহলে।
—আমার জন্য এতো সেক্রিফাইস দেখাতে হবে না আপনার। আপনি যান। যত্তোসব।
— ঠিক আছে। তাহলে আমি যাচ্ছি। আবার দেখা হবে।
আমি বাসের দরজা দিয়ে উঠে তার দিকে তাকালাম।
—চলে আসুন।
আমার কথার কোন পাত্তাই দিল না। কোলে রাখা বইটাই পড়ছে। এভাবে তাকে দেখতে ভালোই লাগছে। দরজার পাশে ২ টা সিট খালি ছিল। একটিতে বসে ভাবতে লাগলাম, মেয়েটি কি সত্যিই আসবে না? জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একটা মায়া লাগছিল। টান অনুভব করছিলাম।
—আপা যাইবেন না? এইডাই কিন্তু শ্যাষ বাস। আইজকা আর বাস আইবো না। যেই দিনকাল পড়সে। গাড়ি নি আবার পুড়াইয়া দেয়।
হেল্পারের হেল্পারি আবেদন শুনে মনে হল, এবার বোধহয় মেয়েটা আসবে। কিন্তু না, তাও হল না।
— গেলে এতোক্ষনে বাসেই থাকতাম। যাব না বলেই এখানে বসে আছি।
মেয়েটির এমন রাগ কখনোই কাম্য ছিল না আমার। হেল্পারও দরজায় এসে দাড়াল। জং ধরা লোহার দরজায় ২ টা বারি দিল।
—ওস্তাদ আগে বাড়েন।
বিকট শব্দে ইঞ্জিন টা গর্জে উঠলো। বিরক্তিকর আওয়াজ টা নিয়েই বাসটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়েই আছি। সে কি আসবে না?
আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই মেয়েটা উঠে দাড়ালো।অবাক হয়ে বাসের দিকেই তাকালো। তাড়াহুড়ো করে বইটা ব্যাগে ভরে নিল। চেইন লাগাতে লাগাতে বললো,
—এই দাঁড়াও, দাঁড়াও।
কিন্তু ইঞ্জিনের বিকট গর্জনে মেয়েটার মিষ্টি সুরের আকুল আবেদন কারোরই কর্ণগোচর হল না। মেয়েটি প্রায় দৌড় দিবে এমন অবস্থা। হেটে সামনে এলো, আর হাত দিয়ে ইশারা করছে,
—আরে দাঁড়াও। থামাও বাস।
মেয়েটি দৌড়ই দিল বলা যায়। কিন্তু সাথে ধীরে ধীরে বাসের গতিবেগ বাড়ছে। মেয়েটিও পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে।ইশারায় থামতে বলছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে রইলাম
—আরে দাঁড়াও বলছি। প্লিজ দাঁড়াও। আমাকে নিয়ে যাও।
আমার পাশের সিটটা খালিই পরে রইলো, বাকি লোকদের মতো আমিও সামনে তাকালাম। আমারও যে বহুদূরের পথ পাড়ি দেয়া বাকি।
কিন্তু এতটা পাষাণ মনের অধিকারী ত আর আমি নই। উঠে গিয়ে ড্রাইভারের কাধেঁ হাত রাখলাম,
—মামা, বাসটা একটু থামাও তো।
৮টি মন্তব্য
মা মাটি দেশ
গল্পটি সুন্দর এবং বনর্নায় চমৎকার (y)
জিসান শা ইকরাম
বাহ ! অসাধারণ —
বুঝতেই পারিনি নায়ক কি করবে , শেষ লাইনের আগে বুঝা সম্ভব ও ছিল না ।
পাঠককে আটকে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে গল্পকারের ।
লীলাবতী
গল্পটি মোবাইলে আগেই পড়েছি , এত মিষ্টি লাগলো যা বলার নয় । প্রিয় গল্পকারের তালিকায় আর একটি নাম যোগ হতে যাচ্ছে মনে হয় 🙂
ছাইরাছ হেলাল
মরুভূমিতে আপনি আর নীপা এই জায়গাটুকু ছাড়া বেশ সাবলীল
ভাবেই এগিয়ে নিয়েছেন ।
চালু থাকুক এই সুন্দর লেখা ।
খসড়া
দারুন লিখেছেন। আপনার হাত আছে।
শিশির কনা
কিন্তু এতটা পাষাণ মনের অধিকারী ত আর আমি নই। উঠে গিয়ে ড্রাইভারের কাধেঁ হাত রাখলাম,
—মামা, বাসটা একটু থামাও তো। 🙂 🙂 (y) অদ্ভুত সুন্দর
নীলকন্ঠ জয়
ভালো ভালো এবং ভালো লাগা… -{@
শুন্য শুন্যালয়
আগেই পড়ে গিয়েছিলাম গল্পটি ..
আপনার ভক্ত হয়ে গিয়েছি ভাইয়া, চমৎকার লেখা.