বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বৃদ্ধাশ্রমটি। খোলামেলা – প্রচুর গাছগাছালি, পুকু্র – পার্কের মতন ছিমছাম করে গোছানো। গেট পেরিয়ে পার্কটায় ঢুকতে ঢুকতে যে কারোরই মন জুড়িয়ে যাবে। জায়গাটা বেড়ানো কিংবা পিকনিক করতে যাবার জন্য চমৎকার একটা জায়গা হতে পারতো। কিন্তু …
কী অদ্ভুত রকম বিষন্ন ! মৃত বাড়িতেও কিছু শোরগোল থাকে। এখানে তাও নেই। অথচ একটু কান পাতলে ঠিকই শোনা যায় বারান্দায় সেট করা সার সার বেঞ্চ ভরে বসে থাকা অসংখ্য অসহায় মা-বাবার গোপন কান্নার কলরব।
কী অসহ্য অসহায়তা এক জনের চোখ-মুখে ! ওই সব মুখের একটি মুখ এর দিকে তাকালেই যেখানে কলজে ফেটে যায় সেখানে প্রায় শ দুয়েক মুখ দেখার জন্য কলিজা জানিনা কী করে হলো আমাদের !
দেখে তো এলাম। কথাও বললাম। তাঁরা কাদলেন, গুমরে উঠলে্ চোখ মুছে ফের হাসলেনও। জড়িয়ে ধরে গালে মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন… আঙ্গুলগুলোর স্পর্শ স্পষ্ট বলে দিচ্ছিলো কতকাল নিজের সন্তানকে আদর করতে না পারার আকুলতায় অস্থির হয়ে আছে।
———–
দল বেঁধে গিয়েছিলাম আমরা প্রায় ৩৮/৪০ জন। জনা দশেক বাদে বেশিরভাগই একেবারে বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। টগবগে উদ্যমি হাস্যজ্জ্বল প্রত্যেকটা মুখ ওখানকার মানুষগুলোকে দেখার সাথে সাথেই মনে হলো কেমন মলিন হয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোনও এক প্রতারিত বাবার গল্প শুনতে শুনতে চোয়াল শক্তও হলো। চোখে জমা হতে দেখলাম অজানা অচেনা কারোর সন্তানের প্রতি তীব্র ঘৃনা।
” কী করে মানুষ এতো পাষন্ড হয়?! আপন মা-বাবাকে কেউ এইভাবে ফেলে রেখে কী করে নিজেরা সুখে থাকে?!”
কোনও কোনও অভাগী অভিমানি মায়ের চোখের জল মুছতে গিয়ে মেয়েদের কেউ কেউ নিজেই কেঁদে ফেললো। জানি সবারই মনে অজস্র অভিযোগ কিন্তু একটি মা’কে পেলাম না, যে তার সন্তানের খারাপ চাইলেন অথবা চাইলেন তাঁদের ছেলেমেয়েরাও বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের মতনই এরকম জীবনে এসে পড়ুক।
ওঁদের দেখছিলাম আর মাথায় ঘুরছিলো নচিকেতার বিখ্যাত এক গা্ন ‘বৃদ্ধাশ্রম’ এর শেষ প্যারাটা…
”খোকারও হয়েছে ছেলে দুবছর হলো
আর তো মাত্র বছর পঁচিশ ঠাকুর মুখ তোলো,
একশো বছর বাঁচতে চাই এখন আমার সাধ
পঁচিশ বছর হলেই খোকার হবে উনষাট ।
আশ্রমের এই ঘরটা ছোট জায়গা অনেক বেশি
খোকা-আমি দুজনেতে থাকবো পাশাপাশি
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষন রকম
মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম ”
জানিনা, গানটা কে লিখেছিলেন। যেইই লিখে থাকুন না কেন, বড় ভুল লিখেছিলেন একজন মায়ের ভাষ্যে। খোকা খুকু মা’কে যত কষ্টেই রাখুক না কেন কোনো মা কি এমন প্রার্থনা করতে পারেন আপন গর্ভজাত সন্তানের জন্য?! কখোনোই নয়। কিন্তু আমরা যারা বহিরাগত, বাইরের মানুষ এঁদের যন্ত্রনা ক্লিষ্ট শীর্ণ মুখ দেখি আমাদের মনে ঠিকই এই কথাগুলো চলে আসে। মন থেকে অজান্তেই অভিশাপ বের হয়ে আসে এমন পাষন্ড সন্তানের জন্য, যারা নিজেদের একটু বাড়তি সুখ সুবিধে বা একটু অসুবিধার জন্য বাবা মা’কে কোনও বয়ষ্ক পূনর্বাসন কেন্দ্রে ফেলে রেখে আসে! অথবা বাবা-মায়েরা বাধ্য হন গায়ের রক্ত জল করে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার ফেলে আশ্রমে ঠাঁই নিতে!
——————-
আমরা যারা সুখে থাকি, তাদের অনেকেই সংসারের বড় বড় ঝামেলায় বিরক্ত হয়ে বলি, ‘বুড়ো হলে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকবো। শান্তিতে থাকবো তাও’
খোদার কসম, ওখানে কেউ শান্তিতে নেই। থাকতে পারে না। থাকা যায়ও না। চাইনা কোনও শত্রুরও অমন জায়গায় ঠাঁই হোক শেষ বয়সে। অপরিচিত একশো সঙ্গির বদলে আপন একজন কেউ হলেও তার হাত ধরে থাকুক মৃত্যু অবধি।
১৩টি মন্তব্য
অরণ্য
লেখাটি ভাবালো আমাকে।
বেশি নাড়িয়ে গেল নিচের ক’টি লাইন; যেন আমিও স্পর্শ পেলাম। 🙁
“তাঁরা কাদলেন, গুমরে উঠলে্ চোখ মুছে ফের হাসলেনও। জড়িয়ে ধরে গালে মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন… আঙ্গুলগুলোর স্পর্শ স্পষ্ট বলে দিচ্ছিলো কতকাল নিজের সন্তানকে আদর করতে না পারার আকুলতায় অস্থির হয়ে আছে।”
সিকদার
খোদার কসম, ওখানে কেউ শান্তিতে নেই। (-3
লীলাবতী
‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটিই কেমন নিঃসঙ্গতায় মোরানো।খুবই কষ্ট লাগে এই কথা ভেবে যে কিছু মানুষ তাঁদের মা বাবাকে এখানে রেখে যায়।আমাদের সমাজ এখনো এত যান্ত্রিক হয়ে যায়নি যে বাবা মা কে এখানে রাখতে হবে।সব বাবা মা ভালো থাকুক সন্তানদের মাঝে।
এমন লেখা হতে বঞ্চিত হচ্ছি আপনি নিয়মিত নন বিধায় 🙁
স্বপ্ন
ফটো থেকে চোখ ফিরাতে পারছি না আপু।কেমন বিষন্ন এক প্রকৃতি। যে পথে হাটে নি অনেক মাস কেউ।খুব কষ্টের এক জীবন এই বৃদ্ধাশ্রম।
ব্লগার সজীব
মন খারাপ হয়ে গেল লেখা পড়ে।আমরা যেন আমাদের প্রিয় বাবা মাকে যত্নে রাখি।
অনিকেত নন্দিনী
কতো নির্মম এ জগত! কোনো একদিন সবকিছু উপেক্ষা করে সন্তানকে বুকে আগলে রাখা এই বাবা-মায়েদের জন্যই শেষ ঠাঁই হয় কিনা বৃদ্ধাশ্রম।
সব বাবা-মায়েরাই ভালো থাকুক, সন্তান সন্ততি নিয়ে সুখে থাকুক।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমটা এখনও মেনে নিতে পারিনি আমরা। আর ওখানকার যা অবস্থা দেখেছিলাম একবার, তাতে বস্তিও ভালো। তবে আমি বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষে। এই যে দেশের বাইরে আছি, বাবা-মাকে দেখার কেউ নেই। আমার বাবা পড়ে গিয়ে কোমড় ভেঙ্গে টানা ১৬ দিন গ্রামের বাড়ীতে পড়ে ছিলো। কেমন অসহায় লেগেছিলো সেটা কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা। ভাগ্য ভালো তখন আমার দেশে যাবার সব ঠিক। এরপর যখন গেলাম ডাক্তারের প্রথম প্রশ্ন আপনারা ১৬ দিন এভাবে উনাকে রেখে দিয়েছেন? সব বললাম। মৌলভীবাজারের গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা একা আমার মায়ের পক্ষে অসম্ভব ছিলো। ৩ সপ্তাহ দেশে ছিলাম, দিন-রাত হাসপাতালে কাটিয়েছি। আমার বাবা-মা আমার কাছে কি, সেটা সবাই জানে। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় থেকে ডাক্তার পর্যন্ত।
এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়েই আমি লিখেছিলাম। ব্লগে দিয়েওছিলাম। বৃদ্ধাশ্রমকে আমি সাপোর্ট করি। তবে দেশে ভালো বৃদ্ধাশ্রম নেই। যদি পারেন আমার বৃদ্ধাশ্রম লেখাটি পড়বেন। কেন আমি এটাকে সাপোর্ট করি, তাহলে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারবেন।
আপনার লেখাটি পড়ে আবেগাপ্লুত হয়েছি। মানুষ তো এখনও মনুষ্যত্ত্ব হারিয়ে ফেলিনি। লেখায় (y)
নিয়মিত লিখুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আমার লেখাটি পড়ে দেখার অনুরোধ রইল
https://sonelablog.com/archives/15434
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সহমত
আমরা আমাদের মা বাবাকে যেন ওমন জায়গায় না পাঠাই -{@
ছাইরাছ হেলাল
আল্লাহ নয়া করুন, আমাদেরকে যেন ওখানে না যেতে হয় বা কাউকে
যেন নয়া পাঠাই।
শুন্য শুন্যালয়
সিমেন্টের একটি বেঞ্চ, অক্ষত, দামী। অযত্নে কেমন শ্যাওলা পড়ে গেছে। যে সন্তান নিজে বাবা-মা হয়েও বুঝতে পারেনা বাবা-মা কি, তার মতো অভাগার জন্ম, শুধু একটি মাথা বৃদ্ধি।
আল্লাহ্ আমাকে অই অবস্থানে না নিক। বড় কস্ট হলো জেনে।
মেহেরী তাজ
একসময় মানে ছোটবেলায় ভাবতাম বৃদ্ধাশ্রম এ মানুষ খুব ভালো থাকে। কারন ওখানে নিজের মত, নিজের বয়সের, কত সঙ্গী থাকে। গল্প করা যায় ইচ্ছামত চলাফেরা করা যায়,চাইলেই দাবা,লুডু খেলা যায়।কত সুখ।
কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথেই বুঝতে শিখেছি সব কিছুর উপরে নিজের পরিবার। আর পরিবার ছেড়ে কেউ ভালো থাকে না,থাকতে পারে না।
জিসান শা ইকরাম
প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি
যতদিন বেঁচে আছি সবার মাঝেই থাকতে চাই
বৃদ্ধাশ্রম যেন না হয় আমাদের শেষ ঠিকান।