সাইকিয়াট্রির ওয়ার্ড চলে তখন। বদলি হয়ে আসা মধ্যবয়সী এক স্যার সাইকিয়াট্রির থিওরি ক্লাসগুলো নিতেন। আমরা তাকে Psycho sir বলে ডাকতাম। একমাত্র এই স্যারটিই আমাদের জোর করে ধরে ক্লাস করাতেন না। অন্য ওয়ার্ডের স্যার জোর করে ধরে রাখতেন, উনারা উনাদের স্পীচ ডেলিভারি করবেনই, আমরা নিতে পারলাম কিনা -সেটা তাদের ব্যাপার না। Psycho sir চল্লিশোর্ধ হলেও বেশ বোঝা যায় যে যৌবনকালে তিনি handsome ছিলেন। অন্য স্যারেরা সবাই তাকে এক নামে চিনত “Dr. Tokai”।
স্যার আমাদেরকে Major depressive disorder,Anxiety disorder,Schizophrenia,Obsessive compulsive disorder(OCD),Bipolar mood disorder,etc. পড়ানোর সময় প্রত্যেকটারএকটি করে case নিয়ে গল্প করতেন। স্যারের বাবার Anxiety disorder ছিল। উনি মনে করতেন উনার টাকা যেকোনোভাবে হারিয়ে যাবে-হয় ব্যাংকডাকাতি হয়ে,নয়ত আত্মীয়স্বজন ঠকিয়ে নিয়ে যাবে। উনি বিশ্বাস করতেন- উনি কিছুদিন পরেই পথে বসবেন,উনার ছেলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, এটা-ওটা টোকাবে। তাই তিনি ছেলের ডাকনাম রাখলেন “টোকাই”। সবসময় প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা করতেন তিনি। স্যার বাবার উদাহরণ টেনে বললেন-“একে বলে Delusion of persecution”। উনি বিশ্বাস করতেন-নিকট আত্মীয়রা সম্পত্তির পিছে লেগে আছে। সৌভাগ্যের ব্যাপার হল,তিনি মা ও আমাকে ছাড়া কাউকে ব্যাপারটা বলতেন না এবং কারো সাথে ঝামেলাও করতেন না। Illness minor form-এ ছিল।” প্রায়ই স্যার পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে নিজের wifeএর এর কথা উল্লেখ করতেন। স্যারের কাছে একদিন তার পরিবারের কথা জানতে চাইলে,উনি বললেন- “কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। সংসার বেশিদিন করা সম্ভব হয়নি,চলে গেছে। তোমাদের ছেলেদের বলছি-বেশি ছোট মেয়ে বিয়ে করবে না। বয়সের gapএর সাথে match করতে পারবে না।” পরবর্তীতে নিজেরা বলাবলি করতে লাগলাম,”বউ ভাগছে ,ভাগবেই তো। পাগলের ডাক্তারের সাথে কেউ থাকতে পারে?”
একদিন স্যার বললেন-“আমার wife কমবয়সী ছিল। রাঁধতে পারত না ঠিকমত। ঘরের কোন কাজই ঠিকমত পারত না। অনেক নরম টাইপ ছিল। সে একবার টিভিতে সিরিয়াল বা মুভি দেখতে বসে, প্রায়ই ভুলে যেত যে, চুলোয় কিছু দিয়েছে। যেদিন বাসায় খেতাম সেদিন প্রায়সময় পোড়াভাত বা পোড়া তরকারি খেতে হত। একবার ছাদে কাপড় নেড়েছে, বৃষ্টি শুরু হল, কিন্তু তার কাপড় আনার নাম নাই, সে নির্বিঘ্নে ম্যাগাজিন পড়ছে। সে ঘুমোতে পছন্দ করত। প্রায়ই রাতে দেখতাম-সে উঠে বসে আমার মোবাইল চেক করছে। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম,ওর চোখমুখ ফুলে আছে। ‘কি হয়েছে?’ জানতে চাইলে বলত ‘কিছু না’। অদ্ভুত লাগত। বিছানায় কোন ধুলো-চুল কিছু থাকলেই সে ঘুমোতে পারত না। দিনে ৫-৬বার করে দাঁতব্রাশ করতো। তখন F.C.P.S part-1 কেবল complete করেছি ।আমি বুঝলাম-ওর কিছু একটা হয়েছে। Guessও করলাম। তোমরা বলতে পারবে?”আমাদের মধ্যে থেকে নাসিম বলল,”OCD”। “হুম”, এরপর স্যার OCD সম্পর্কে বলতে লাগলেন। স্যারের personal life সম্পর্কে আমাদের ইন্টারেস্ট বাড়ল। আরেকদিন আমাদের মধ্যে থেকে তিশা বলল ,”স্যার, আপনার wife কি পড়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলেন?” স্যার একটু হেসে বললেন,”আমি আমার এক স্যারের কাছে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে বুঝতে পারল, আমি তাকে মানসিক রোগী ভাবছি। সে ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না, দিনদিন ভয়াবহ হয়ে উঠল, যখন-তখন অদ্ভুত কথা বলা আরম্ভ করল। সে বলত,’তুমি আমাকে পাগল ভাবো, তাই না? নাকি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার প্লান তোমার? তোমার লাইফে অন্য কেউ এসেছে নাকি? কোর্টে আমাকে পাগল প্রমাণ করে অন্য কাউকে বিয়ে করবে তুমি? আমি কিছুতেই তোমাকে ছাড়বো না।’ আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি বললাম,’তুমি ভুল বুঝছ আমাকে।’ ও বলল,’দেখো, আমি তোমার রোগী নই যে যা খুশি তা বোঝাবে আমাকে?আমি তোমার বউ।” তারপর পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। স্যার যে ওষুধগুলো দিয়েছিলেন খেত না,ফেলে দিত। ওকে কোনোমতেই আর স্যারের কাছে নিতে পারলাম না।
ও মাঝে মাঝেই এদিক-ওদিক ফোন করে আমার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া শুরু করল। লোকজন বাঁকাভাবে দেখা শুরু করল। আমি বেশি রাত করে ফিরলে সে সেদিন থাকতো পুরো অন্যরকম। রাত হয়ে গেলে এটা-ওটা নিয়ে যেতাম ওর জন্য। শুনেছি-বউ রাগলে গিফট দিলে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু ও গিফট ছুঁয়েও দেখত না । আমি ওর কান্ডকারখানায় depressionএ ভোগা শুরু করলাম। একদিন পড়ার সময় মাথা নিচু করেছিলাম। ও পাশে এসে দাঁড়ালো, বলল, “তুমি কি কাদছ?” আমি চুপ করেছিলাম। ও নিজে থেকেই বলা শুরু করল,”আমি জানি,তুমি খারাপকিছু করছো না। কি করব বল?আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।”
কিছুক্ষণ থেমে বলল, “জানো, আমাকে সবাই নিষেধ করেছিল তোমাকে বিয়ে করতে?”
আমি বললাম, ” তাহলে করলে কেন?”
ও হাসল। ওর হাসি সুন্দর ছিল। বলল, “ভাল লেগেছিল ”
“এখন লাগে না?”
“লাগে”
“তাহলে?”
“তাহলে কি? আমি তো তোমার সাথেই থাকতে চাই।”
“তাই?”
“হুম”
“তো আমার কথা শোন না কেন?”
“আচ্ছা,শুনব। তুমি কি চাইছ,আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাই?”
” ছিঃ কি বল? তোমার মত কে আমার জন্য পোড়াভাত রান্না করবে?”
“আমি রাঁধতে পারি না দেখেই কি আমাকে তোমার পছন্দ নয়?”
আমি খানিকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম। ও বলল,” আমার রাঁধতে ভাল লাগে না, মা শিখাতে চেয়েছিল। আমি শিখিনি।”
আমি বললাম,”আচ্ছা শেখা শুরু করো।”
“আমিও তো সারদিন busy থাকি। আমার বুঝি tired লাগে না?”
“তাহলে বললে কেন যে আমার কথা শুনবে?”
তাকিয়ে দেখি সে মুখ গুম করে আছে। বললাম,”আমাকে তোমার ভাল লেগেছিল কেন?” ও কিছু না বলে পাশের ঘরে চলে গেল। ও ভুল করেছিল আমার মত ক্ষয়ে যাওয়া একজন মানুষকে বিয়ে করে। সময় তো শেষ ।অনেক বেশি গল্প করে ফেললাম। আচ্ছা তোমরা যাও।”
আমাদের মধ্যে নানারকম আলোচনা হল। নতুন রেজিস্টার এক স্যারকে উনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম আমরা। psycho স্যারের বউবাচ্চা আছে এমন কথা তিনি শোনেননি।
আমরা ভাবলাম, ব্যাটা নিজেই হয়ত schizophrenic হয়ে গেছে। hallucination হয় স্যারের।
পরেরদিন ক্লাসে স্যার bipolar mood disorder নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। আমাদের ব্যাচের নিম্মি কথা বলার সময় ও কিছুক্ষণ পর পর নড়াচড়া করত। স্যার ওকে দেখে বলে ফেললেন,” আমার wife খুব অস্থির ধরনের ছিল। সবসময় নড়াচড়া করত। রাতে ঘুমের মধ্যে বিছানার ফাঁকা জায়গায় ভ্রমণ করে বেড়াত সে।” বলে খুব হাসলেন। আমরা ধরেই নিলাম-বদ্ধ পাগল স্যার ।
আরেকদিন স্যার বললেন,” তোমাদের canteen এর চা একেবারেই ভাল না। অনেক বেশি মিষ্টি। রজনীও এমন চা বানাতো, চাতে চিনির অনুপাতের কোন idea ছিল না ওর।”
আমাদের ওয়ার্ড replacementএর শেষ দিন। আমরা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,”স্যার, আপনার wife কি এখন সুস্থ?” স্যার স্মিতহেসে বললেন,”হয়ত। কি করে জানব বল? আমার সাথে থাকলে না জানতাম ।”
“আর যোগাযোগ করেনি চলে যাবার পর?”
“চিঠি দিয়েছিল।”
“চিঠি দিল কেন? ফোন তো করতে পারত?”
“চিঠি হচ্ছে one-way communication.Community medicine পড়নি? আমার কাছে থেকে reply/opinion সে চায়নি, যাকে বলে feedback.তাই…”
স্যার কিছুক্ষণ পর বললেন,” চিঠি পড়ে বুঝলাম-আমাকে অনেক ভালবাসে। আমার মানিব্যাগে সবসময় থাকে। ছোট চিঠি, কিন্তু সবটুকু ভালবাসা ঢেলে দেওয়া। এই ভালবাসার সম্পদটি ফেলে দিতে পারি নি। ও লিখেছিল-“তুমি জানতে চেয়েছিলে- তোমাকে ভাল লেগেছিল কেন? যখন তোমাকে দেখি, তোমাকে অন্যরকম বিষণ্ণ মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই মানুষটির বিষণ্ণতা দূর করেই আমি প্রকৃত সুখী হব। আমি চেষ্টা করেছি ,পারিনি।” লক্ষ করলাম, স্যারের চোখের কোণে জল।
©কৃন্তনিকা
১৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
পড়লাম আপনার লেখা
বেশ মজা লাগছিল প্রথম দিকে
শেষে এসে মনটা ভারী হয়ে গেল ।
ভালো লিখতে পারেন আপনি , পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখতে জানেন ।
সোনেলায় স্বাগতম ।
কৃন্তনিকা
পাঠকের প্রশংসা পেলে প্রচণ্ড ভালো লাগে। 🙂 🙂 🙂
সোনেলায় লিখতে পেরে আমার অনেক ভালো লাগছে। 😀
প্রজন্ম ৭১
এত সুন্দর একটি গল্প দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ।
কৃন্তনিকা
আপনাকেও আমার গল্প পড়ার জন্য স্বাগতম। 🙂 🙂 🙂
ছাইরাছ হেলাল
আপনি দেখছি লেখায় ভালই হাত পাকিয়েছেন ।
গল্পের ছলে অনেক অনেক কথা বলে ফেললেন সহজাত সক্ষমতায় ।
স্বাগতম এখানে ।
কষ্ট করে লিখলে পড়ার সুযোগ আমরা পাবই ।
কৃন্তনিকা
ধন্যবাদ। আপনারা পড়লে আমি অবশ্যই কষ্ট করে বারবার লিখব 😀
বনলতা সেন
কত ভালোবাসা , তারপরেও একসাথে থাকা গেলোনা । সত্যির মত করে লিখে ফেললেন ।
কৃন্তনিকা
ধন্যবাদ। 🙂
হুম, জীবনটা এমনই। সাধারণ জীবনেও জটিলতা ও টান-পোড়েন অনেক।
সোনিয়া হক
অসাধারন ।
কৃন্তনিকা
ধন্যবাদ। 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 ….. 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
আদিব আদ্নান
আপনি অনেক অনেক ভাল লেখেন ।
আপনি ডাক্তার !
ভালই হয় , এ বিদ্যায় ও ভাগ বসাতে পারব । জানতে পারব কঠিন সব অজানা ।
আপনার নিকের অর্থ খুঁজে পেলাম না ।
প্রথম লেখার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি ।
কৃন্তনিকা
ধন্যবাদ। 😀
এখনো পুরোদস্তুর ডাক্তার হয়ে উঠিনি 😛
“কৃন্তনিকা” শব্দটি এসেছে “কৃন্তন” থেকে যার অর্থ কাটা( shear শব্দের বাংলা খুঁজলে পাবেন হয়ত)। যা দিয়ে কাটা যায় তাকে বলে “কৃন্তনক” ,আর শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গে “কৃন্তনিকা”। ধারালো যেকোনো কিছুকেই বোঝায়, হতে পারে ছুড়িবটি 😛 মানুষ দিয়ে তো কিছু কাটা যাবে না 3:) , তবে মানুষ ধারালো ব্যক্তিত্বের হতে পারে =D
দ্বিতীয় লেখার জন্য কি ধন্যবাদ পাবো না? 😛
আদিব আদ্নান
আপনার দ্বিতীয় লেখার অপেক্ষা করছি ।
অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন ।
আর এখানে আপনার প্রথম লেখাটি অনেক ভাল হয়েছে বলেই মনে করি
একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে ।
কঠিন কিন্তু সুন্দর আপনার নিকটি ।
কৃন্তনিকা
😀 ধন্যবাদ 😀
আকাশ
চমৎকার লাগলো ।
কৃন্তনিকা
ধন্যবাদ। 🙂 🙂 🙂 🙂 :)…… 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
শিশির কনা
একটি রোগ কিভাবে এমন ভালোবাসাকে দূরে সড়িয়ে দিল । এর চিকিৎসা নেই ?
কৃন্তনিকা
চিকিৎসা আছে। মেয়েটি চিকিৎসা গ্রহণ করেনি, নিজেকে কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ ভাবতে পারে না। 🙁