একজন অনন্য মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য নায়ক খালেদ মোশাররফ, পর্ব ০২

প্রথম প্রতিরোধ,যুদ্ধ শুরু—-
আমি আমার সৈনিকদের বুঝিয়ে দিলাম এখন থেকে আমাদের যে সংগ্রাম শুরু হল সেটা কঠিন বিপদসঙ্কুল । সকলেই নিজেকে স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে দেশ ও জাতির এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্যে আত্মীয়স্বজন, আর্থিক কষ্ট এবং সবকিছু সুবিধা ত্যাগ করে আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে । আমি দেখতে পেলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা আগে থেকেই দৃঢ় সঙ্কল্পে সকল ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। তাঁদেরকে প্রস্তুত হতে বললাম।
প্রথমে আমরা এখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি অংশের সাথে মিলিত হব। অয়্যারলেসে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অবস্থানরত মেজর শাফায়েত জামিলের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাঁকেও প্রস্তুত হতে বললাম। তাঁকে আরও বললাম কুমিল্লার রাস্তার দিকে খেয়াল রাখতে এবং অতি শীঘ্রই চলে আসছি। প্রথমে ল্যাফটেনেন্ট মাহবুবের সঙ্গে কিছু সৈন্য দিয়ে তাঁকে শ্রীমঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে ডিফেন্স তৈরি করতে নির্দেশ দেই যেন মৌলভীবাজার থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এসে বাঁধা দিতে না পারে। শমসেরনগর থেকে জঙ্গলের পথ ধরে আমি আমার কনভয় নিয়ে রাত বারোটায় রওনা দিলাম। রাস্তায় আমাদের গতি খুব ধীর ছিল কারণ সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল জনতা। কোন কোন জায়গায় রাস্তা কেটেও ফেলা হয়েছে। জঙ্গলের অনেক জায়গায় বিরাট গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। অনেক জায়গায় লোকজন লুকিয়ে আমাদের অনুসরন করছিলেন। তাঁরা যখন বুঝতে পারছিলেন আমরা বাঙালি তখন নিজেরাই এসে আমাদের সাহায্য করছিলেন। এভাবে ভোর সাড়ে ৫টায় আমি সাতছড়িতে এসে পৌঁছা লাম। সেখানে আমার সৈনিকেরা কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়।
আমি অয়্যারলেসে পাকিস্তানি অফিসার খিজির হায়াত খানের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে মিথ্যে ‘আশ্বাস দিলেন,সবই ঠিক আছে। ‘  তারপর আমি শাফায়েত জামিলের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আমার থেকে জানতে চাইলেন আমি কোথায় এবং আমার দেরি হচ্ছে কেন ? আমি বললাম ‘ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি খুব কাছেই চলে আসছি।’
সকাল ৬টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১০ মাইল দূরের মাধবপুরে এসে পৌঁছলাম এবং শাফায়েত জামিলের সাথে আবার কথা বললাম। তিনি আমাকে বললেন ‘ সকাল ১০টায় খিজির হায়াত খান একটি কনফারেন্স ডেকেছেন। ‘ আমি পরে জানতে পারি কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসছে। আমি বুঝতে পারলাম এটি বাঙালি সেনাদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র। আমি শাফায়েতকে বললাম ‘ আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবেন না। প্রয়োজন হলে খিজির হায়াত খানসহ সকল পাঞ্জাবি অফিসারদের গ্রেফতার করে ফেলুন এবং যত পাকিস্তানি সৈনিক আছে নিরস্ত্র করুন। বাঁধা দিলে কঠিন শাস্তি দিন। ‘

তারপর সেই মুহূর্ত। দশটা বাজার দশ মিনিট আগে কর্নেল খিজির হায়াত খান,মেজর সাদেক নেওয়াজ,ক্যাপ্টেন আমজাদ সাঈদ কনফারেন্সে বসেছিল। এমনসময় মেজর শাফায়েত জামিল,ল্যাফটেনেন্ট কবির এবং ল্যাফটেনেন্ট হারুন অস্ত্র নিয়ে সেই কামরায় প্রবেশ করেন। শাফায়েত বললেন,
” You have declared war against the unarmed people of our country. You have perpetrated genocide on our people. Under the circumstance we owe our allegiance to the people of Bangladesh and the elected representatives of the people. You all under arrest. Your personal safety is my responsibility. Please do not try to influence others.”
Note- ইংরেজী লেখাটির উৎস কর্নেল শাফায়েত জামিল বীরউত্তমের “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বই।
পাকিস্তানি অফিসার মেজর নেওয়াজ যিনি নিজে একজন কমান্ডো ছিলেন তিনি কিছুটা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি অফিসার ল্যেফটেনেন্ট হারুনের প্রচেষ্টায় তিনি সাথে সাথে ব্যর্থ হন। আর বাইরে যেসব বাঙালি সৈনিক ছিল তাঁরা পাঞ্জাবি সৈনিকদের নিরস্ত্র করতে বাধ্য করেন। যারা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের চরম শাস্তি প্রদান করা হয়।

দিনটি ছিল ২৭ মার্চ। সকাল ১১টায় আমার বাহিনী এবং মেজর শাফায়েতের বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মিলিত হয়। আমি বুঝতে পারলাম আমার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে যেসব এলাকা শত্রুমুক্ত আছে তা পাকিস্তানিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। এমতবস্থায় আমি আমার সাথের অফিসারদের নিয়ে একটি বৈঠক করি এবং পরবর্তী ডিফেন্স প্রতিষ্ঠায় সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি জানতে পারলাম মেজর সফিউল্লাহ ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ এসে তাঁর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একত্রিত করেছেন। আমি জানতে পারলাম তিনি মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য নিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এই খবর পেয়ে আমি অতিশয় উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারণ আমি জানতাম ঢাকায় পাকিস্তানিদের অন্ততপক্ষে দুটো ব্রিগেড সৈন্য আছে। তাছাড়া সাঁজোয়া বাহিনীর ট্যাংক, গোলান্দাজ বাহিনীর কামান এবং বিমান বাহিনীর বিমান আছে। এসব আধুনিক এবং অসম্ভব শক্তিশালী । এমন সময় অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে ঢাকায় লড়তে যাওয়া মানেই আমাদের শক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া। কিন্তু এই সর্বনাশকে রুখতেই হবে। আমার সাথে শফিউল্লার যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা ছিল না। অনেক চেষ্টায় আমি একটি খালি রেলওয়ে ইঞ্জিনের ব্যবস্থা করতে পারলাম। তারপর ল্যাফটেনেন্ট মাহবুব সেই ইঞ্জিনে বসিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে সোজা কিশোরগঞ্জে পাঠিয়ে দিলাম মেজর সফিউল্লাহর কাছে। আমি উনাকে মেসেজ দিলাম এবং অনুরোধ করলাল কোন কিছু করার আগে যেন তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং সম্ভব হলে আমার সাথে দেখা করেন।
পরে সফিউল্লাহ একটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং শেখ মুজিবের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত S-Force মেজর সফিউল্লাহ গঠন করেছিলেন।

সুত্রঃ “খালেদের কথা”।
লেখকঃ মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া

৭৭৬জন ৭৭৬জন
0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ