
রেলের কামরাটা বড় ফাঁকা।
এখন মধ্যরাত তাই যাত্রী নেই তেমন। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে জানলার পাশে এই ফাঁকা রেলের কামরা আমার এখন মনে হচ্ছে এক টুকরো স্বর্গ।
চারপাশটা এতো শান্ত! ট্রেনও চলছে যেনো শব্দকে ফাঁকি দিয়ে।
খুব করে মনে হচ্ছে এ ট্রেনের একটা সিট আমার হোক আমাকে নিয়ে সে চলতেই থাকুক আমার লিখিত মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত।
আমি খেয়া, আমার সাথে এ ট্রেনের খুব মিল যেনো।
বড় যত্নে তাকে যাত্রী টানার মতো তৈরি করে একটা সামন্তরাল রেখার উপর ছেড়ে দিয়েছে এর কারিগর।
এ ট্রেনের নিশ্চিন্ত কোনো স্টেশন নেই চলতেই হবে চলতেই হবে। যাত্রীকে পৌছাতে হবে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে বড় নিরাপদে। থামলেই ভাগাড়ে ফেলে রাখবে কারিগর।
যাত্রী টানার অক্ষমতা ট্রেনের বগি বা ইঞ্জিন কারোরই কোনো দাম নেই। তেমনি আমারও নেই কারণ আমি দু’দণ্ড থেমেছিলাম আমার জন্য। আমার সেই থামার নাম ‘বিদ্রোহ’ আমার সাথে অ’কেজো ট্রেনের পার্থক্য তবু অনেক এর যন্ত্রাংশ কেনার বা কাজে লাগানোর সুযোগ আছে অনেক। আমি ঠিক সেই টুকরো অংশ যা কেনার কোনো ক্রেতা নেই। আমি যেনো একেবারে জং ধরা এক লোহার প্লেট যা পড়ে পড়ে একসময় মাটির অতল তলে তলিয়ে যাব।
আজ আমার মুক্তি হয়েছে সংসার থেকে। আমি ভাগাড়ের পথে যাত্রা শুরু করেছি।
আচ্ছা! মানুষের ভাগাড়ও হয়? মানুষের ভাগাড় দেখতে কেমন আমি আজ তা দেখতে পেলাম।
একটু আশ্রয়, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের কোনো সম্ভাবনাই আমার নেই। এতোটা অসহায় মানুষ হতে পারে!!
খুব কষ্টে একটা বৃদ্ধাশ্রমে আমার দেখাশোনার কাজ হয়েছে। এক বান্ধবী তার এ মহৎ কাজটার সাথে আমাকে যুক্ত করেছে। পূণ্য ছিলো হয়তো কিছু তাই পেয়ে গেছি চটজলদি।
সংসারে নারী যদি বিদ্রোহ করে সে সংসার কোনোকালেই টিকে না। সংসারে বিদ্রোহ শব্দটা একচেটিয়া একার পুরুষের।
বেঁধে দেয়া একটা গোটা জীবন প্রতিনিয়ত কম্প্রোমাইজ করে গেছি। কোলের সন্তানটি ঠিকমতো মানুষ হোক ভালবাসার বন্ধনে এই ভাবনায় সকলের সিদ্ধান্ত শুধু মেনে নিয়ে গেছি।
একজীবনে বাবা মায়ের তারপর স্বামীর তারপর সন্তানদের। না, আমার সন্তানদের দোষ নেই। তারা আমাকে চেয়েছে তাদের কাছে রাখতে।
আমি আমার এই শেষ আত্মসন্মানটুকু বিসর্জন দিতে চাইনি আসলে।
সিদ্ধান্ত দেবার মতো অটল মোনোবল মেয়েরা পেলো না যে কেনো সেই প্রথম জীবনে!
কিসের যে এতো ভয়! সমাজ নামক জুজুবুড়ি যেনো ওৎ পেতে বসে থাকে নারীর ভুল ধরার জন্য।
বড় অভিমানে যখন স্বামীর সাথে একান্ত অনুভূতির প্রকাশ ঘটে না শরীর কথা বলে না তবু সংসার নষ্ট না করে তা চলমান রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলে তখন শুনতে হয়, ‘তুমি তো আমাকে ভালবাসোনি বেসেছো সংসারটাকে!’
নারীর সংসার কি শুধু সংসারে থাকা গোটা কয়েক আসবাব, হাঁড়ি পাতিল!
মুখে বলেই কি সব প্রকাশ হয়? প্রকাশের তো আরও সংজ্ঞা আছে,, সে সংজ্ঞা বুঝতে বা বোঝাতে না পারার দায়টা যে কার!
এই আটচল্লিশ বছর বয়সে এসে আমি আজও বুঝলাম না আসলে সংসার কি, ভালবাসা কি, দায়িত্ববোধ কি, একান্ত নিজস্ব আমার কি।
আমি আসলে ভেবেছি জীবন সংসার মানে ছন্দময় এক গীতিকবিতা।
যার তাল না মিললেও এক সুন্দর অর্থবোধক শেষ পরিণতি আছে।
আমার যে কোথায় তাল কেটে গেলো!
সতেরো বছরে সম্পূর্ন অচেনা মানুষের সাথে এক পথ চলা শুরু।
তার এক নিজস্ব জীবন ছিলো যা সে আজীবন যত্নে রাখতেন। আমাকে কখনো তাতে ঢুকতে দেননি। আমিও আমার স্বভাবমতে সেদিকে অকারণ উঁকি দেইনি।
থরে থরে সাজানো তার প্রাক্তনের চিঠির ভাঁজে আমিও আমার আবেগকে কবর দিয়ে ফেলেছিলাম। কি অদ্ভুতভাবে এখন খেয়াল করলাম আসলেই তো আমি কোনোদিন তো তার গায়ে স্পর্শ করে দেখলাম না, কেমন সে অনুভূতি!
কতোটা আবেগে একটা বুকে মাথা রাখা যায়, সে সব অনুভূতিরা একটা গোটা জীবন আমার আর অনুভব করা হলো না।
আমি তখনই যেনো বুঝে গেছিলাম এ সংসারে আমার আগমন আদতে কিছু দায়িত্বের জন্য। তার ভাইবোন মানুষ করা তার অসুস্থ বড় বোন ও মা বাবার সেবা করা। হ্যাঁ, তারা সবাই যার যার অবস্থানে বড় হয়েছে মানুষ হয়েছে।
অ’সাংসারিক প্রেম নামক অনুভূতির বিপক্ষে একটা সাংসারিক আটপৌরে জীবন আমার পার হয়েছে চুপচাপ। এক কাপ চা মুখোমুখি বসে খাওয়ার সময়ক্ষনটা কেমন অনুভূতি আমার তা জানা নেই।
অথবা
‘খুব বৃষ্টি হচ্ছে তাড়াতাড়ি বাসায় এসো’ এই কিছু শব্দের অপচয় হয়নি। হয়তো বয়সের পার্থক্যটাও বড় ব্যাপার ছিলো।
ভেবে দেখলাম কারো কারো ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানে ভালবাসা লাগে না, সেখানে জৈবিক আলোড়নটাই সত্যি।
কি অদ্ভুত কি বিশ্রি পুরুষের চিন্তা ভাবনা!
ভালো না বেসেও একটা শরীরে লুটিয়ে পড়তে পারে!
কলেমা পড়ে কিনে নেয়া শরীরের অনুভূতির অনুমতি লাগে না। এ ক্ষেত্রে তাদের কাছে ভালবাসার দৃষ্টি বিনিময়টা মূখ্য নয়। শরীর কর্মটাই মূখ্য।
কেনো যে সেই উঠতি বয়সে বুদ্ধদেব পড়তে গেছিলাম! নিজের ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে তার কাছে নিজের জন্য ভালবাসার সেই আবেগ ভিক্ষে চাইতে পারলাম না। নিজেও হাত বাড়াতে পারলাম না।
প্রতিবার মনে হতো আমি মরা লাশ,,নির্জীব পড়ে আছি। নিজের যেনো কোনো আলোড়নই নেই।
এ ক্ষেত্রে মন আমার সব সময় মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ এর সাথে মিলে যেতো।
কি দারুন মেলবন্ধন তাদের!
আমি প্রতিবার ভাবতাম, আমাকে চেষ্টা করতে হবে।
সবাই পারলে কেনো আমিও পারব না!
কিন্তু ঐ যে ভালবাসার স্পর্শও তো দরকার শরীর মন মস্তিষ্ককে জাগাতে, একই অবস্থানে আনতে!
হলো না আর এ জীবনে।
বড় রাগে জিদে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থেকে বের হয়ে বিয়ে তো করেছিলো হুট করে কিন্তু মনের যায়গাটা সে তারই আশ্রয়ের জন্য রেখেছে।
আমি সব সময় সবার ভালবাসা প্রেমকে শ্রদ্ধা করে এসেছি। তাই অকারণ শব্দ দূষণ আমার হয়নি কোনোকালে এ সব বিষয়ে।
সব সময় মনে হতো প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব নিজস্ব অবস্থান আছে।
কেউ কারো যায়গা নিতে পারে না। আজ আমার সে ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। তার অভিযোগমতে আমি শুধু যে সংসারটাকে ভালবেসেছি সেই সংসারে আজ তার প্রাক্তন এসে সব গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। আমার স্বামী উপলব্ধি করেছে তার প্রাক্তনের তাকে ছাড়া আর কোনো আশ্রয় নেই,, তার ভালবাসার প্রকাশ সে উপলব্ধি করেছে আমার অপ্রকাশিত ভালবাসা সেখানে বেমানান।
আমিও ফিরে চলেছি আমার পিছন পথে সবাইকে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছে দিয়ে।
আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমার একার শূন্য সংসার অ’কুশলসূচক।
কি ভাবছেন, নিরবে কেনো ফিরে যাচ্ছি?
নিঃশব্দের প্রতিশোধ বড় প্রতিশোধ।
আমি খুব চাই, আমাকে সে মনে রাখুক বড় শ্রদ্ধায়। যদি কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়ায় মাথা নীচু করে দাঁড়ায়। ভালবাসার চেয়ে শ্রদ্ধা আমার কাছে বড় মূল্যবান।
ট্রেন থেমে গেছে আমার গন্তব্যের স্টেশনে, আমাকে নামতে হবে এবার। যেখানে অপেক্ষা করছে আমার একার শূন্য এক সংসার।
,,জাহান,, রংপুর।
আজ: ১৮ আষাঢ়
১৪২৯ বঙ্গাব্দ,শনিবার,
৩ জুলাই ২০২২
শুক্লপক্ষ।
১২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
লেখার শেষে শুক্ল পক্ষ লিখছেন, কিন্তু জীবন নামক গন্তব্য হীন রেলগাড়িটি সাক্ষাৎ
কৃষ্ণ পক্ষের দিকে এগুচ্ছে। অ-কুশলসূচকতা নিয়ে, এটাই হয়ত প্রকৃতির নিয়ম, এটি ই হয়ত নিয়মের গ্যাঁড়াকল।
গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা দেখতে পাচ্ছি।
ভাল হয়েছে বলে চাই-ই।
রিতু জাহান
তিথিমতে শুক্লপক্ষ।
জীবনের যা-ই ঘটে যাক তিথি তো আর পাল্টায় না।
সে যে নিয়ম মেনেই চলে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ গুরু,,
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভালোবাসাহীন সম্পর্কে একজন সবসময়ই একা। যৌবনে হয়তো বুঝতে পারে না, কিন্তু একটা সময় মায়া নামক জাল থেকে বেড়িয়ে যেতেই হয়!!! রেলের সেই অপ্রয়োজনীয় টুকরোর মতো।।।
গল্প সুন্দর হয়েছে।
রিতু জাহান
হুম,,, যেতেই হয়।
অনেক ধন্যবাদ রুকু।
ভালো থেকো,, পাশে থেকো।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
সুন্দর সাদৃশ্য নিরুপণ।
জীবনের পথটাই বড় অদ্ভুদ!
কার কাছে কিভাবে দেখা দেয় ভাবাই যায় না।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
রিতু জাহান
আসলেই বড় অদ্ভুদ,,
শুভেচ্ছা নিবেন। ভালো থাকবেন
মনির হোসেন মমি
তবুও সংসার নামক জগৎটার জন্যই মানুষ মরিয়া হয়ে উঠে।
পুরুষ জীবনে আক্ষেপ থাকলেও নারী জীবনের আক্ষেপটা বড় করুণ ।সকল কিছু উজার করে দিয়েও যেনো সংসারে নারীর অবদান জিরো।
জীবনবোধমুলক গল্প।চমৎকার উপস্থাপনা।
রিতু জাহান
কেনো যে সংসারে এতো জটিলতা!
কেনো যে সবকিছু সহজে গ্রহন হয় না,,
অনেক অনেক ধন্যবাদ মনির ভাই।
হালিমা আক্তার
নারী সবজায়গাতেই অবহেলিত। প্রতিবাদ করলে নারী ভালো না। নারীর জন্মই যেন মানিয়ে চলা আর মেনে নেওয়ার জন্য। সংসার ভাঙ্গলে নারীর দোষ। সে কেন মানিয়ে নিল না। সংসারের নারী ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আবার মুহূর্তেই তাকে ভাগাড়ে ফেলতে সময় লাগে না। খুব সুন্দর গল্প। শুভ কামনা রইলো
রিতু জাহান
ধন্যবাদ আপু,,,
সৃষ্টির শুরুটা মনে হয় এমন ছিলো না,,, ধীরে ধীরে এমন হয়ছে। আদিমতাই মনে হয় ভালো ছিলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
মানুষের মন বিদ্রোহী হলে তার গতি বাড়ে, কিন্তু নারীমন বিদ্রোহী হলে তার গতি-গন্তব্যর কদর হয়না সংসারে-সমাজে। সমাজ সংসারের জটিল সব নিয়মের আবর্তে ঘুরপাক খেতে হয়। বয়সের পার্থক্য অনেক সময়েই মনের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে অক্ষম।
মাঝি বিহীন খেয়াও এক সময় ঠিকঠাক তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এমন কোথাও যেখানে কাউকে পারাপারের তাড়া থাকে না, হয়তো সেখানেই তার প্রত্যাশিত বিশ্রাম অথবা সমাপ্তি।
শুভ কামনা 🌹🌹
রিতু জাহান
দারুন মন্তব্য,,
খুবই সুন্দর বললেন আপু। বয়সের পার্থক্যে মনে হয় প্রেম থাকে না।
আমি আমরা সেদিন বান্ধবীরা দুষ্টমি করে বলতেছিলাম, আমরা বৃদ্ধ বয়সে এক যায়গা থাকব।