হুমায়ুন আজাদ, যার শুন্যতা এই বাংলা অনুভব করে এখনো। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, বলতে গেলে সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় নিজের প্রতিভার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার বিকাশ ও চর্চা মূলত পশ্চিম বঙ্গ কেন্দ্রীক ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক কবিতা চর্চার দিক দিয়ে হুমায়ুন আজাদের নাম শামসুর রাহমানের সঙ্গে একই ব্রাকেটে আসার যোগ্য। বিষয়বস্তু আর ধারালো শব্দের ব্যবহারে হুমায়ুন আজাদের কবিতা অনন্য। তার কবিতার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায় আজকের যুগেও। মোটা দাগে হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, বিবমিষা আর প্রেমই হুমায়ুন আজাদের কবিতার বিষয়বস্তু। ব্যক্তি আজাদ নির্ভীক ছিলেন। তার কবিতায়ও নির্ভীকতার ছাপ ষ্পষ্ট।
অসাম্প্রদায়ীক জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা হয়, সেই রাষ্ট্রটির চরিত্রের সামগ্রিক পতন নিয়ে হুমায়ুন আজাদ হতাশাগ্রস্থ ছিলেন। তিনি হতাশ ছিলেন দেশে সামরিক তন্ত্রের উত্থান নিয়ে, সাম্প্রদায়ীকতার পুনর্জন্ম আর সমাজের প্রতিটি অলিন্দে মাফিয়াদের উত্থানও তাকে প্রবলভাবে হতাশ করেছিল। তার এই হতাশা ফুটে উঠেছে অসংখ্য কবিতায়। হুমায়ুন আজাদ স্কুল লাইফ থেকে কবিতা লেখা শুরু করলেও ঢাকা ষাটের দশকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি মুলত কবিতা চর্চা শুরু করেন । সেই সময়কার লেখা কবিতাগুলো নিয়ে তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ষাটের দশকে আইয়ুব শাহের সামরিক শাসনামলে তিনি ছিলেন ছাত্র এবং পরবর্তীতে তার কর্মজীবনের বড় একটা অংশ তাকে বাস করতে হয়েছে শক্তিমান স্বৈরাচারী সামরিক তন্ত্রের মধ্যে। সামরিক তন্ত্র আর লুটপাটের রাজনীতির প্রতি তীব্র শ্লেষ আজাদের কবিতার একটা কমন বিষয়বস্তু। যে সামরিক তন্ত্রের মধ্যে তিনি বাস করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, সেই সামরিক তন্ত্রকে তিনি কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তার কাছে ট্যাংক, কামান, ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে কৃষকের বোনা ফসল অধিক বেশি মহৎ, অধিক বেশি সৃষ্টিশীল, অধিক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের গরীব দেশ (সরকারের ভাষায় মধ্যম আয়ের দেশ) , সাউথ এশিয়ান নেশন্স ইকোনোমিক মডেল (সানেম) নামক একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী সাম্প্রতিক করোনার কালে এদেশে দারিদ্রের হার চল্লিশ ভাগ ছাড়িয়েছে, যেটা করোনার আগে ছিল শতকরা বিশ ভাগ। যে দেশের মানুষেরএকটা বড় অংশ খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্যসেবার মত মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত, সেই দেশের সীমিত সম্পদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ খরচ করে ভবিষ্যতের কাল্পনিক যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে সামরিক বাহিনী লালন পালন করা কতটা যুক্তিযুক্ত সেই প্রশ্ন উঠে আসে তার কবিতায়-
আগাছা ছড়াই, আল বাঁধি, জমি চষি, মই দিই
বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর
দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালি
খেত ভরে, আসলে রক্তই ঢেলে দিই
নোনা পানি রুপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হলে
খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।
খরা, বৃষ্টি, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে
প্রকৃতির কৃপা হলে এক সময়
মুখ দেখতে পাই থোকা থোকা সোনালি শস্যের
মূর্খ মানুষ, দূরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে
দিন রাত লেফ রাইট-লেফ রাইট করলে ক’মন শস্য ফলে
এক গন্ডা জমিতে?
-(তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন, কাব্যগ্রন্থঃ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
করোনা মহামারী আসার আগে থেকেই গোটা পৃথিবীই যেন ধর্ম আর জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় মাতাল। দিকে দিকে চলছে ওয়ার, প্রক্সি ওয়ার, ফায়ার-ক্রসফায়ার। রাইফেল, ট্যাংক, কামান আর ক্ষেপনাস্ত্রময় পৃথিবীতে বাস করেও প্রখর মানবতাবাদী আজাদ স্বপ্ন দেখতেন একটা যুদ্ধ-সমরাস্ত্র বিহীন মানবতাবাদী পৃথিবীর। বিশ্বজুড়ে চলমান ধর্ম আর জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় মাতোয়ারা রাষ্ট্রীয় আস্ফালনের বিপক্ষে আজাদের কবিতার লাইন যেন মানবতাবাদী প্রার্থনা রুপে দাঁড়ায় আমাদের সামনে।
কিন্ত না, পৃথিবীতে আর কোনো নেকড়ে থাকবে না কিন্ত না, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক থাকবে না পৃথিবীতে আর কোণ শিরস্ত্রাণ থাকবে না পৃথিবীতে আর কোনো বুট থাকবে না। পৃথিবীতে থোকায় থোকায় জলপাই থাকবে কিন্ত কোনো জলপাই রঙের পোশাক থাকবে না আকাশ ভরা তারা থাকবে কিন্ত কারো বুক ভরা তারা থাকবে না পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না। -(পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না, কাব্যগ্রন্থঃ সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)
আগেই লিখেছি, হুমায়ুন আজাদ হতাশ ছিলেন লুটপাটের রাজনীতি আর সমাজের নানা প্রান্তে মাফিয়াদের ক্রম বর্ধমান উত্থান নিয়ে। মুলত ৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসনামলে এদেশে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি শুরু হয়। পরবর্তীতে “গণতান্ত্রিক” শাসনামলে তা আরো বিস্তৃত হয়। এই লুটপাটের রাজনীতি, দুর্নীতি আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিকাশের সুবাদে বাংলাদেশ আজ ২০২০ সালে এসে ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে তৃতীয়, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে প্রথম! দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, দুর্নীতি আর বিচারহীনতার মধ্যে দিয়ে এই রাষ্ট্রের প্রতিটা স্তম্ভ যে ক্রমশ নষ্টদের হাতে চলে যাচ্ছে সেই হতাশা ফুটে উঠেছে আশির দশকে লেখা নিচের কবিতাগুলোয়।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে নষ্টদের দানব মুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক সব সংঘ পরিষদ; চলে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে চলে যাবে এই সমাজ সভ্যতা -সমস্ত দলিল নষ্টদের অধিকারে ধুয়ে মুছে, যে রকম রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে। – (সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, কাব্যগ্রন্থঃ সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)
যদি আপনার কোনো মগজ না থাকে, শুধু পেশি থাকে যদি আপনার কোনো হৃৎপিণ্ড না থাকে, শুধু লিঙ্গ থাকে যদি আপনার কোনো ওষ্ঠ না থাকে, শুধু দাঁত থাকে তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি যদি আপনি অবলীলায়, একটুও না কেঁপে, শিশুপার্কে একঝাঁক কবুতরের মতো ক্রীড়ারত শিশুদের মধ্যে একের পর এক ছুঁড়ে দিতে পারেন হাতবোমা। যদি আপনি কল্লোলমুখর একটা কিন্ডারগার্টেনে পেট্রল ছড়িয়ে হাসতে হাসতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন প্রাতঃরাশের আগেই এবং পকেটে হাত রেখে সেই দাউদাউ অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে খুব স্থিরভাবে টানতে পারেন ফাইভ ফিফটি ফাইভ হ্যাঁ, তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি। যদি আপনি প্রেমিকাকে বেড়াতে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর খুন করে ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে একশো মাইল বেগে সাইলেন্সারহীন হোন্ডা চালিয়ে ফিরে আসতে পারেন ন্যাশনাল পার্ক থেকে কলাভবনের বারান্দায় যদি আপনি অকস্মাৎ বেল্ট থেকে ছোরা টেনে নিয়ে আমূল ঢুকিয়ে দিতে পারেন সহপাঠীর বক্ষদেশে, যদি আপনি জেব্রাক্রসিংয়ে পারাপাররত পথচারীদের ওপর দিয়ে উল্লাসে চালিয়ে দিতে পারেন হাইজ্যাক করা ল্যান্ডরোভার তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি যদি আপনার ভেতরে কোনো কবিতা না থাকে, শুধু হাতুড়ি থাকে যদি আপনার ভেতরে কোনো গান না থাকে, শুধু কুঠার থাকে যদি আপনার ভেতরে কোনো নাচ না থাকে, শুধু রিভলবার থাকে যদি আপনার ভেতরে কোনো স্বপ্ন না থাকে, শুধু নরক থাকে তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি যদি আপনি পিতার শয্যার নীচে একটা টাইমবোম্ব ফিট করে যাত্রা করতে পারেন পানশালার দিকে, যদি আপনি জননীকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন টাওয়ারের আঠারো তলার ব্যালকনি থেকে যদি আপনি আপনার এলাকার ফুলের চেয়েও রূপসী মেয়েটির মুখে এসিড ছুঁড়ে তাকে রূপান্তরিত করতে পারেন পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দুঃস্বপ্নে তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি হ্যাঁ, আপনাকেই নিয়োগ করা হবে আমাদের মহাব্যবস্থাপক আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সমাজের আপনার ওপর ভার দেয়া হবে রাষ্ট্রের আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সভ্যতার আপনার খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ করা হবে গুদামের পর গুদাম ভর্তি বারুদ আপনার চিত্তবিনোদনের জন্যে সরবরাহ করা হবে লাখ লাখ স্টেনগান আপনিই যদি হন আমাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রতিবাবান পুরুষ তাহলে, পোস্টবক্স: বাঙলাদেশ ১৯৮৬-তে আজই আবেদন করুন। -(বিজ্ঞাপন)
যে বাংলার নয়ানাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার চোখে মুগ্ধতার আবেশ দিয়েছিল, যে বাংলার শিশির, কুয়াশা, আশ্বিনের চাঁদ, ঘাসফুল, নদী, মেঘ আর বৃষ্টি তার মধ্যে অমরত্বের আকুলতা জাগিয়েছিল , সেই বাংলার বুকে জন্মানো নষ্টদের নিয়ে আক্ষেপ আর অভিমান ঝরে পড়েছে তার কবিতায়-
যে তুমি ফোটাওফুল, ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ জমিতে বিছিয়ে দাও ধান, শিম খিরোই তরমুজ কুমড়োর সুস্বাদ, যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধে ব্যাকুল সেই তুমি বাঙলা, কেমন করে সেই তুমি কেমন করে দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছ পালে পালে শুয়োর কুকুর? -(যে তুমি ফোটাও ফুল, কাব্যগ্রন্থঃ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)
সমালোচকদের মতে ব্যক্তি হুমায়ন আজাদ দাম্ভিক ছিলেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ক্রমবর্ধমান পতন, সমাজের প্রতিটা কোণ ধীরে ধীরে “নষ্ট”দের হাতে চলে যাওয়ার হতাশার সঙ্গে কি খানিকটা দাম্ভিকতাও প্রকাশ পেয়েছে নিচের কবিতায়?
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙ্গুলের দাগ আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণূ আমার নিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দুষণ আমি জন্মে ছিলাম, আমি বেড়ে উঠেছিলাম আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে। আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিল , তা দেখতে পায়নি তখনো আমার সময় আসেনি। আমার পা যে পথে চলতে চেয়েছিল, সে পথে চলতে পারেনি তখনো আমার সময় আসেনি। আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিল, তা নিবেদন করতে পারেনি তখনো আমার সময় আসেনি। আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিল, তার ছোঁয়া পায়নি তখনো আমার সময় আসেনি। আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাইনি তখনো আমার সময় আসেনি। তখনো আমার সময় আসেনি আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে। -(আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে, কাব্যগ্রন্থঃ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)
ঘুরেফিরে হুমায়ুন আজাদের কবিতায়ও প্রেম এসেছে, এসেছে বিরহ, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় প্রেম ঠিক যতটা না হৃদয়ের, ঠিক ততটাই শরীরের। রবীন্দ্র ধারার বাইরে বাংলা কবিতায় শারীরিক প্রেম প্রকাশের যে ধারা বুদ্ধদেব বসুরা শুরু করেছিলেন, হুমায়ন আজাদ সেই ধারাকেই টেনে নিয়ে গেছেন, ক্ষেত্র বিশেষে নুতুন মাত্রা দিয়েছেন। রবীন্দ্রধারার কবিতায় যে প্রেম শুধুই হৃদয়পূরে রচিত “সুখের মতন ব্যথা”, বুদ্ধদেব বসু, হুমায়ুন আজাদদের কবিতায় সেই প্রেম একই সঙ্গে তীব্র আবেগীয় শারীরিক ঝংকার। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় যেমন প্রবল প্রেমের আবেগ আছে, প্রেমকে জয় করবার আকাংখা আছে, দীর্ঘ বিরহ যন্ত্রণা আছে, তেমনি মায়াবী শব্দের গাঁথুনিতে উঠে এসেছে যৌনতা।
আমার থাকতো যদি একটি সোনার খনি
তাহলে দিনরাত খুঁড়ে খুঁড়ে আমি মুঠো ভরে ভরে তুলে আনতাম
সূর্য আর চাঁদ জ্বল সোনার কণিকা
সোনায় দিতাম মুড়ে শহরের সমস্ত সড়ক
আমার থাকতো যদি মুক্তোয় ভরা উপসাগর
তাহলে দিনরাত আমি ডুবুরির মত মুঠো মুঠো ভরে ভরে তুলে আনতাম
মুক্তো ছড়িয়ে দিতাম শহরে সমস্ত সড়কে
আমার কিছুই নেই
আছে শুধু করূণ টলোমলো এক রাশ বিষন্ন স্বপ্ন
সেই স্বপ্নগুলো আমি বিছিয়ে দিয়েছি শহরের সমস্ত সড়কে
তুমি আস্তে হাঁটো, তোমার পায়ের নিচে
ডুকরে উঠে দীর্ঘশ্বাসের চেয়েও কোমল কাতর আমার বিষন্ন স্বপ্ন।
– (তোমার পায়ের নিচে, কাব্যগ্রন্থঃ সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)
ঢো-কো। আরো গভীরে, ই-শ! বিদ্ধ করো
আহ! কে ঢুকছে! পশুদেব? কবিতা? ধীরে ধীরে ধীরে
এ-ই-বা-র প্রিয় মরে যাচ্ছি, গলে যাচ্ছি মৃত্যুর গভীরে
ই-শ! ই-শ! এ-ই আ-হ এইখানে প্রিয়!
-(ই-শ! ই-শ! এ-ই আ-হ এইখানে প্রিয়, কাব্য গ্রন্থঃ পেরোনোর কিছু নেই)
এর বাইরে বিচিত্র বিষয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। সমাজ নিয়ে ধারালো অনেক পর্যবেক্ষণ ফুটে এসেছে তার কবিতায়। কর্পোরেট ভোগবাদী সমাজে বেড়ে উঠা তার পরবর্তী প্রজন্ম যে দিন দিন প্রকৃতি আর তার অপারিত সৌন্দর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেই হতাশা নিয়ে যেমন তিনি লিখেছেন-
আমার সন্তান যাবে অধঃপাতে, চন্দ্রালোকে নীল বন
তাকে কভু মোহিত করবে না, কেবল হোঁচট খাবে
রাস্তায়, সিঁড়িতে, ড্রয়িং রুমে
সমভূমি মনে হবে বন্ধুর পাহাড়… (
-(আমার সন্তান, কাব্যগ্রন্থঃ অলৌকিক স্টিমার)
তেমনি আমাদের সমাজে নারীর প্রকৃত শোষিত অবস্থানকে মায়ের রুপকে তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে-
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি বাবাকে আপনি আমাদের মা গরীব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারতো না আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কখনো মনে হয়নি। আমাদের মা আমাদের থেকে বড়ো ছিল, কিন্ত ছিল আমাদের সমান আমাদের মা ছিল আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের। বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মত, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সিজদা দিতাম বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মত, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম আমাদের মা ছিল অশ্রুবিন্দু-দিন রাত টলমল করতো আমাদের মা ছিল বনফুলের পাপড়ি; সারাদিন ঝড়ে পরত আমাদের মা ছিল ধানক্ষেত- সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো আমাদের মা ছিল দুধভাত-তিনবেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো আমাদের মা ছিল ছোট্ট পুকুর, আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম। আমাদের মা দিন দিন ছোট হতে থাকে আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে পড়ে না আমাদের মা আর ধানক্ষেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি কিন্ত আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের মা আজো টলমল করে। -( আমাদের মা, কাব্যগ্রন্থঃ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু)
পুরুষতান্ত্রীক সমাজে বিয়েই যেন নারীর জীবনে আল্টিমেট গোল। এখনো আমাদের সমাজ একজন নারীর জীবন ও কর্মের যাবতীয় সফলতা বিচার করে তার একটা “ভাল বিয়ে” হয়েছে কিনা তা দিয়ে। এই “ভাল বিয়ে” টিকিয়ে রাখার দায়দায়িত্ব যেন শুধু একা নারীর। শত কষ্ট, অপমান, গঞ্জনা সহ্য করে নারীরা টিকিয়ে রাখে বিয়ে নামক তথাকথিত এই পবিত্র প্রতিষ্ঠান। তিনি লিখেছেন-
ক্লান্তিকর ভারি সব কিছু, তবু ক্লান্ত হলে চলবে না তাদের কী করে বইবে ভার? কী করে দমন করবে রক্তের প্রদাহ? প্রেম আর কাম কবে মরে গেছে-(তারা আজো পায় নাই টের); তবুও সযত্নে টিকিয়ে রাখতে হবে নিরন্তর একটি উৎসাহ- আঁকড়ে থাকতে হবে- সবই পন্ড যদি পন্ড হয় পবিত্র বিবাহ। -(স্ত্রীরা, কাব্যগ্রন্থঃ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু)
হুমায়ুন আজাদ তার জীবদ্দশায় ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন আর প্রবল শক্তিমান সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান দেখেননি, তিনি দেখেছেন টেলিভিশন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে আসল সত্যটাকেও গোপন করা যায়, নিকষ কালো অন্ধকারকেও যে মনোরম আলোকিত রুপে উপস্থাপন করা যায় দূরদর্শী আজাদ তা ঠিকই বুঝেছিলেন। তিনি লিখেছেন-
আমি ঠিক জানি না
কোন স্বাপ্নিকের কালে বাংলাদেশে
টেলিভিশন রঙ্গিন হয়েছে
যার কালেই হোক, তাকে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন
বলে মানতেই হবে। টেলিভিশনে
এখন আমাদের দারিদ্রকে
কী সুন্দর, রঙ্গিন মনোরম দেখায়।
-(রঙ্গিন দারিদ্য, কাব্যগ্রন্থঃ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)
আজকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগে ফেসবুকের নীল দুনিয়ায় আমরা আমাদের অন্ধকারগুলোকেও রঙ্গিন মনোরম রুপে উপস্থাপন করতে পারি। আমরা বাসায় বউ পিটিয়েও নারীর অধিকার নিয়ে ষ্টাটাস দেই, নিজে ঘুষ খেয়েও অমুক অফিসের দুর্নীতি নিয়ে হা হুতাশ করি!
সৌন্দর্যের কোন সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই, সৌন্দর্যের সাদা কিংবা কালো, কিংবা অন্য কোন নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। পৃথিবীতে থাকা অস্তিত্বের সবকিছুর মধ্যেই যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে রুপক আকারে তা তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে-
সৌন্দর্যের গ্রীবায় যখন তিল থাকে সৌন্দর্য তখন সুন্দর সৌন্দর্যের গ্রীবায় যখন তিল থাকে না সৌন্দর্য তখনো সুন্দর সৌন্দর্যের গালে যখন টোল পড়ে সৌন্দর্য তখন সুন্দর সৌন্দর্যের গালে যখন টোল পড়ে না সৌন্দর্য তখনো সুন্দর সৌন্দর্যের চুল যখন মেঘের মত ওড়ে সৌন্দর্য তখনো সুন্দর সৌন্দর্যের চুল যখন কালো গোলাপের মত খোঁপা বাধা থাকে সৌন্দর্য তখনো সুন্দর সৌন্দর্য যেভাবেই থাকে, সেভাবেই সুন্দর সৌন্দর্য যখন কাতান পরে আগুনের মত জ্বলে সৌন্দর্য তখনো সুন্দর সৌন্দর্য যখন নগ্ন ধবধবে সাদা বরফের মত গলে সৌন্দর্য তখনো সুন্দর। সৌন্দর্য যেভাবেই থাকে, সেভাবেই সুন্দর সৌন্দর্য যেভাবেই তাকায় সেভাবেই সুন্দর। ( -(সৌন্দর্যের সৌন্দর্য, কাব্যগ্রন্থঃ যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল)
হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন ২০০৪ সালে। তিনি মারা যেতে চেয়েছিলেন এই বাংলার বুকে জন্মানো একটি ঘাসফুল, টলোমলো শিশির বিন্দু আর ওড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্য, চেয়েছিলেন একটি সৌম্য, স্নিগ্ধ, সৌন্দর্যময় মৃত্যু কিন্ত সেই সৌভাগ্য তার হয়নি। অমর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঘাতকের হামলায় মারাত্নক আহত হন। পরবর্তীতে প্রাণে বেঁচে গেলেও জার্মানি এক আলো ঝলমলে রাতে সবার অগোচরে আকস্মিক মৃত্যু বরণ করেন।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব ছোট্ট ঘাসফুলের জন্য একটি টলোমলো শিশির বিন্দুর জন্যে আমি হয়তো মারা যাব চৈত্রের বাতাসে উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব দোয়েলের শিষের জন্যে শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে আমি হয়তো মারা যাব কারো চোখের মণিতে গেঁথে থাকা এক বিন্দু অশ্রুর জন্যে এক ফোঁটা রৌদ্রের জন্যে আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে খুব ছোট দুক্ষের জন্য আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভিতরে একটি ছোট দীর্ঘশ্বাসের জন্যে এক ফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে। -(আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব, কাব্যগ্রন্থঃ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু)
হুমায়ুন আজাদ তার কবিতা অবিরত নষ্টাদের হাতে যাতে নষ্ট না হয় সুন্দর ও উদপাদনে কর্মরত হাজারো বিভিন্ন পর্যায়ের উদপাদক।
সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। হুমায়ুন আজাদ স্যারের লিখার উপর আপনার প্রবন্ধ।
ধন্যবাদ প্রিয়।
৭টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হুমায়ুন আজাদ তার কবিতা অবিরত নষ্টাদের হাতে যাতে নষ্ট না হয় সুন্দর ও উদপাদনে কর্মরত হাজারো বিভিন্ন পর্যায়ের উদপাদক।
সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। হুমায়ুন আজাদ স্যারের লিখার উপর আপনার প্রবন্ধ।
ধন্যবাদ প্রিয়।
আলমগীর সরকার লিটন
শুধু বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই———————-
আরজু মুক্তা
সুন্দর উপস্থাপন। অনেক কিছু জানলাম।
ভালো থাকুন ওপারে।
শুভকামনা
ফয়জুল মহী
চমৎকার প্রকাশ
অনেক শুভেচ্ছা রইল
শামীম চৌধুরী
আপনার উপস্থাপনায় হূমায়ুন আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেল। ভাল লিখেছেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
বিনম্র শ্রদ্ধা।
আপনার জন্য শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হুমায়ূন আজাদকে দারুন ভাবে উপস্থাপন করেছেন এজন্য ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। খুব ভালো লাগলো অনেক কিছু জানা হলো। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন শুভকামনা অবিরত