
ভাদ্র মাস। মাথার উপরে তপ্ত লাল সূর্য। সূর্যের তেজ ক্ষণে ক্ষণে যেন বাড়ছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে মাজেদ মিয়া। ঘাড়ের উপর দু’জায়গায় ছেড়া এক জীর্ণ গামছা। গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিলো সে। আর সেই সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
নদীর নাম তুলসী গঙ্গা। নদীর ধারে সবুজে ছাওয়া ছোট গ্রাম। সেই গ্রামেই মাজেদের জন্ম। বাপ-দাদা সবাই ছিল মাঝি। সেই সূত্রে নদীর সাথে তার আত্মার সম্পর্ক। ছয় বছর বয়স থেকেই মাজেদ বাপের সাথে নৌকায় আসা যাওয়া শুরু করে।
এভাবেই তার হাতে খড়ি হয়।
তার বাপজানের পর গ্রামের সবার নদী পারাপারের দায়িত্ব এসে পরে মাজেদের উপর। বাপের রেখে যাওয়া একটা খেয়া নৌকায় সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রী পার করতো। গ্রামের এপারের যাত্রীকে হাটের দিকে পার করতো। হাট শেষে আবার তার নৌকা গ্রামের মানুষ বাড়ি ফিরতো। নৌকা চলতো মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, মামলা-মোকদম্মার কথা, দেশের কথা, রাজনীতির কথা।
এভাবে গল্পে গল্পে মাজেদের নৌকা তীরে ভিড়ত।
এইতো বছর দুয়েক আগের কথা, রতন ঘোষের পোয়াতি বউয়ের প্রসব বেদনা ওঠে। রাত চারটার দিকে মাজেদ মিয়াকে ডেকে নিয়ে যায় রতনের ছোট ভাই সুজন। তরিঘরি করে নৌকা ছাড়ে সে। রতনের বউকে নদী পার করে। হাসপাতাল পর্যন্ত সঙ্গে যায় মাজেদ। সেদিন দুপুরেই রতন ঘোষের ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হয়।
রতন ঘোষ গ্রামে ফিরে সবার প্রথম মাজেদের বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে যায়। এরপর থেকে সেই বাচ্চার অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই যেখানে মাজেদ দাওয়াত পায়নি।
আবার গ্রামের সবচেয়ে ধুমধামের বিয়ের সাক্ষীও তার নৌকা। সৈয়দ সাহেবের বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন সাত গ্রামের কেউ ভুলবে না। বিয়ের দিন বরযাত্রীর শেষ নাই, তিন তিন বার নৌকা ভরে বরযাত্রী পার করে সে, বউ নিয়ে ফেরার আগে মাজেদের নৌকা রঙিন কাগজে সাজানো হয়। ক্যামেরা দিয়ে সেদিন তার নৌকার কত ছবিই না তোলা হয়!
নদীর ঘাটে এসে এমন হাজারো ঘটনা আজ তার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। মনটা আজ তার বেশ উদাসীন।
মাজেদের বাপ খেয়া পারাপারের বিনিময়ে বছরে দু’বার গ্রামের লোকের থেকে ফসল উঠাত। তখন মাজেদও যেত বাপের সাথে ফসল তুলতে। বাপ মরার পর মাজেদ যখন পুরোদস্তুর মাঝি,পারাপারের বিনিময়ে কাচা পয়সা পেত সে। একবার মোড়ল সাহেবকে ধরে টাকার বিষয়টা পাকাপাকি করে সে। গ্রামের মানুষও সহজেই মেনে নেয়।
সেই টাকায় বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল তার।
মাজেদের জমিজমা না থাকলেও বাড়ির উঠানে তার বউয়ের শখের বাগান। সেখান থেকে সারাবছর অল্প-সল্প সবজি আসে। এভাবে টানাটানির সংসারে সুখের অভাব ছিল না মাজেদ মিয়ার।
কিন্তু বছর খানেক আগে হাটে চা খেতে খেতে কোরবান চাচা একটা খবর দেন। নদীর উপর নতুন ব্রিজ হবে।
ব্রিজের সাথে রাস্তাও কিছুটা পাকা হওয়ার কথা। গঞ্জের সাথে গ্রামের যোগাযোগ ভালো হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুরই উন্নতি হবে। কোরবান চাচা বেশ আনন্দের সাথেই খবরটা দেন। মাজেদের সাথে চায়ের দোকানে বসা সবার মনেই একটা ফূর্তির বাতাস বয়ে যায়। শুধু মাজেদ মিয়া হঠাৎ বিষম খায়। বুকটা ধরফরিয়ে ওঠে। চা শেষ না করেই সে উঠে পড়ে।
নৌকা বাওয়া মাজেদের বাপ-দাদার পেশা। বংশ-পরম্পরায় সেও এ কাজ করে আসছে সেই ছোটকাল থেকে। মাজেদের আর কোনো কাজ জানা নেই। না আছে জমি।
মানুষের জমি বর্গা নেবে, তাও তো সে পারবেনা। না সে জমিতে হাল দিতে জানে, না জানে কোন মাটিতে কতটুকু সার লাগে।
বাড়ি-ভিটাটুকু ছাড়া আর কিছু নেই তার।
ব্রিজ হলে সংসার কিভাবে চলবে সে চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে মাজেদ।
এর কিছুদিন পর থেকে কাজ শুরু হয়। শহর থেকে বড় বড় মেশিন আসে। বালু আসে। আসে সিমেন্ট। শ্রমিক আসে, সেই সাথে ইঞ্জিনিয়ার।
দেখতে দেখতে ব্রিজের কাজ শুরু হয়ে আবার শেষও হয়। সাথে বন্ধ হয়ে যায় মাজেদ মিয়ার নৌকা।
বেশ কিছুদিন আগে ব্রিজের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনের দিন বড় নেতা আসেন। তাঁকে দেখতে গ্রামের সব মানুষ ঘাটে আসে। কবুতর উড়িয়ে ব্রিজ উদ্বোধন হয়। আর সেদিন মাজেদের গা পুড়িয়ে জ্বর আসে।
আজ ব্রীজের পাশে সেই পুরোনো ঘাটে এসে তাই অনেক কথাই তার মনে পড়ে। গ্রামের মানুষের যোগাযোগের সুবিধা দেখে তারও ভালো লাগে। বুঝি একটু আনন্দ হয়। সে একরকম মিশ্র অনুভূতি নিয়ে রোদে চিকচিক করা নদীর জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ এক লোক মোটরসাইকেল নিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, এটা কি মাজেদ মিয়ার ব্রিজ?’
ব্রিজের নাম শুনে মাজেদ মিয়া বেশ অবাক হয়। উত্তরে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। নৌকা বন্ধ হলেও মানুষ তার নামটা ভুলে যায়নি। তার শুকনো ঠোঁটে হালকা একটা হাসি ফুটে ওঠে।
৩৪টি মন্তব্য
নাজমুল আহসান
দুঃখজনক আর আবেগী গল্প। ভালো লেগেছে।
নাজিয়া তাসনিম
ধন্যবাদ 🌹
তৌহিদ
বিষয়টি আসলেও ভাববার কিন্তু। এমন অনেক মাঝিকে দেখেছি ব্রীজ হবার কারনে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। চমৎকার আবেগময় এমন লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রথম পোস্টের জন্য অভিনন্দন এবং শুভকামনা। নিয়মিত লিখবেন আশাকরি।
নাজিয়া তাসনিম
ইনশাল্লাহ। চেষ্টা করব নিয়মিত হওয়ার ।
অনেক ধন্যবাদ। 🌹
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি গল্প উপহার দেবার জন্য। যে গল্পে সুখের মাঝে দুঃখ ও আছে, উন্নয়নে যেমন সবার উপকার তেমনি কারো জীবনে কষ্ট ও নেমে আসে এই উন্নয়নের জন্য। কারো পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। এটাই নিয়তি। ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইলো
নাজিয়া তাসনিম
আপনাকে ধন্যবাদ আপনার এত সুন্দর মন্তব্যের জন্যে। 🌹🌹
সুপায়ন বড়ুয়া
সুন্দর এক গল্প নিয়ে এলেন
সোনেলা ভুবনে আপনাকে স্বাগতম!
নাজিয়া তাসনিম
অনেক ধন্যবাদ 😊
এস.জেড বাবু
দারুন একটা উপসংহার টেনেছেন।
সময়ের বিবর্তনে আধুনিকায়ন, অনেক কিছুই বদলে দেয়। বদলে দেয় মাজেদ মিয়ার মতো কর্মে ধর্মে জীবনধারণের গল্প।
চমৎকার শুরু এবং শেষ।
নাজিয়া তাসনিম
উপসংহারটা আমার নিজেরও বেশ পছন্দ।
ব্রিজটাই মাজেদ মিয়াকে আরো শত বছর বাচিয়ে রাখবে মানুষের মনে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। 🌹
এস.জেড বাবু
শুভেচ্ছা বসন্তের
কামাল উদ্দিন
একেবারে মাটির গল্প, উন্নয়নের বিবর্তনের গল্প। এমন গল্প পড়তে কখো ক্লান্তি আসে না। এতো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে আপনাকে আমি অন্তর থেকে স্যালুট জানাচ্ছি।
নাজিয়া তাসনিম
আপনার অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যটি পেয়ে ধন্য হলাম।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। 😊
কামাল উদ্দিন
শুভেচ্ছা অবিরত
ইঞ্জা
চমৎকার আবেগী গল্প, কত মাজেদের গল্প না চাপা পড়ে রয়ে গেছে আজকের ব্রীজ গুলোর নিচে, লেখাটি বেশ ভালো লাগলো ভাই।
নাজিয়া তাসনিম
ধন্যবাদ ইঞ্জা ভাই। সালাম নেবেন।
ইঞ্জা
ওয়া আলাইকুম আসসালাম, আরও বেশি বেশি লিখুন, আমাদেরকে পড়তে দিন।
নিরব সাগর
সুন্দর ছিল
নাজিয়া তাসনিম
ধন্যবাদ ভাই।
ফয়জুল মহী
ভালো থাকবেন সবসময় I শুভ কামনা রইলো।
নাজিয়া তাসনিম
অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনার জন্যেও শুভকামনা।
হালিম নজরুল
চমৎকার গল্প।
নাজিয়া তাসনিম
অনেক ধন্যবাদ 🌹
ইসিয়াক
ভারো লাগলো খুব।
ভালো থাকুন সবসময়।
নাজিয়া তাসনিম
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম।
নিতাই বাবু
গল্পের শুরু থেকে মাজেদ মিয়ার সুখদুখমাখা কাহিনী শুনে শেষাবধি কষ্ট হচ্ছিল, মাজেদ মিয়ার জন্য। কষ্টটা আবার দূরও হলো, ব্রিজের নামটা শুনে! বেশ চমৎকারভাবে গল্পটা ফুটিয়ে তুলেছেন, শ্রদ্ধেয় গল্পকার! শুভেচ্ছা সহ শুভকামনা থাকলো।
নাজিয়া তাসনিম
এভাবেই হয়তো মাজেদ একদিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ ভ্রাতা। ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
একবছর হচ্ছে আপনার আইডির বয়স।
এই প্রথম একটি পোস্ট দিলেন।
এমন আবেগময় একটি পোস্ট পড়ে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগই করলাম ‘ আমাদের বঞ্চিত কেন করলেন এতদিন?’
উন্নয়নে কিছু মানুষের সমস্যা হয়ই, এটি মেনে নিতে হবে।
বেঁচে থাকার তাড়নায় মাজেদ মিয়া অন্য কোনো পেশা নিয়ে বাঁচবে।
তবে ব্রীজটির নাম মাজেদ মিয়ার ব্রীজ হওয়াটা অত্যন্ত গর্বের।
মাজেদ মিয়ার আবেগকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আরো লেখা চাই,
শুভ কামনা।
নাজিয়া তাসনিম
আপনার অভিযোগ যথার্থ। অনেকদিন ধরে ভাবছি লিখবো। এর মাঝে যে একবছর চলে গেলো বুঝে উঠতে পারিনি।
এরপর থেকে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করবো। অনেক ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
অবশেষে আমরা পড়ার সুজোগ পেলাম, কেন আর-ও আগে নয় সে প্রশ্নের উত্তর
আমারা জেনে গেছি। এবারে কথা দিয়ে কথা রাখার পালা। আমরা অপেক্ষা করতে জানি।
হারিয়ে যেতে যেতেও কোন কোন মজিদ কে আমরা মনে রাখি। শেষটি বেশ হয়েছে, লেখার।
নাজিয়া তাসনিম
ধন্যবাদ আপনাকে। 🌹
মনির হোসেন মমি
অভিনন্দন এবং শুভ কামনা রইল গল্পের সুন্দর এবং বাস্তবিক প্লটের জন্য ব্লগার হিসাবে নয় কারন আপনি পুরনো ব্লগার।আপনাদের পদ চারণায় সোনেলা মুখরিত হউক এটাই কাম্য।
নাজিয়া তাসনিম
ধন্যবাদ ভ্রাতা। ভালো থাকবেন। 🌹
নোশীন নূফা
প্রিয় তুলসীগঙ্গাকে নিয়ে লেখা গল্প দেখে প্রথমেই মন ভরে গিয়েছিল। তারপর জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের এত সাবলীল বর্ণনা আর সবশেষে একটি সুন্দর সমাপ্তি মনকে বলে দিল, লেখিকাকে তো আমি বহুকাল ধরে চিনি…❤