বাসর ঘরে কান্নার শব্দ

নিতাই বাবু ১৭ নভেম্বর ২০১৯, রবিবার, ০১:১৭:৪৯পূর্বাহ্ন গল্প ৩২ মন্তব্য

রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। আর কিছুক্ষণ পরই ঘড়ির ঘণ্টার কাটা এগারোটার বরাবর হলেই, দেওয়াল ঘড়িতে রাত এগারোটার এলার্ম বেজে ওঠবে। অথচ নিত্য বাবুর ঘরে একটা সিগারেটও নেই। অন্যান্য দিন নিজের পকেট ছাড়াও ঘরে চার-পাঁচটা  সিগারেট সবসময় মজুদ থাকতো। কিন্তু আজ নেই। নিত্য বাবু অফিস থেকে আসতে মনের ভুলেই নিজের পকেটে আর হাত দেয়নি। তাই আজকে এমন সাংঘাতিক ভুলটা হয়ে গেল। এই ভুলের মাশুল দিতে হলে, এখনই মহল্লার রাস্তার পাশে থাকা যেকোনো একটা দোকানে গিয়ে, সিগারেট কিনতে হবে। সিগারেট ছাড়া নিত্য বাবুর একদম চলে না। নিত্য বাবু হলেন ধূমপানের প্রেসিডেন্ট। ধূমপানের জন্য উনাকে সম্রাট টাইটেলও অনেকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু নিত্য বাবু তা প্রত্যাখ্যান করে সেই সম্মাননা আর গ্রহণ করেনি। নিত্য বাবু প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে শুরু করে সিগারেট ফুঁকা। সেই ফুঁকা একটানা চলতে থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তাহলে সিগারেট ছাড়া আজকের রাতটা নিত্য বাবুর কাটবে কী করে? সিগারেট ছাড়া রাতে কিছুতেই নিত্য বাবু ঘুম আসবে না! ঘুম আসার কথাও নয়। তাই রাত এগারোটার সময় গলায় একটা গামছা পৌঁছিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় গিন্নির জিজ্ঞাসা,
–এতো রাইতে আম্নে কই যাইতাছেন?
–না- মানে সিগেট নাইতো, হিল্লাইগা দোয়ানে যাইতাছি!
–সিগেট ছাড়া কি এক রাত চলন যায় না? যাইবেন যহন দেইক্কা যাইয়েন। রাইত কইরা রাস্তার মাধ্যে কুত্তা থায়।আবার হুদাহুদি ভালা ভালা মাইনষেরে পুলিশে ধইরা লইয়া যায়। মাইনষের কাছে কিচ্ছু না থাইকলেও, পুলিশরা কয় গাইঞ্জা পাইছে।
–আরে তুমি চিন্তা কইরো না! আমি তাততাড়ি কইরা আইয়া পড়তাছি।
ঘরের লক্ষ্মী গিন্নিকে এই বলে শান্তনা দিয়ে নিত্য বাবু ঘর থেকে বের হলেন মহল্লার একটা দোকানের উদ্দেশে।

নিত্য বাবু যেই মহল্লার ভাড়াটিয়া, সেই মহল্লাটি নামীদামী এক শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। পুরো মহল্লার বাড়ি বাড়ি পৌঁছতে এজমালি রাস্তা ছাড়া বিন্দুমাত্র জায়গা আর খালি নেই, শুধু বাড়ি আর বাড়ি। বাসা আর বাসা৷ বাসা ঘেঁষেই বাসা। নিত্য বাবু বাসা থেকে বের হয়ে এজমালি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দোকানের উদ্দেশে। রাস্তার ডানপাশে রমজান আলীর বাড়ি। রমজান আলীর বাড়িতে অনেকগুলো ভাড়াটিয়া বাসা। রমজান আলীর বাড়ির এক বাসা থেকে তাজা ফুলের মৌ মৌ সুগন্ধ নিত্য বাবুর নাকে আসতে লাগলো। সাথে দামী সেন্টের ঘ্রাণও। ফুলের সুগন্ধ নাকে লাগতেই, নিত্য বাবু এদিক-ওদিক সু-গন্ধের সন্ধান করতে লাগলো। কিন্তু রাস্তা ঘেঁষে সারিবদ্ধ বাসা হওয়াতে, ঠিক কোন বাসা থেকে তাজা ফুলের সুগন্ধ বের হলো, তা আর নিত্য বাবু অনুমান করতে পারিনি। তবে ধরনা ঠিকই করতে পেরেছে, এই বাড়ির কোনোএক ভাড়াটে বাসা থেকেই সেন্টের সুগন্ধ বের হয়েছে। মনে মনে সেই ধারনা নিয়ে পরিচিত এক দোকানে গেলো। অনেক রাত হয়ে যাওয়াতে দোকানদার সে-সময় দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিত্য বাবু আর কিছুক্ষণ পর গেলে এই দোকনটা খোলা পেতো না। নিত্য বাবুকে যেত হতো সামনের বাসস্টপে। একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে আসাতেই দোকানটা খোলা পেয়েছে। দোকানদার নিত্য বাবুকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
–কিও বাবু, কিল্লাইয়া আইছেন?
–আরে ভাই আমার লগে ত সিগেট নাই। সিগেট ছাড়া ত রাইতে আমার ঘুম আইত না। হিল্লাইগা আইলাম তোমার দোয়ানে।
এই বলেই জোরে ঝাঁঝালো একটা হাঁচি মেরে দিলো।হেঁচ্ছো করার সাথে সাথে দোকানদার জিজ্ঞেস করলো,
–ঠাণ্ডা লাগজেনিও বাবু? এমুন জোরে জোরে আঁচি দিতাছেন!
–আরে নাও ভাইও, ঠাণ্ডা লাগে নাইক্কা। ব্যাঙের আবার ঠান্ডা আছেনি? ঠান্ডা না, ঠান্ডা না! সেন্টের ঘ্রেরাণে নাকের মাধ্যে পোড়া মইচের মতন ঝাঁজ লাগছে। হিল্লাইগা আঁচি আইয়া পড়ছে।
–এতো রাইতে সেন্টের ঘেরাণ কইতন পাইলেন?
–আমগো বাসা তুনে আহনের সুম রাস্তার ডান দিগের রমজান আলীগো বাইত তুনে তাজা ফুলের ঘ্রেরাণের লগে সেন্টের ঘ্রেরাণ বাইর অইতাছিল। হেই ঘ্রেরাণই আমার নাকে লাগছে। আহারে ঘ্রেরাণ! ঘ্রেরাণ কারে কয়! মনডায় চাইছিল, হারা রাইত বইয়া বইয়া বেক ঘ্রেরাণ নাকে টাইন্না লইয়া লই। সিগেটের লাইগা হেইডা আর অইল না।তাততাড়ি কইরা আইয়া পড়ছি। তয় ভাই রমজান আলীগো বাইত আয়োজনডা কিয়েরও?
–ও, আম্নের রমজান আলীগো বাড়ির কতা কইতাছেন? হেগো বাড়ির এক ভারাইট্টা পেলা পারিত কইরা বিয়া করছিল, আইজগা দশবার দিন অয়। হেই বিয়া লইয়া বহুত দেনদরবার কইরা হেষে কাইলকা বউ লইয়া আইছে। আইজগা দুপুরে বউভাত গেছিল। অহনে মনে অয় হেগো বাসর রাইত চলতাছে। হিল্লাইগাই সেন্টের ঘ্রেরাণ পাইছেন। এই ঘ্রেরাণ ত আইজগাই শেষ অইয়া যাইবোগা বাবু। কদিন পরে হেই ঘরের তুনে ঘ্রেরাণ বাইর অইত না। বাইর অইবো কান্দনের শব্দ! এমুন পিরিতের বিয়া কত দেইখলামও বাবু! বিয়ার পরে দুইদিন যাইতে-না-যাইতে লাইগগা যায় কিলাকিলি। হের পরে ছাড়াছাড়ি। অহনে কন আম্নের সিগেট কয়ডা লাগবো?
–আম্নে ভাই যা কইলেনও! আম্নের কতা অহনকা আমার হারা রাইত বইয়া বইয়া চিন্তা করন লাগবো। হিল্লাইগা সিগেটও বেশি লাগবো। আমারে এক পেক মেরিল সিগেট দেন। টেকা কাইলকা অপিসো যাওনের সুম দিয়া দিমু।
–আইচ্ছা লন! তাততাড়ি কইরা বাইত যানগা। রাত বহুত অইছে।
নিত্য বাবু দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল, সেই বাসার পেছন দিয়ে। আসতেই আবার সেন্টের ঘ্রাণের সাথে ইংলিশ মিউজিকের শব্দ কানে আসলো। নিত্য বাবু সেইদিকে কান দিয়ে সোজা নিজের বাসায় চলো এলো।
নিত্য বাবু বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে রাতের খাওয়া সেরে নিজের এন্ড্রয়েড মোবাইলটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে দুই একটা অনলাইন নিউজে দেশের খবর পড়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু কিছুতেই নিত্য বাবু চোখে ঘুম আসছে না। ভাবছে দোকানদারের কথা! যেই কথা ঘণ্টাখানেক আগে শুনে এসেছিল। ভাবতে ভাবতে বিছানায় এদিক সেদিক করতে করতে একসময় নিত্য বাবু ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত শেষে ভোর হলো। নিত্য বাবুর লক্ষ্মী গিন্নীর বাটন মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠলো। তখন সময় সকাল ছয়টা। ঘরের লক্ষ্মী বাইরে যাবে। মানে কর্মক্ষেত্রে। এটাকে একরকম যুদ্ধক্ষেত্রও বলা চলে। সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা। আবার দুপুর দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা। ওভারটাইম চললে রাত দশটা পর্যন্ত একটা ঘরের লক্ষ্মী গিন্নীকে যুদ্ধ করতে হয়। আবার কর্মক্ষেত্রে যোগদানে দুই মিনিট দেরি হতে পারবে না। দেরি হলেই মাসিক বোতন থেকে মিনিট প্রতি টাকা কর্তন করা হয়। তাই মোবাইলে সকাল ছয়টায় এলার্ম দিয়ে রাখা হয়। যাতে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, আগেভাগে রান্নার সিরিয়াল ধরতে পারে। আর ঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারে। এরপর তাড়াহুড়ো করে রান্নাবান্না করে খেয়ে-না-খেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদানের জন্য শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। নিত্য বাবু রাজার হালে সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আস্তেধীরে অফিসে রওনা হয়। অফিসে যেতে যেতে বেজে যায় সকাল দশটা। দুপুর একটায় স্বামী-স্ত্রী দুইজন এক সময়ই বাসায় আসে। এভাবে চলছে নিত্য বাবুর নিত্যদিনের দৈনন্দিন জীবন।

নিত্য বাবু প্রতিদিন অফিসে যাওয়া আসার মাঝে রাস্তা ঘেঁষা রমজান আলীর ভাড়াটিয়া বাসার দিকেও খেয়াল রাখে। নজর রাখে। যেই ভাড়াটিয়া বাসা থেকে এক রাতে সুগন্ধ বের হয়েছিল। এখন আর সেই রাতের মতো সুগন্ধ বের হয় না। ইংলিশ মিউজিক শোনা যায় না। এখন মাঝে মাঝে চিল্লাচিল্লি শোনা যায়। আবার মাঝে মাঝে শোনা যায় কান্নার শব্দ। একদিন নিত্য বাবু দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎ বাইরে অনেক লোকের চিল্লাচিল্লি শুনে নিত্য বাবু ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির বাইরে যায়। বাড়ির বাইরে এজমালি রাস্তার ডান পাশে রমজান আলীর সেই ভাড়াটে বাসার জানালা দিয়ে দেখে মাসেক খানেক আগে বিয়ে করা বউটাকে মারছে। ভালোবাসার স্বামীর হাতে বেধড়ক মার খেয়ে প্রেমিকা স্ত্রী বিলাপ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘আমি আর তর ভাত খাইতাম না, গোলামের ঘরে গোলাম। আমারে তুই অহনই ছাইড়া দিবি। তর ঘর করনের চাইতে জানোয়ার লইয়া থাওন ভালা। কত সখ কইরা বিয়া বইছিলাম! হেই সখের মাইধ্যে ঠাডা পইড়া গেছে। তুই আমারে অহনই ছাইড়া দিবি।’ এভাবে নতুন বউ আরও অনেক কথা বলে বিলাপ ধরে কাঁদতে লাগলো।

তখনই নিত্য বাবুর সেই রাতে দোকানের কথা মনের পড়ে গেল। দোকানদার বলেছিল, “এই ঘ্রেরাণ ত আইজগাই শেষ অইয়া যাইবোগা বাবু।কদিন পরে হেই ঘরের তুনে ঘ্রেরাণ বাইর অইত না। বাইর অইবো কান্দনের শব্দ! এমুন পিরিতের বিয়া কত দেইখলামও বাবু! বিয়ার পরে দুইদিন যাইতে-না-যাইতে লাইগগা যায় কিলাকিলি। হের পরে ছাড়াছাড়ি।” সেই রাতে দোকানদারের কথাটা আজ বাস্তবে পরিণত হলো। যেই বাসরঘর থেকে সুগন্ধি বের হয়েছিল, আজ সেই বাসরঘরে শোনা যাচ্ছে কান্না শব্দ!

গল্পের ঘটনা সম্পুর্ণ কাল্পনিক!

২১৯৩জন ১৯৯২জন

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ