
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সন্ধ্যাটা যখন একঘেঁয়ে রাতের অন্ধকারে পদার্পণ করে তখনো দিনের আলোর কিছু লালচে আভা আকাশকে রাঙিয়ে রাখে। অনেকটা প্রৌঢ়া রমনীর ভাঁজ পড়া ঠোঁটে উজ্জ্বল লিপিস্টিকের মতো, যা কেবল পুরনো অভ্যাসের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে কিন্তু কোন সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা তাগড়া যুবকের দৃষ্টি কাড়ে না।
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই অবন্তিকার বয়সটা যেনো তার চলমান সময়ের চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে গেছে। চোখের নীচে ভাঁজ পড়া কপোলটাকে যতই কৃত্রিম প্রসাধনে আচ্ছাদিত করুক না কেন, বয়সী চোখের অস্পষ্ট আক্ষেপই বলে দেয় সে এখন আর ষোড়শী নেই। তবুও কি আপ্রাণ চেষ্টাই না সে করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত নিজেকে যৌবনাবতী করে তুলতে।
অবন্তিকা একজন উচ্চশিক্ষিত কর্পোরেট। মোটামুটি চলমান সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে। তারপর কর্মজীবনের শুরু। একের পর এক কর্মস্থল পরিবর্তন করতে করতে পরিবর্তন টা যেনো তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য একটা অত্যাবশ্যক সূত্র হয়ে গেছে।
সৌমিকের সাথে যখন অবন্তিকার ছাড়াছাড়ি হয় তখন অবন্তিকা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাউথ এশিয়ান রিজনের চীফ মার্কেটিং রিচার্স অফিসার। শিক্ষাগত যোগ্যতার দৌড়ে যতটা না পদায়িত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে ঐ কোম্পানির ইউরোপীয় সিইওর সাথে অবন্তিকার ব্যক্তিগত সখ্যতা। অবন্তিকা সৌমিক কে ছেড়ে দিয়েছিল কারণ সৌমিক জানতে পেরেছিলো অবন্তিকা তার ক্যারিয়ার কে পরিবারের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে।
তারপর এ হাত ও হাত ধরে অবন্তিকা বহুদূরের পথে তার স্বপ্ন চরিতার্থ করার যথাযথ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চলমান স্রোতে জীবন সঙ্গী বলতে যারা এসেছে তাদের অনেকেই লোকাল বাসের যাত্রীর মতো। একটা নির্দিষ্ট স্টপিজে এসে একজন নেমে সিট খালি করে দিয়েছে তো আরেকজন সেই আসন জুড়ে বসেছে। আর অবন্তিকা কেবল ছুটে চলেছে তার বহুদূরের গন্তব্যে।
সে জানতো তার জ্বালানী প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তবুও পুরনো ফার্নিচারে বার্ণিশ করার মতো প্রসাধনী মেখে নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অবন্তিকা। তারপর একদিন এক গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সন্ধ্যা শেষে চায়ের পেয়ালা হাতে অবন্তিকা তার হিসেবের খাতা খুলে দেখছিলো। তার এই চল্লিশ বছরের জীবনে পাওয়া না পাওয়া আর পেয়ে হারানোর সংখ্যাগুলো কতটা সামঞ্জস্য বহন করে।
কিন্তু ঠিক তখনই অবন্তিকার সেলফোনের মেইলবক্সে একটা মেসেজ আসে। প্রিয় অবন্তিকা আপনি আমাদের কোম্পানির এশিয়ান রিজনের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে প্রাথমিক বাছাইপর্বে নির্বাচিত হয়েছেন। কোম্পানির চীফ ম্যানেজিং ডিরেক্টর আপনার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট কল করেছেন।
আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরের মারিয়ানা বে স্যান্ডস – হোটেলে আমরা আপনাকে স্বাগতম জানাতে পারি।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অবন্তিকা। দূরের আকাশে তখনো একটা অস্পষ্ট উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে সন্ধ্যা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। অনতিদূরের মৎস্য খামারের পাশের ঝোপের ভেতর থেকে অভুক্ত শেয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ ভেসে আসছে। একটা হূতোম পেঁচা সামনের বিল্ডিং এর ছাদের কার্ণিশে বসে একাগ্রচিত্তে অবন্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে। কে জানে ঐ পেঁচাটা হয়তো অবন্তিকার সদ্য বিদায়ী যৌবনের জরাজীর্ণতার স্বাক্ষী তার ম্রিয়মাণ খোলা বুকের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।
পেঁচাটার চোখে চোখ পড়তেই অবন্তিকা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সপ্রতিভ হয়ে ঘাড়ের উপর থেকে ওড়না টা টেনে বুকের উপর ছড়িয়ে দেয়। একটু মুচকি হেঁসে অবন্তিকা মনে মনে ভাবে কি জানি সিঙ্গাপুরের হোটেলে আবার কোন প্যাঁচা অপেক্ষা করছে ?
অনন্য অর্ণব
উত্তরা, ঢাকা।
১৪/০৭/২০১৯
২৮টি মন্তব্য
কামাল উদ্দিন
মাঝে মাঝে প্রত্যেকেই আমরা এমন হিসাবের খাতা খুলে বসি, সেখানে পাওয়া না পাওয়ার চেয়ে নষ্ট্যালজিকতাই বেশী এসে ভর করে………গল্পে ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম।
অনন্য অর্ণব
অসংখ্য ধন্যবাদ কামাল ভাই। ভালো থাকবেন সবসময় 😍
কামাল উদ্দিন
[ছবি মুছে ফেলা হয়েছে]
অনন্য অর্ণব
Thank you so much♥️
সুরাইয়া পারভিন
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই অবন্তিকার বয়সটা যেনো তার চলমান সময়ের চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে গেছে। চোখের নীচে ভাঁজ পড়া কপোলটাকে যতই কৃত্রিম প্রসাধনে আচ্ছাদিত করুক না কেন, বয়সী চোখের অস্পষ্ট আক্ষেপই বলে দেয় সে এখন আর ষোড়শী নেই। তবুও কি আপ্রাণ চেষ্টাই না সে করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত নিজেকে যৌবনাবতী করে তুলতে।,,কথা গুলো
চমৎকার।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
অনন্য অর্ণব
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয়। কারো অবিচল অনুপ্রেরণাই পারে কারো কারো জীবন সম্পূর্ণ বদলে দিতে। তোমার কাছে আমি চিরঋণী। ভালো থাকিস সবসময় 😍
মোহাম্মদ দিদার
ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে একদিন আমরা পৌছে যাবো অন্তিম মুহুর্তে। সেদিন ক্যারিয়ারের কোনো মুল্য থাকবেনা। আমার ভাবনাটা এমনি, জীবনে কেবল মাত্র ক্যারিয়ারকে গুরুত্ব নাদিয়ে, নিজেকে নিয়ে সঠিক ভাবনা ভেবে, নাজের মন কি চায় কতটুকু পেতে পারি জীবন থেকে,এসব বিষয়েও ভাবা/ গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। সাথে থাকবে কঠোর পরিশ্রমি মন, যেটা নিজ থেকেই ক্যরিয়ার গরে দিবে…..
অনন্য অর্ণব
দারুন বলেছেন দিদার ভাই। আমিও সেটাই বলি। জীবনের জন্য ক্যারিয়ার দরকার, কিন্তু কেউ কেউ এমনো আছে দেখছি যাদের জীবনটাই মনে ক্যারিয়ারের জন্য। মন্তব্যে অসম্ভব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
রেহানা বীথি
জীবন চায় গতি। হঠাৎ কোনও কারণে কিছুটা হয়তো ঝিম ধরে বসে থাকতে চায়, কিন্তু পরমুহূর্তেই তীব্রতা হাতছানি দেয়। থামা যাবে না, চলতে থাকো তুমি, যতদিন সচল থাকো।
ভালো লাগলো আপনার গল্প।
অনন্য অর্ণব
আপনি ঠিকই বলেছেন আপু। জীবন চায় গতি, থমকে গেলে জীবন তার অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে। শুভ কামনা নিরন্তর 😍
আরজু মুক্তা
কর্পোরেট,,, আহা জীবনটাই কি এমন? উপরে উঠার ধাপে সবাই টলায়মান, যেখানে নিচু মানসিকতা বিরাজ করে।
অনন্য অর্ণব
প্রতিটি মানুষের একটা নিজস্ব স্বাধীন স্বত্বা থাকে। Every individual person have several thinking. So let everyone go with their own way then they might be more happy. ধন্যবাদ আপু।
এস.জেড বাবু
জীবন
যার সংজ্ঞা এক একজনের দৃষ্টিতে এক এক রকম। ভোগ ও ভোগান্তির উপর নির্ভর করে প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে জীবনকে সংজ্ঞায়ীত করেন।
কেমন ধুক করে উঠলো বুকটা, যখন পড়লাম-
///// একটা নির্দিষ্ট স্টপিজে এসে একজন নেমে সিট খালি করে দিয়েছে তো আরেকজন সেই আসন জুড়ে বসেছে। আর অবন্তিকা কেবল ছুটে চলেছে তার বহুদূরের গন্তব্যে।
আরও চকচকে কিছুর আশায় পিছনের ঘোলাটে অংশ যারা গুলিয়ে ফেলেন, অবন্তিকা তাদেরই একজন মনে হলো।
কর্পোরেট যুগের আধুনিকতায় লিখা মনে রাখার মতো একটা গল্প। দারুন গতিময়তা।
ভালো লাগলো।
অনন্য অর্ণব
অনেক অনেক ভালোলাগা ভাই। ভালো থাকবেন সবসময় 😍
এস.জেড বাবু
আপনার সুদীর্ঘ্ জীবন কামনা করছি ভাই।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ব্যক্তি স্বার্থ আরও প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকেই অবন্তিকার মতো নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে দেওলিয়া হয়ে পড়ে। যখন বুঝে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যায়।
লেখা ভালো লেগেছে।
অনন্য অর্ণব
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই ❤️
মাছুম হাবিবী
ভাই আমি বড় লেখাগুলো প্রায় কমই পড়ি। তবে আজ আপনার শিরোনামটা দেখেই পুরো লেখাটা পড়লাম। অবন্তিকা নামটা আমার অনেক প্রিয়! আপনার গল্পে যে অবন্তিকার কথা বলা হয়েছে তার সাথে আমার কল্পনার অবন্তিকার চরিত্র পুরোপুরি ভিন্ন! তবু খুব সুন্দর হইছে গল্পের এন্ডিং টা! শেষটা ভালো ছিল
অনন্য অর্ণব
আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত দাদাভাই। আপনার প্রিয় কারো নামের সাথে আমার গল্পের প্রধান চরিত্রের মিল শুধুই কাকতালীয়। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 😍
নিতাই বাবু
আমার চারপাশ ঘিরে আপনার গল্পের নায়িকা অবন্তিকার মতো অনেক অবন্তিকা আছে। ওঁদের দিকে তাকালে এমনই দেখি। হায় রে প্রিয় অবন্তিকা আমার। সিংগাপুর গিয়ে দেখবে কয়েকটা প্যাঁচা অপেক্ষা করছে।
আপনার গল্পে মুগ্ধতা রেখে গেলাম।
অনন্য অর্ণব
অনেক অনেক ভালোলাগা দাদাভাই 😍
মনির হোসেন মমি
মর্ডান হওয়া ভাল তবে লিমিটেড এর বাহিরে নয়। চলুক লেখা।
অনন্য অর্ণব
একদম সত্যি কথা। কিন্তু ভাই সত্য সবসময়ই তেতো। অবন্তিকাদের রুচি কিন্তু ভীষণ রাজকীয়।
মনির হোসেন মমি
নিজ সত্বাকে বিকিয়ে দেয়া এ রাজকীয় রুচি’র কোন মুল্য নেই।দিন শেষে ভুলের আফসোস থেকেই যায়। ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
সুচনা পর্বটা বেশ আকর্ষনীয় হয়েছে,
ভাল গল্প লেখেন আপনি।
শুভ কামনা।
অনন্য অর্ণব
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই ❤️
রুমন আশরাফ
“গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সন্ধ্যাটা যখন একঘেঁয়ে রাতের অন্ধকারে পদার্পণ করে তখনো দিনের আলোর কিছু লালচে আভা আকাশকে রাঙিয়ে রাখে। অনেকটা প্রৌঢ়া রমনীর ভাঁজ পড়া ঠোঁটে উজ্জ্বল লিপিস্টিকের মতো, যা কেবল পুরনো অভ্যাসের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে কিন্তু কোন সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা তাগড়া যুবকের দৃষ্টি কাড়ে না।”
বাহ কি দারুণ সূচনা। লেখাটি পড়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম। শুভ কামনা রইলো।
অনন্য অর্ণব
অনেক অনেক ভালোলাগা দাদাভাই 😍