
বিকেল হলেই পকেটে পাঁচ-দশ টাকা নিয়ে মাঠে চলে যেতাম।আমার পকেট কখনও খালি থাকতো না। সকালে আম্মা বাজার করতে দিলে তা থেকে প্রয়োজন মতো টাকা মারতাম। তখন বিকালে গরু বাজারে বুট, বাদাম খাওয়ার জন্য পাঁচ-দশ টাকা হলেই চলে, তাই আমি বাজার থেকে পাঁচ-দশ টাকাই মারতাম। ওই টাকা পকেটে নিয়ে প্রথমে পুরো মাঠ এক চক্কর ঘুরে দেখা হতো। তারপর বুট বা বাদাম কিনে আরেক চক্কর ঘুরতাম। গরু বাজারে মাইকে লতা মঙ্গেশকর, উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগনিক, কুমার শানুদের হিন্দি গান বাজতো।আমি বাদামের খোসা ছাড়তে ছাড়তে ঠোঁট মিলাতাম।গান গুলো তখন মুখস্ত ছিলো। কারণ, এই মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল ট্রুনামেন্ট হলেও একই গান বাজে। আবার কারো গায়ে হলুদ, খৎনা কিংবা নাক কান ফুটো করার অনুষ্ঠানেও এই গান গুলো বাজিয়ে সবাই নাচে। মেয়েরা বলতো হিন্দি গান ছাড়া নাকি তাদের নাচের তাল উঠে না।
সে যাই হোক, এই দিকে মাইকে হঠাৎ করে গান বন্ধ করে গরু বিক্রির ঘোষণা আসতো।সাথে সাথে আমি ছুঁটে যেতাম যেখানে ইজারাদার হাসিল আদায় করে সেখানে। কোন গরু বিক্রি হলো, কে কিনলো, কত দিয়ে কিনলো; এসব দেখতে। তো এইভাবে যেতে যেতে একদিন খেয়াল করলাম মাঠের দক্ষিণ পাশে ঝোপঝাড়ের ভেতর কিছু মানুষের ভীড়।কৌতুহলবশত গিয়ে দেখি ঝোপের ভিতরে “ডাব্বা” খেলার আসর বসছে। এটা এক প্রকার জুয়া খেলা, আবার এটাকে গরীবের ক্যাসিনোও বলা যেতে পারে । এই খেলায় ছক্কার গুটির মতো বড় বড় দুইটা কাঠের তৈরি গুটি থাকে। ছক্কার গুটির মধ্যে যেমন এক থেকে ছয় পর্যন্ত সংখ্যা থাকে, ডাব্বা খেলার গুটির মধ্যে তেমন করে থাকে চাঁদ, তারা, ইস্কা, রুইতন, পানপাতা আর ভালোবাসা (লাভ চিহ্ন)।
ছক্কার বোর্ডের মতো এখানে মাটিতে একটা কাপড় পেতে রাখা হয়, তাতে গুটির ছয়টা প্রতীক বড় বড় করে আঁকা। দুইটা গুটি ভালো করে নাড়ানোর পর যে দুইটা প্রতীক উঠবে, সে ঘরে যারা টাকা রেখেছে তারা দ্বিগুণ টাকা পাবে।
খেলাটা দেখে আমার খুব লোভ হলো। আমিও একটা ঘরে দুই টাকা রাখলাম। দুই টাকা তখন আমার জন্য অনেক কিছু, তাইতো টাকা গুলো ঘরে রেখে দুই চোখ বন্ধ করে দোয়া দরূদ পড়তে শুরু করলাম, যেন আমার ঘরের প্রতীক গুলো উঠে। একটুপর চোখ খুলে দেখি একটা গুটিতে আমার ঘরের প্রতীক! কী সৌভাগ্য আমার! জীবনের প্রথম জুয়া খেলায় জিতে গেলাম! আমার দুই টাকা হয়ে গেল চার টাকা। এতে করে লোভ বেড়ে গেলো। এইবার দুই টাকা দুই টাকা করে চার টাকা রাখলাম দুইটা ঘরে। যদি দুইটা গুটিতে আমার দুইটা ঘর উঠে, তাহলে আমার চার টাকা হয়ে যাবে আট টাকা! আবার চো্খ বন্ধ করে দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু, এইবার আমাকে চরম হতাশ হতে হলো। গুটিতে আমার টাকা রাখা একটা ঘরের প্রতীকও ওঠেনি।কি আর করার! সেদিন হতাশ হয়ে খালি হাতে বাড়িতে চলে আসি।
পরদিন বাজার থেকে আরও বেশি টাকা মেরে খেলতে গেলাম।কিন্তু গিয়ে দেখি, যেখানে ডাব্বা খেলার আসর বসে ওই জায়গায় কিছু কাঁটা গাছের ডাল পড়ে আছে। পরে জানতে পারলাম, পুলিশ ও চৌকিদার এসে জুয়ার আসর থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। এটা শোনার পর, আমি দুই টাকার জন্য একটা দীর্ঘ-শ্বাস ছেড়ে পুনরায় গরু দেখাতে মনোনিবেশ করলাম।
*এটা ছিলো আমার প্রথম জুয়া খেলার স্মৃতি*
*ছবি অনলাইন থেকে সংগৃহীত*
১৮টি মন্তব্য
নৃ মাসুদ রানা
ছোটবেলায় আমিও খেলছি বেশ কয়েকবার। স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়ে গেলো…
তৌহিদ
আমি কখনো জুয়া খেলিনি। আসলে কার্ড খেলাই আমি বুঝিনা এখন পর্যন্ত। এই খেলাকে ডাব্বা খেলা বলে? আমিতো গুনতাম ফরগুটি বলে সবাই? অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম হতেই পারে।
লোভ খুব খারাপ জিনিস, মাত্র দুই টাকার জন্য আপনাকেও সে অধঃপতনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আসলে জুয়া এমনই, কতজনের যে সর্বনাশ করেছে!!
তৌহিদ
দুঃখিত মন্তব্য অন্যঘরে গিয়েছে ভাই। এখানে দিলাম।
আমি কখনো জুয়া খেলিনি। আসলে কার্ড খেলাই আমি বুঝিনা এখন পর্যন্ত। এই খেলাকে ডাব্বা খেলা বলে? আমিতো গুনতাম ফরগুটি বলে সবাই? অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম হতেই পারে।
লোভ খুব খারাপ জিনিস, মাত্র দুই টাকার জন্য আপনাকেও সে অধঃপতনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আসলে জুয়া এমনই, কতজনের যে সর্বনাশ করেছে!!
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ। আমাদের এখানে ডাব্বা খেলা বলে।
নিতাই বাবু
অন্তত আমি কখনো জুয়া নামের খেলা কোনও সময় খেলিনি। মনে পড়ে, একবার কয়েকজন বন্ধুদের তাস খেলা দেখে একজনের সাথে লাগগা ধরেছিলাম। এভাবে হেরে গিয়েছি ৩০ টাকা। ৩০ টাকা হেরে আমি আর আমার কান্না থামাতে পারছিলাম না। আমার এ অবস্থা দেখে তাস খেলোয়াড় আমার বন্ধুরা আমাকে ৩০ টাকা দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। সেসময় সেই জুয়ার আসরেই পাঁচবার নিজের কান ধরে উঠ বস করেছিলাম। আজ আপনার পোস্টের লেখনী পড়ে তা আবার নতুন করে মনে পড়ে গেল। হায়রে জুয়া! কীভাবে যে মানুষ জুয়া খেলে বা ধরে, তা আমি বুঝে উঠতে পারি না।
আকবর হোসেন রবিন
হা হা …. আমি আরও কয়েকবার খেলেছি, অন্যভাবে। টাকার পরিমাণ হতো ১০-২০ টাকা।
নিতাই বাবু
আমার একবারেই জীবনকার আক্কেল হয়ে গেছে, দাদা। সেই থেকে অন্তত আমি বান্দা কোনও জুয়াড়িকে পছন্দ করি না। মোটকথা ঘৃণার চোখেই দেখে থাকি।
মনির হোসেন মমি
এ বহু দেখেছি যখনি জেনেছি প্রথম প্রথম কয়েকটা খেলায় যেতা যায় অতপর গাট্টি বস্তা দিয়াও উপায় নাই। খুব ভাল লাগল।
মনির হোসেন মমি
তখন আর এ সবের কাছেও ভিড়িনি তবে আশপাশের মজমায় খেলা বা গান শুনতাম।
আকবর হোসেন রবিন
তখন খুব ছোট ছিলাম। কৌতুহলবশত খেলেছি। পরে অবশ্য অন্যভাবেও বাজি ধরেছি, ক্রিকেট-ফুটবল খেলায়। তবে টাকার পরিমাণ কখনও ১০-২০ এর বেশি হতো না।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ছোট কালের এমন অভিজ্ঞতা অনেকের আছে। অনেকে ইহাকে নেশা হিসেবে নিয়ে সর্ব শান্ত হয়ে বিপদে চলে যায়।
আকবর হোসেন রবিন
আমার সেই সুযোগ ছিলোনা। পরিবারের বড়রা অনেক রাগী। ধরা পড়লে একেবারে জান শেষ হয়ে যাবে, এমন একটা ভয় সবসময় কাজ করতো।
আরজু মুক্তা
আমাদের কাজের ছেলে একবার এমন করেছিলো। আব্বা ওকে এমন শাস্তি দিয়েছিলো।আমরাও ভুলে দুষ্টামি করতাম না।
বানানের প্রতি যত্নবান হতে হবে।
শুভকামনা।
আকবর হোসেন রবিন
বানানের ব্যাপারটা মাথায় রাখবো। ধন্যবাদ আপু।
জিসান শা ইকরাম
আমাদের এলাকায় মেলায় এসব চলতো,
ডাব্বা, চরকা, ফিতা ইত্যাদ।
আমি খেলতাম মাঝে মাঝে, কিন্তু কখনোই জিতিনি। খুব ছোট বেলার ঘটনা এগুলো।
বড় বেলায় ক্যাসিনোতে গেলাম দুইবার, একবার কানাডার মন্ট্রিলে, অন্যবার মালয়েশিয়ার গ্যাংটিং এ। ছোটবেলার দেখা ডিব্বা, চরকার উন্নত সংস্করন বলা যায় ক্যাসিনোকে।
দুইবারের ক্যাসিনোর ফলাফল :
মন্ট্রিলে জিতলাম বাংলাদেশী টাকার ৫২ হাজার,
মালয়েশিয়ায় জিতলাম ৯৪ হাজার টাকা।
১৫-২০ মিনিট খেলেছি।
হাড়তে হাড়তে যখন জিতলাম, তখনই খেলা বাদ দিয়ে টাকা ক্যাশ করে বের হয়ে এসেছি 🙂
আকবর হোসেন রবিন
মাই গড! আপনি তো অনেক চালাক! আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন, আপনি মোট কতো দেশে ঘুরেছেন? আপনাকে প্রায় দেখি একেকবার একেক দেশ থেকে ছবি ছাড়তে। দেখে মনে হচ্ছে আপনি অনেক আনন্দে আছেন। আমার খুব ঈর্ষাও হয় যখন দেখি চোখের সামনে কেউ দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার ঘুরাঘুরির খুব শখ।
রেহানা বীথি
লোভ, একটু একটু করে বাড়ে, নিয়ে যায় সর্বনাশের পথে।
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ। তবে আমার বাড়েনি। তাই সর্বনাশের কবলেও পড়তে হয়নি।