
জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ এবং অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা ও ফটোগ্রাফার ফারজানা রিক্তাসহ রাত দেড়টায় রওনা হলাম ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মুহুরী বাঁধে। ভোর ৬টায় মুহুরী পৌঁছলাম। ছোট্ট একটি বিল। বিলের পানি নিয়ন্ত্রণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই বাঁধ। বাঁধের মাধ্যমে শীতকালে বিলে মাছ চাষের জন্য পানি আটকে রাখা হয়। বলা যায় মাছের অভয়ারণ্য মুহুরীর বিল।
শীতকালে খাবারের জন্য প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে মুহুরী বাঁধে। আমরা নৌকা ভাড়া করে বিলে রওনা হলাম। দুই ধারে জলজ উদ্ভিদে কালিম, বালিহাঁস, ঘুরঘুরি প্রজাতির পাখি খাবার খাচ্ছে। বিলের উপরে হরেক প্রজাতির পাখি উড়ছে। ৮-১০ প্রজাতির হাঁস পাখির বিচরণ এই বিলে। বক প্রজাতির পাখিরও বিচরণ করছে। ছবি তুলছি আর বিলে জেলেদের মাছ ধরার কৌশল দেখছি। আকাশে পাখি ও বিলে মাছ শিকার। এই দুইয়ের মিলনে প্রকৃতি তার স্বভাবজাত খেলা খেলছে। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে বাঁশের খুঁটিতে বসা একটি ঈগল জাতীয় পাখির দেখা পেলাম। নৌকা নিয়ে ধীরে ধীরে সামনে গেলাম। পায়ের নখে মাছ আটকানো। বুঝতে কষ্ট হলো না এটি মাছমুরাল পাখি। দূর থেকে আমাদের দেখামাত্র উড়ে গেল। পায়ে মাছসহ বেশ কিছু ছবি তুললাম।
Osprey বা মাছমুরাল Pandionidae পরিবারের ৫০-৫৬ সে.মি. দৈর্ঘ্যের মাঝারী আকারের ভয়ঙ্কর শিকারী পাখি। পূর্ণবয়স্ক পাখির মাথা সাদাটে। পিঠ কালচে বাদামি। ঘাড়ের পিছনের টিকি আছে। ডানা লম্বা। লেজ কালচে ডোরা ও বর্গাকার। ঠোঁট কালো। ঠোঁটের ওপর-পাটির আগা লম্বা ও বড়শির মত বাঁকানো। নাকের ছিদ্র ছোট। পা খাটো। চোখ হলদে ও চোখের পাতা সবুজে-হলদে। আঙুল লম্বা ও খুব শক্ত। লম্বা আঙুলের তলায় কাঁটার মতো আঁশ থাকে। নখ বেশ লম্বা ও বাঁকানো। ধারালো নখের সাহায্যে বড় বড় মাছ শিকার করে। পুরুষ ও স্ত্রী পাখির চেহারায় ভিন্নতা দেখা যায়। ৪টি উপপ্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে একটি উপপ্রজাতির মাছমুরাল পাওয়া যায়।
মাছমুরাল বড় নদী, উপকূল ও মোহনায় বিচরণ করে। এরা একা থাকতে পছন্দ করে। একা শিকার ধরে ও নিজেই খায়। মাঝে মাঝে জোড়া দেখা যায়। পানির উপর কোনো খুঁটিতে বসে বা আকাশে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে পানিতে শিকার খোঁজে। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পায়ের নখের মাধ্যমে সহজেই শিকার ধরে ফেলে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে শুধুমাত্র মাছ। মাছ ছাড়া অন্য কোনো খাবার এরা খায় না। মাছমুরাল নিজের দেহের ওজনের চেয়েও বেশি ওজনের মাছ শিকার করতে পারে। শিকার ধরে খুঁটিতে বসে প্রথমেই মাছের চোখ নষ্ট করে এবং দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে।
মূলত এরা উত্তর আমেরিকায় বসবাস করে। সেখান থেকে আমাদের দেশে উড়ে আসে খাবারের জন্য। আমাদের দেশে প্রজনন করে না। এদের প্রজননের সময় মার্চ-এপ্রিল মাস। প্রজননকালে এরা সাইবেরিয়া ও তিব্বতে হ্রদের পাশে পাতাওয়ালা গাছে ডালপালা দিয়ে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় ২-৪টি ডিম পাড়ে। মেয়েপাখি ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।
মাছমুরাল বাংলাদেশে বিরল পরিযায়ী পাখি। শীতে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের নদী ও বিলে পাওয়া যায়। মাছের জন্য বিলে এদের বেশি দেখা যায়। এ ছাড়াও আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের বিচরণ দেখা যায়।
বাংলা নাম: মাছমুরাল
ইংরেজি নাম: Osprey.
বৈজ্ঞানিক নাম: Pandion heliaetus.
ছবিগুলো ফেনীর মুহুরীর বাঁধ থেকে তোলা ।
২৭টি মন্তব্য
সুরাইয়া পারভিন
মাছমুলার সম্পর্কে জানলাম
কৃতজ্ঞতা অশেষ সুন্দর পোস্ট এর জন্য
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু। শুভ কামনা রইলো।
ইঞ্জা
বাঁজ জাতীয় পাখি, শুধু মাছ খায়, ডিসকভারি চ্যানেলের কল্যাণে পাখিটিকে ভালোই চিনি কিন্তু দেশিয় নাম এই প্রথম জানলাম।
চমৎকার কালেকশন ভাই, মুগ্ধ হতেই হয়। 😊
শামীম চৌধুরী
ঈগল প্রজাতি পাখিদের মধ্যে এরা ভয়ঙ্কর। শিকারের জন্য পারদর্শী। কোন ভাবেই এদের হাত থেকে শিকার ফসকে যাবার কোন সুযোগ নেই। এই একটি মাত্র বাজ শুধু মাছ খায়। অন্য কোন খাবার খায় না। কিন্তু অন্যান্য ঈগল বা বাজ প্রজাতির পাখিগুলি ব্যাঙ, সাপ, কুচো খেয়ে থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এরা উত্তর আমেরিকার আবাসিক পাখি। আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। প্রজনন করে না। তবে গবেষনায় দেখা গেছে কিছু কছিু অস্প্রে বা মাছমুরাল আমাদের দেশে সারাবছরেই থেকে যায়। কারন জানা গেয়ে তারা প্রজননে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় থেকে যায়। এক সময় মারা যায়।
ইঞ্জা
আহা কষ্ট লাগলো ভাই, এছাড়া বাকি সব ইন্টারেস্টিং ও বটে।
রেহানা বীথি
ভালো লাগলো মাছমুরালের গল্প
শামীম চৌধুরী
অনেক ধন্যবাদ আপু লেখাটি পড়ার জন্য।
আরজু মুক্তা
মাছমুরাল প্রথম শুনলাম ও জানলাম। ভালো লাগলো
শামীম চৌধুরী
মাছমুরাল আপু বাংলা নাম। বাজ বা ঈগল জাতীয় পাখিদের মধ্যে এরা শিকারে ভয়ঙ্কর।
মাছুম হাবিবী
শামীম ভাইয়া আপনার পোষ্ট চোখে পড়লেই মনোযোগ দিয়ে পড়ি কারণ আপনি একমাত্র তথ্যবহুল এবং অজানা পোষ্ট দেন। এতদিনে আপনার প্রতি যে ধারণা জন্মেছে তা হল। আপনি একজন জনপ্রিয় ফটোগ্রাফার! ছবি তুলেন অনেক। আর ছবি তুলার পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে আমাদের উৎসাহিত করেন। আশা করবো সব সময় এরকম লেখাগুলাই আপলোড দিবেন। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া, শুভ কামনা আপনার জন্য।।
শামীম চৌধুরী
আমি কৃতার্থ। আপনি কষ্ট করে সময় নিয়ে আমার লেখা পড়েন বলে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করছি ও ছবি তুলছি। ছবি তোলা আমার শখ ও নেশা। প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা যায় বন্যপ্রানীর সাথে প্রেম থাকলে। পাখি দেখতে দেখতে এখন রিতিমতন মুখস্থ হয়ে গেছে কোনটা কোন পাখি এবং তাদের জীবন বৈচিত্র। দোয়া করবেন যেন সুস্থ্য থাকতে পারি।
বন্যা লিপি
এ্যানিমেল প্লানেট,ডিসকভারি চ্যানেল আমার ভীষণ প্রিয়।বিশেষ করে জীবজন্তু পাখির উপরে প্রচারিত ডকুমেন্ট।আপনার পাখি বিষয়ে লেখা এর আগে পড়া হয়নি। আজ জানলাম বাজ-ঈগলের সম্পর্কে।দেশিয় নাম মাছমূরাল।
ভালো লাগলো।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু। আমি পাখি ও বণ্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করি। এটা আমার শখ ও নেশা। যদিও এ থেকে আমাদের দেশে কোন আয়ের পথ নেই। তারপরও প্রকৃতির বন্যপ্রাণীর সাথে মিশে থাকতে ভালো লাগে। ধারাবাহিক ভাবে পত্রিকায় আমার লেখা ও ছবি ছাপা হচ্ছে। ইহা ছাড়াও আমি ব্লগে নিয়মিত পাখি সম্পর্কীয় লেখা দিচ্ছি। কষ্ট হলেও একটু সময় নিয়ে পড়বেন আপু। তাহলে অনেক কিছু জানতে পারবেন বন্যপ্রাণী সম্পর্কে। ভালো থাকবেন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
মাছমুলার সম্পর্কে জানলাম দাদা।
অশেষ কৃতজ্ঞতা সুন্দর পোস্ট এর জন্য।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ দাদাভাই। আপনার জন্য রইলো শুভ কামনা।
ছাইরাছ হেলাল
মাছমুরাল শব্দটি এই প্রথম শুনলাম।
আর জানলাম অনেক, জানতেই আছি।
শামীম চৌধুরী
হেলাল ভাই বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করতে যেয়ে যতটুকু জেনেছি ও শিখেছি সেটাই চেষ্টা করছি অন্যদের জানাতে। তারাও যেন আমার মতন একদিন প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে বন্যপ্রাণীর উপর সদাচারন করেন। দোয়া করবেন।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
পড়ে ভালো লাগলো।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ বাহার ভাই।
মনির হোসেন মমি
ছবির সর্টা কিন্তু ফাটাফাটি। জানছি অনেক কিছুই …।
মোঃ মজিবর রহমান
মাছমুরাল নামই তো এই শুনলাম। জানলাম ।
শামীম চৌধুরী
মজিবর ভাই এটা আমাদের প্রচলিত নাম। এই নাম নিয়ে একটি মিথঃ আছে। পরে কোন একসময় লিখবো। শুধু ধারনা দিচ্ছি। নদীর ধারে নববধু গেছেন কলসীতে পানি আনতে। এমন সময় মাছমুরাল পাখি নববধুর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার ধরতে। ভয়ে নববধূ অজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জানা জানি হবার পর গ্রামের সব লোক ছুটে আছে। কি হয়েছে বলার সঙ্গে সঙ্গে নববধু বলেন ঈগল পাখিটা মাছটারে মুরাইয়া ধইরা আমার চোেখের সামনে পড়লো। এই হলো মোটামোটি সারাংশ।
মোঃ মজিবর রহমান
দারুন কাহিনী বললেন। আপনার লেখায় জানার আছে জাঞ্চহিও ভাই।
নিতাই বাবু
আপনার লেখা পড়ে মাছমুলার সম্পর্কে অনেককিছু জানা হলো। যা আগে কখনোই জানা ছিল না। এমন আরও চাই।
শামীম চৌধুরী
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ দাদা। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আপনাদের জানানোর জন্য।
তৌহিদ
মাছমুলার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম ভাইজান। তবে নামটি আজই প্রথম জানলাম।
লিখুন নিজের মতন করে।
শামীম চৌধুরী
ক্যামেরার পিছনের গল্পটি নিজের মতন করে লেখা যায়। তবে পাখির তথ্য নিজের মতন করে লেখা যায় না। গবেষকদের সাহায্য নিতে হয়। যার জন্য প্রচুর লেখাপড়া করতে হচ্ছে আমাকে।