ব্রেইন=মগজ
ওয়াশ=ধোলাই
অর্থাৎ ব্রেইন ওয়াশ বলতে সোজা বাংলায় বোঝায় মগজ ধোলাই! লেখাটি পড়তে গিয়ে কারো কারো হয়ত হাসি পাবে, কারো কাছে মনে হবে অযাচিত টপিক।তবে আমি আপনাদেরকে আজ এই ব্রেইন ওয়াশ তথা মগজ ধোলাইয়ের গুরুত্ব বোঝাবো না, বরং এর কয়েকটা উদাহরন তুলে ধরব। ফলে আপনারাই বুঝে যাবেন এর প্রয়োজনীতা এবং অপ্রয়োজনীয়তা।
ধরুন, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন না। এবার, আপনি একটি অচেনা জায়গায় বেড়াতে গেলেন।হতে পারে সেটা আপনার বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুটি বলে দিলো, এখানে রাতের বেলা বের হওয়া যায় না, কারন এলাকাটা ভালো নয়, ভূতে ধরে।বন্ধু বেছে বেছে কটা অলৌকিক ঘটনাও আপনাকে শুনিয়ে দিলো। তখন নিজের যত বিশ্বাসই থাকুক না কেন “ভূত বলে কিছু নেই” ; তথাপি বন্ধুর কথাগুলো বারবার আপনার কানে বাজবে। আপনি কিছু না দেখেও অনেক কিছু দেখে ফেলবেন। হয়তো একটা খড়ের গাঁদাকেই আলাদীনের চেরাগ থেকে সদ্য বের হওয়া জীন মনে করতে থাকবেন!
আবার মনে করুন একটা নতুন বই পড়ার জন্য হাতে নিলেন। বইটিতে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে। আপনি ট্রান্সদের বিষয়ে মূলত কিছুই জানেন না।কিন্তু বইটি কেনার সময় দোকানী আপনাকে বলে দিয়েছে, ট্রান্সরা কত্ত খারাপ। খারাপ একটা বিষয়ের ওপর লেখা এ বইটি। অতপর বইটি পড়ে ট্রান্সদের সবগুলো খারাপ দিক খুঁজে বের করে ফেলতেই চাইবে আপনার মন তথা মগজ।
খুব বেশি উদাহরন দেব না। এটাই সর্বশেষ এবং সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরন যা আমি এখন আপনাকে দিতে চলেছি! ধরুন কেউ আপনাকে খুব ভালো করে বোঝালো মিস লিমা তো সাম্রাজ্যবাদী! এখন মিস লিমা এক জায়গায় বিড়াল হত্যার প্রতিবাদে ভাষণ দিতে গেলেন। এবার আপনার উৎসুক সদ্য ধৌত হওয়া মগজ সেখানে বিড়ালের জন্যেও একটি সাম্রাজ্য খুঁজবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
ঠিক তেমনি কেউ যখন অন্যের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে, আমরা তা মহানন্দে গলাধকরণ করি। কেননা, আমরা নিজেদের মস্তিষ্ককে অন্যের দ্বারা পরিচালিত করতে বেশি পছন্দ করি। এর কয়েকটা কারন থাকতে পারে। যেমন:
১. জাতি হিসেবে আমরা খুব অলস। অলসতা আমাদের মননে, মগজে সর্বত্র বিরাজমান। নিজের ব্রেইনকে একটু খাটাবো, একটু নিজস্বতা দিয়ে কোন বিষয়কে ভাববো, তা আমরা করি না। কেবলই অন্যের চিবিয়ে দেওয়া চর্ব্যচোষ্যকে গলায় নিয়ে ঢোক গিলতে পারলেই বাঁচি।
২. আমরা PNPC (পরনিন্দা/পরচর্চা) কে খুব ভালোবাসি। অন্যকে চর্চা করে সুখ খুঁজি, ভাবি নিজে খুব ভালো! কিন্তু নিজে ভালো হতে গেলে অন্যের চর্চা করে কোন লাভ নেই, বরং নিজের চর্চা করতে হবে, এটাই বোঝাতে পারি না নিজেদের মস্তিষ্ককে।
৩. অন্যের অপমান দেখার বড় নেশা আমাদের। এ নেশা এতই নেশা যে, যেখানে সেখানে, যখন তখন অন্যকে বিব্রত করে বিনোদন নেই আমরা! কেন জানি মনে হয়, সুষ্ঠু বিনোদনের আমাদের বড়ই অভাব! তাই কাওকে বিব্রত করার জন্য তার নামে অন্যের কানে বিষ ঢেলে তিক্ততা তৈরি করে রাখি।
৪. আমাদের অতি কৌতুহলী মন। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে আমাদের আগ্রহ বেশি। কার হাঁড়িতে কি খবর আছে তা সংগ্রহে ব্যস্ত সদা। খবর পেলেই তা নিজের মনমত সাজিয়ে নিজের মস্তিষ্কের আবর্জনা অন্যের মস্তিষ্কে ঢেলে দিয়ে আসি।
৫. যারা মগজ ধোলাই করে তাদের তুলনায়, যাদের মগজ ধোলাই হয়, তারা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের প্রানি। জীবন ধারনের দিক থেকে নয়, বরং মানসিক দৃঢ়তার দিক থেকে এরা নিম্ন স্তরে বসবাস করে।
এবার আসি, কারা অন্যের ব্রেইন দ্বারা ধৌত হয়?
সম্ভবত তারাই অন্যের দ্বারা ধৌত হয়, যারা খুব দূর্বল মস্তিষ্কের! তারা নিজের ওপর,নিজের যুক্তির ওপর, বুদ্ধির ওপর ভরসা রাখতে পারে না। অথবা তারা খুবই অলস, তারা কোনকিছুকেই নিজের মগজ খাটিয়ে ভাবতে ও ব্যাখ্যা করতে চায় না।
তারপর আসি এর উপকারীতা নিয়ে। এর উপকারী দিক হলো, আপনার ব্রেইন অন্যকেউ ধৌত করে দিলে আপনার সময়, শ্রম সবই বাঁচলো। আপনার মগজ পুরোটাই অব্যবহৃত রয়ে গেলো! টাটকা নতুন যে মগজ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, তাই নিয়ে ফিরতে পারবেন।
এবার ক্ষতিকারক দিক বলি। ধরুন আপনার চার কদমের ভেতর একজন বিজ্ঞানীর বসবাস। তার কাছ থেকে আপনার অনেক কিছু শেখার আছে, অনেক কিছু পাবার আছে। কিন্তু তার সাথে পরিচিত হবার আগেই এক অতি সামাজিক প্রানি আপনার মগজ ধোলাই করে দিয়ে বললো, “এই লোক অসামাজিক। কারো বাড়ি যায় না, মেশে না” ইত্যাদি। তখন এসব শোনার এবং বিশ্বাস করার পর কি তার সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছেটা আপনার আর থাকবে? অথবা পরিচিত হতে গেলেও তো বারবার মনে প্রানে আপনার ধৌত হওয়া ব্রেইন ঐ নেতিবাচক সংকেতগুলোই খুঁজতে থাকবে! আর প্রকৃতিও তেমন, আপনি যখন নেতিবাচক কিছু দেখতে চাইবেন, সেও আপনাকে সেটাই দেখাবে!
অথচ ভালো ভাবে জেনে দেখুন, ঐ ব্যক্তি হয়ত সারাদিন নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কারও হাঁড়ির খবর জেনে তাকে বিব্রত করা বা হেনস্থা করার বিন্দু মাত্র কোন আগ্রহ তার নেই। কিন্তু নিজের মগজের অসারতার কারনে তেমন একজন গুনী মানুষের সান্নিধ্য আপনি হারালেন। হয়ত তার নামে নেতিবাচক ভেবে সাময়িক বিনোদন ও লাভ করলেন। কিন্তু আপনার কোন সুদূর প্রসারী উন্নয়ন ঘটলো নাহ!
***যাই হোক, আমি কোন মনোবিজ্ঞানী নই। যা লিখেছি তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। এরপর এই সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম। ***
১৮টি মন্তব্য
তৌহিদ
সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন। আমাদের নিজেদের মানসিতার পরিবর্তন জরুরী।
মনোবিজ্ঞানী না হয়েও এত জানলেন কেমনে? পড়েছেন নাকি?
আমাদের কিছু নেতিবাচক দিক অন্যের মনোকষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায়, এটা অনেকে বুঝে করি আবার না বুঝেও করি।
সবার বোধোদয় হোক।
ভালো থাকবেন।
নীরা সাদীয়া
আমিও ভাবছি, এতকিছু জানলাম কি করে? আসলে নিজের জীবন থেকে মানুষ যে শিক্ষা পায়, তা কোন বই পুস্তক পড়ে পায় না। আমিও সেখান থেকেই জেনেছি। কিছুটা ভেবে নিয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে। শুভকামনা নিরন্তর।
শুন্য শুন্যালয়
ইন্টারেস্টিং 🙂
আমার মগজ একারনেই কেমন জানি অকেজো হয়ে গেছে। এতো বেশি খরচ করি। আমি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত কম হয়। যেকোন জিনিসে আমার নিজের মতামত থাকতে হবে, তবে সবসময় আসলে সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা তো আসলে শুধু প্রাক্টিকেলি নিজেকে দিয়ে প্রমাণ করে হয়না, তাই আমাদের অন্যদেরকে বিশ্বাস করতে হয়। বন্ধু, আত্মীয়স্বজন।
পরনিন্দা ছাড়া মানুষের চলবে কি করে? এইটা ব্যাপক বিনোদন, এর স্বাদ কেউ চাইলেই কমাতে পারবেনা।
তুমি সবসময়ই এমন সুন্দর সব বিষয় তুলে আনো, যাতে ভাবনাচিন্তার পথ থাকে অনেক।
নীরা সাদীয়া
শূন্যদি, কোন মানুষই ১০০% খাঁটি হতে পারে না। আপনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের মতামতকে প্রাধান্য দেন, এটাই অনেক। আমার কেন যেন মনে হয় মগজ খরচ করলে তা কমে না, বরং আরও ক্ষুরধার হয়।
আর হ্যাঁ, আমার লেখার বিষয়বস্তু আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগলো।
মনির হোসেন মমি
সুন্দর একটি লেখা উপস্থাপন করলেন।
জীবনের বাস্তবতা বড় কঠিন কেউ এমন বাস্তবতায় বলি হন কেউ বা চতুর ধর্মব্যাবসায়ীর ফাদে পড়ে একান্তই স্রষ্টাভক্তের কারনে মগজ ধোলাই হয়ে থাকে।লিখতে থাকুন।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। ধর্ম ব্যাবসায়ীর কথাটাও আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু বিতর্কিত হতে পারে,কারো আঘাত লাগতে পারে এসব ভেবে তুলে আনিনি।
অনেক শুভকামনা জানবেন।
ইঞ্জা
Very good post.
যথার্থ একটি লেখা দিলেন, খুব ভালো লিখেছেন।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাইয়া। শুভ কামনা নিরন্তর।
মাহমুদ আল মেহেদী
মগজ/ব্রেইন নামক জিনিসটাকে আমার কাছে কারখানার মেশিনের মত মনে হয়, মনে হয় দিন-রাত সে কাজ করে চলেছে। দু-হাত দিয় নিজের কানটাকে বন্ধ করে দেখেন! মগজের কাজ করার শব্দ পাবেন। সে যাহোক ব্রেন, তার একটা কাজের পরিধি আছে, সেই পরিধি অনুযায়ী সে কাজ করবেই, যখন সে ভালো কোন কাজ পাবে তখন সে সেই কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থাকবে, আর যখন কাজ থাকবে না তখনও সে কাজই করবে, সেটা পরচর্চা বা খারাপ, যা করাবেন তাকে দিয়ে তাই সে করবে। এটা আবশ্য ব্রেনের দোষ না, আমি কি কাজ তাকে দেই সেই আমির দোষ/গুন।
দারুন একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। আমিও আমার একটা লেখা লিখছি যার ভেতরে এই বিষয়টা আছে তাই আপনার লেখাটা পড়ে বেশ উপকৃত হলুম। ধন্যবাদ আপনাকে, ভালো থাকুন সবসময়।
নীরা সাদীয়া
আপনার মন্তব্য পড়ে আমিও চিন্তা ভাবনার আরেকটি নতুন খোড়াক পেলুম। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। শুভ কামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি মনোবিজ্ঞানী কী না জানিনা, তবে আপনি নিকটাত্মীয়া তা বুঝতে পারি।
আপনার পয়েন্ট গুলোর সাথে একমত।
শুধু আপনার মত করেই বলি আমরা কান কথা (অন্যের কথা) শুনতে পছন্দ করি, কোন চিন্তা ছাড়াই।
আপনার লেখা পছন্দ হয়েছে, পড়বো নিয়মিত।
নীরা সাদীয়া
আমার লেখা আপনার পছন্দ হয়েছে জেনে খুশি হলাম। খুব সুন্দর করে মূলকথাটা বলে দিয়েছেন। ‘কান কথা’ শব্দটা পছন্দ হয়েছে। ধন্যবাদ ভাইটি।
প্রহেলিকা
খুব সুন্দর করে গুছিয়ে তেতো অনেক সত্যই বলে গেলেন। চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন!
ভালো লিখেন বলেই এত কম লিখেন? এমন লেখা পড়ে ক্লান্তি আসে না। আরো পড়তে চাই এমন লেখা!
নীরা সাদীয়া
আপনার মত সুন্দর করে লিখতে পারলাম কই?
এবার থেকে আরো বেশি লিখবো, আপনাদের কাছ থেকে নতুন কিছু শেখার আশায়।
ধন্যবাদ, শুভ কামনা।
সাবিনা ইয়াসমিন
ব্রেনটা আমার, আমাকেই এটার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এটা যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজের আয়ত্বে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ ওয়াশ করতে পারবে না। খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। আমরা কি কেউ চাইলেই আমাদের হাত–পা–চোখ খুলে দিয়ে দেই? দেই না, তাহলে আমাদের চালিকাশক্তি ব্রেনটা কেন যারতার হাতে তুলে দেই? এগুলো প্রবল অলসতা আর হীনমন্যতা থেকে হয়। আমি পারবো না বা সে সঠিক, যুক্তিগত ব্যাখ্যা ছাড়া পরনির্ভরশীল ব্যাক্তিরাই ক্রমাগত ব্রেনওয়াশের শিকার হয়।
লেখা ভালো লেগেছে নীরা। অনেক গোছানো লেখা, ধারাবাহিকতা বজায় ছিলো।
শুভকামনা রইলো ❤❤
নীরা সাদীয়া
একদম ঠিক বলেছেন। কেউ চাইলেই আমাদের ব্রেইনকে ওয়াশ করতে পারে না, যদি আমরা সচেতন হই।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপি। শুভ কামনা রইলো।
রিতু জাহান
চমৎকার লিখেছো। এক কথায় চমৎকার। তুমি তোমার পোষ্টেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছো।
একদম সহমত। যারা বেশি দুর্বল মস্তিষ্কের মানুষ তারাই সাধারণ খুঁটিনাটি অকেজো বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে থাকে।
অথচ কতো কতো উন্নত বিষয় নিয়ে ভাববার বিষয় আছে।
একসময় সৈয়দপুরে থাকতে বিহারিদের ঝগড়া দেখতে মার খুব মজা লাগতো। বলতে পারো নেশায় পেয়ে বসেছিলো।
সামনের বাড়িতে ঝগড়া লাগলেই আমি গেটে গিয়ে দাঁড়াতাম। আসলে মূলত ওরা ওদের ভাষায় বিচিত্রভাবে ঝগড়া করতো, একে অপরকে চরমতম অপমান করতো। এটা আমি দেখতাম খুব মজা নিয়ে।
দেখা যাচ্ছে আমি জরুরি কাজ করছি, উঠে গিয়ে ওদের ঝগড়া দেখতাম।
একসময় নিজেকেই ধিক্কার দিলাম।
আমরা মানুষের মুখের কথায় খুব বেশি নির্ভর করি। নিজেদের মনের চোখকে বন্ধ রেখে দেই।
ভালো থেকো।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। আমরা মানুষের মুখের কথায় বেশি বিশ্বাস করি, মনের চোখকে বন্ধ করে দেই। এটাই আমাদের প্রধান সমস্যা।
অনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো থাকবেন আপনিও।