বাবার বেশ কিছু লেখা ভর্তি একটা ড্রাইভ পেল প্রথা। কিছু লেখা অসম্পূর্ন,
‘বিক্ষিপ্ত চিন্তা’ শিরোনামে। এসব লেখা ডায়েরির মতও কিছুটা। তারিখহীন লেখা থেকে সময়ের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
* যত ঝামেলা, ইটপাটকেল সব বাসার সামনের চৌরাস্তায়। পুলিশের সাথে খুব ইটপাটকেল নিক্ষেপ দেখলাম। মজাই লাগল এটি দেখে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মোবারক ভাই, মোস্তফা ভাই, রতন ভাই, সেজদা তারা ভাই, দেলোয়ার ভাই এর নেতৃত্বে প্রায় একশত ছাত্র এই ঘটনায় অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির জন্য হরতালের সমর্থনে মিছিল পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে গেলে এই সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ৭ পুলিশ ৩ ছাত্র আহত, মাথা ফেটেছে। ছাবেদ আলী ডাক্তার চাচার কাছে ব্যান্ডেজ নিচ্ছে সবাই। চিকিৎসায় কোনো শত্রু নেই। পাশাপাশি বসে শুয়ে চিকিৎসা নিয়েছে সবাই।
* নিরু আপার আব্বা পিডিএফ ( পাকিস্তান ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট) এর রাজনীতির সাথে যুক্ত, চরম মৌলবাদী। অথচ নিরু আপা শহরের প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে থাকেন। ইংরেজীর শিক্ষক অত্যন্ত আধুনিক রব স্যার হচ্ছেন নিরু আপার বর।
* দেশটি চলছে বঙ্গবন্ধুর হুকুমে। তিনি যা বলছেন জনগন তা পালন করছে। ৭ ই মার্চের পরে থানার সামনের মাঠে রোজ বিকেলে কুচকাওয়াজ হয়। দেশী বন্দুক, থানা থেকে সংগ্রহ করা রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং হয়। লোকজন তীর ধনুক, বাঁশের লাঠি নিয়েও আসে।দিন দিন ট্রেনিং এবং কুচকাওয়াজে অংশ নেয়া জনতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
* পাক সেনারা আজ শহর আক্রমন করলো। গানবোট থেকে মহুর্মুহু মর্টাল সেল নিক্ষেপ করায় জনতার সামান্য প্রতিরোধ ভেঙে গেল। সমস্ত শহর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। প্রভুভক্ত কুকুরগুলোর ঘরবাড়ি অক্ষত থেকে গেলো।
* রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিরা প্রতিদিন গ্রাম থেকে মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু মুসলিম সবাইকেই।
* বড় তিন ভাইর সংবাদ পেলাম আজ। মেঝ ভাই কি বেঁচে আছেন?
* বেইমান রাজাকারদের তৎপরতায় কোন গ্রামে বেশিদিন থাকতে পারছিনা। অজানা অচেনা বাড়িতেও আশ্রয় নিচ্ছি সবাই।
* স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র শুনি রাতে চুপিচুপি।
* আব্বাকে অবশেষে ধরে নিয়ে গেল পাকসেনারা। বরিশাল ক্যাম্পে অমানুষিক ২ মাস নির্যাতনের পরে ৩০ গোডাউন বধ্যভূমিতে ব্রাস ফায়ারের ঠিক আগমুহুর্তে শুয়ে পরায় বেঁচে যান আব্বা। সারারাত অন্য মৃতদেহের নীচে মৃতের মত শুয়ে থেকে ভোররাতে সাথে বেঁচে যাওয়া অন্য একজনের সাথে কীর্তনখোলা নদীতে ভেসে ভেসে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ওঠেন। ফিরে আসেন আব্বা।
* মুক্তি বাহিনী এসে গিয়েছে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিরা সব চলে গেছে।
* জয় বাংলা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। মুক্তি, আহ প্রিয় স্বাধীনতা।
* বাঙালীদের একটি স্বাধীন দেশ। ভাষার ভিত্তিতে একটি জাতির পুনর্জাগরণ, যার সূত্রপাত ৫২ এর ভাষা আন্দোলন। মুল শক্তি বাংগালী জাতীয়তাবাদ। এটি যত শক্তিশালী হবে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তত দুর্বল হবে।
* ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় জাতির জনককে। রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তান জিন্দাবাদের অনুরুপ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শোনা যায়। বাংলা এবং বাংগালী জাতীয়তাবাদের উপর যে আঘাত আসবে এটি সুস্পষ্ট।
* জেলখানায় হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের পরিচালকদের। বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের সমস্ত বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। পাকিদের অত্যাচারের স্বাক্ষী কেন থাকবে? নিয়াজীর আত্ম- সমর্পণের স্থানে নির্মিত হয় শিশু পার্ক।
গর্তে লুকিয়ে থাকা সমস্ত রাজাকাররা প্রকাশ্যে চলে আসে। রাজাকার শিরোমনি গোলাম আজম ফিরে আসে দেশে।
* রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার শুরু।
* মুল শক্তি বাংলা, বাঙালিয়ানাকে ধ্বংস করার মিশন শুরু। আঘাত আসতে থাকে এসবের উপর। রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, নারীদের লাঞ্ছনা, সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা সবই একই সুত্রে গাঁথা। বাঙ্গালির মুল চেতনার শক্তি বাংলা নববর্ষ উদযাপন, একুশে ফেব্রুয়ারী এবং অসাম্প্রদায়িকতা ধ্বংস এদের করতেই হবে। সাম্প্রদায়িকতায় এরা সফল পুরোপুরি। বাংলা নববর্ষ পালন এবং শহীদ দিবস সম্পর্কে প্রশ্ন উঠাতে সক্ষম হয়েছে এরা।
* বাসার বাইরে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি বোরকাবৃতা নারীদের সংখ্যা দেখে। ১৯৭১ এর পূর্বে মুরুব্বী ধরনের নারীরা বোরকা নিতেন। স্কুল বা কলেজের মেয়েদের মাঝে বোরকার পরিমান কম ছিল। ১৯৭১ এর পূর্বে এবং ৭৫ পর্যন্ত যে সাম্প্রদায়িক সম্পৃক্তি ছিল বর্তমানে তার ছিটেফোঁটাও নেই।
* ইসলাম আর বাঙালিয়ানাকে প্রতিপক্ষ বানাতে সফল হয়েছে তারা।
* যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশ আলোতে পূর্ণ হয়। আর আমাদের চারদিক অন্ধকার গ্রাস করছে। ডুবে যাচ্ছি আমরা।
* কত কষ্টের নিজের প্রিয় দেশ ত্যাগ করা। কবে আবার প্রাণ উজার করে গাইব ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি…..
প্রথা মা কই তুই?
এই যে আসছি বাবা। বাবা তোমার কিছু লেখা পড়েছি আজ, মা দিয়েছেন। চলো বাবা বাংলাদেশে যাই, তোমার দেশকে দেখা হলোনা আমার। দেশ নিয়ে যার এত মমত্ব সে দেশের বাইরে কেন থাকবে? ১৪ এপ্রিল বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেখব এবার।
তুই থাকতে পারবি না মা আমার দেশে। বর্ষবরণে বোমা হামলায় আমি চোখ হারিয়েছি, প্রায় বধির এখন।
বাবা আমি তো তোমারই মেয়ে। যে স্থান, কাল হতে তোমার দেখা বন্ধ হয়েছে, তুমি আমার চোখ দিয়ে সে স্থান, কাল হতেই দেখা শুরু করবে আবার।
…. ১ বৈশাখ ১৪২৪, ভোর ৬:৩০ এ বিমানবন্দর সড়ক থেকে রমনা বটমূলের উদ্দেশ্যে দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে একটি মাইক্রোবাস। প্রথা গান গাইছে উচ্চকণ্ঠে বাংলা বর্ষবরণের,
২৫টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আহা সেইসব নির্যাতনের কথা শুনেছি, শুনতে শুনতে মনে হয় নিজেও ছিলাম যুদ্ধে, রক্ত এখনো ছলকায়, আগুন ধরায় আমার রক্তে, বুঝি দেশ স্বাধীন হয়েছে, এও বুঝি স্বাধীন দেশ হলেও জনগণ এখনো পরাধীন, অপেক্ষায় নতুন সূর্যের, প্রথারা গেয়ে যাক এই দেশের গান, গেয়ে উঠুক নববর্ষের গান, বাংলায় গান, এই কামনা কায়মনোবাক্যে।
জিসান শা ইকরাম
আমরা যেন আমাদের শিকড়কে না ভুলি।
শুভ কামনা।
ইঞ্জা
এই বাক্যটিই সবার মনে গেঁথে থাকুক ভাইজান।
ছাইরাছ হেলাল
এমন বর্ষবরণের বরণ উচ্চকিত হোক আমাদের হৃদয়ের হৃদয়ে।
প্রথারা বাঁচুক স্বপ্নগেয়ে।
জিসান শা ইকরাম
লালিত স্বপ্নেরা বেঁচে থাকুক যুগ যুগ ধরে।
মিষ্টি জিন
দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা পরাধীন রয়ে গেছি।ধর্মে নামের যাতাকলে পিষে আমরা আমাদের ঐতিহ্য কে হারিয়ে ফেলেছি দিন দিন।
তবুও আশায় বুক বেধে আছি একদিন সব জডা থেকে মুক্ত হবই আমরা।
আপনার লেখার স্টাইলই অন্যরকম। অন্তর ছুয়ে যায়।
জিসান শা ইকরাম
ধর্মকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে ধর্মের পালকরা। এতে তারা সফলও হয়েছে।
তবুও আমরা আমাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখব।
নীলাঞ্জনা নীলা
আজকাল বাঙালীয়ানা চাপা পড়েছে ধর্মের আড়ালে।
পহেলা বৈশাখ আর শহীদ দিবস নিয়ে কি জঘণ্য রাজনীতি চলে!
নানা অসাধারণ লিখেছো তুমি।
এমন গল্প তুমি ছাড়া আর কে লিখতে পারবে বলো?
জিসান শা ইকরাম
বাঙালীয়ানার শক্তিকে যে এদের খুব ভয়। তাই বাঙালী জাতিয়বাদ পরিবর্তিত হয়ে যায় এদের লোভী চোখে।
এরা অনেকটাই সফল। তবে একদিন অবশ্যই এদের মুখোষ খুলে যাবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিক বলেছো নানা একদিন সত্যের জয় হবে। মুখোশও খুলে যাবে।
ওই যেমন দেরীতে হলেও রাজাকারদের ফাঁসি ঠিকই হয়েছে।
শুন্য শুন্যালয়
অদ্ভুত সুন্দর একটি লেখা।
প্রথা তো এই বাবারই মেয়ে তাই তার মধ্যেও বর্ষবরণের গান বেজে উঠবেই। এমন মমত্ববোধ নিয়েও কাওকে যেন দেশ ছেড়ে যেতে না হয়!
হিমেল নিয়ে আপনার একটি গল্প ছিলো। আমি লেখা দিয়ে মানুষ বিশ্লেষন করতে চেষ্টা করি। আপনার দেশাত্মবোধ কে আমার শ্রদ্ধা।
অনেক ভালো লেখেন আপনি।
জিসান শা ইকরাম
প্রথারা একদিন দেশকে পালটে দেবে, আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করবে বলেই স্বপ্ন দেখি।
হিমেলের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, ধারাবাহিক লেখার ইচ্ছে ছিল, কত লেখার ইচ্ছে যে অপুর্ন থেকে যাবে কে জানে।
লেখা শিখছি আপনাদের কাছ থেকে।
রুম্পা রুমানা
প্রথারা প্রথাবিরোধী হোক। শেকড়ের নিকট ফিরুক ।উয়ানুক দেশকে। ভালো লাগা রইলো।
রুম্পা রুমানা
জানুক*
জিসান শা ইকরাম
একদিন প্রথারা ঠিকই আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তব করবে।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সহমত পোষন করছি -{@
আমরা স্বাধীনত দেশ পেয়েছি সত্যিই তবে ব্যাক্তি স্বাধীনতা ক্রমশতঃ অন্ধকারে যাচ্ছেন।আমাদের পূর্বপূরুষরা সে দিনই ভুল করেছিলো যখন রাজাকারদের ক্ষমা করে এ দেশেই থাকার সুযোগ করে দেয়া আজ তাদেরই বংশধররা দেশকে নাপাকি বানাতে গোপনে কাজ করছেন।জানি না এ অন্ধকার শেষে আলো আসবে কি না তবে আমি আশাবাদি…আমরা না পারলেও আমাদের সন্তানেরা তা করবে।সেই জন্যই তাদের সঠিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর রাজাকারদের লেজের বিন্যাস ভালো করে চিনিয়ে দিতে হবে।
ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
৭৫ এর পর সব পালটে গেছে সব। দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়া শুরু তখনই, যার কুফল আমরা ভোগ করছি।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
প্রথারা এবং প্রথার বাবারা এদেশে ছিলো, আছে, থাকবে অনন্তকাল পর্যন্ত।
চাওয়ার এবং পাওয়ার পূর্ণতা ও অপূর্ণতার মাঝেই। শিকড় কখনো উপড়ে ফেলা যায়।
আপনার লেখার স্টাইল সুন্দর। -{@
জিসান শা ইকরাম
শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে আমাদের।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
শিখড় কখনো উপড়ে ফেলা যায় না। (y)
আবু খায়ের আনিছ
একাত্তরের ডায়রী নাম দিলে মন্দ হতো না। অসাধারণ লেগেছে গল্প।
জিসান শা ইকরাম
৬৯ থেকে বর্তমান এসেছে যে লেখায়।
শুভ কামনা।
মৌনতা রিতু
একটা ডায়রির লেখা পর্বে পর্বে সুন্দর লিখলেন ভাইয়া। সত্যি সব কিছু গ্রাস করে ফেলেছে অন্ধ মানসিকতায়।
এক সময় এই আমাকে জোর করা হয়েছে বোরখাতে। আমি ছিলাম উচ্ছল সব কিছুতে। ধর্মীয় গোড়ামি অসহ্য লাগে আমার। তাই পরিবারের গোড়ামিতে বঞ্চিত হয়েছি সব কিছু থেকে।
গান, কবিতা কিছুই শিখতে দেয় নাই।
পৃথার এই ফিরে আসাটা খুব ভাল লাগলো। আমি আমরা অনেকেই এখনো একটা অদৃশ্য শৃঙ্খলে বন্দী। খোলার উপায় নেই।
ব্লগার সজীব
সব কিছু ধংস করে দেবে এরা। মৌলবাদীদের ভয়ংকর চেহারা দেখা গিয়েছে ৫ মে শাপলা চত্ত্বরে। স্বপ্ন চলুক।
মেহেরী তাজ
সব প্রথাদের স্বদেশ যাত্রা শুভ হোক। আর কখন ও না ঘটুক কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।