২০১৬ সালের এক সোনালী বিকেল। আমি কম্পিউটার ট্রেনিং করে বাসায় ফিরি, সূর্য তখন তার শেষ সোনালী আভা ছড়াচ্ছে, একটু পরেই বিদেয় নেবে। প্রকৃতি বেশ চঞ্চল, গাছে সবুজ পাতা, সম্ভবত তখন গ্রীষ্মকাল ছিল।বাড়ি ফিরে দেখি সূর্যের সেই নরম সোনালী আভা নেমে এসেছে আমার বাড়ান্দায়, আমার অতিথি হয়ে। বাড়ান্দায় বসে আছে পাঁচটা ফুটফুটে সোনারঙের তুলতুলে ছানা। তাদের বয়স মাত্র দুদিন।তাদের দেখেই আমার চোখ ভরে উঠল বিষ্ময়ে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এদের দিয়ে কি হবে?” বাবা বললেন, এরা তোমার ছেলেমেয়ে, তোমার জন্য এদেরকে এনেছি।তুমি ওদের লালন পালন করবে।” আমি বুঝে নিলাম এটা ঠাট্টা।কিন্তু এ ঠাট্টা যে কবে কখন সত্যি হয়ে গেছে তা আমি বুঝতেও পারিনি। এরপর থেকেই শুরু হল নতুন সংগ্রাম। এত ছোট ছানা,আস্ত চাল খেতে পারেনা। বাবা চাল গুঁড়ো করে এদের খাওয়ান। তাই দেখে আমিও সেটাই করলাম। বাবা বাসায় না থাকলে আমি তাদের জন্য গুঁড়ো করে খাবার দেই, তারা টুকটুক করে খায়। খাঁচা ছাড়া করলেই এদিক সেদিক দৌড় শুরু করে। একদিন দুদিন করে তাদের বয়স বাড়ছিল আর দৌড়াদৌড়ির পরিমান আরো বাড়ছিল। ছোট্ট একটা খাঁচা, সেটা তুলে দিলে কি খুশি তারা! এক টুকরো খাবার মুখে নিয়ে একজন দৌড় দিচ্ছে তো বাকিরা তার পেছনে দৌড়ুচ্ছে, এটাই তাদের মজার খেলা। এ খেলা তারা খেলে যেমন অানন্দ পায়, আমরা তা দেখে আরো বেশি আনন্দ পাই। প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে তাদেরকে ছাদে নিয়ে যাই। খাঁচা খুলে দেই। তারা খেলাধুলা করে।তারপর তাদের ঘরে ফেরাই,পানি খাওয়াই, সবশেষে ঘুমুতে দেই। মা প্রতিদিন সকালে তাদের বিছানা পরিষ্কার করেন। আর সারাদিনে যা নোংড়া করে তা আমি পরিষ্কার করে দেই। এভাবেই কাটছিল তাদের দিনগুলি। একদিন হঠাৎ একটা ছানা সিঁড়ির ফাঁক গলে দোতলা থেকে একদম নিচতলায় পরে গেল। পা গেল ভেঙে। আরতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, হাঁটতে পারেনা। কী কষ্ট, তার যতটা কষ্ট, আমাদের আরো বেশি কষ্ট তার এ করুন পরিনতি দেখে। তাকে খাওয়ানোর কিছুটা চেষ্টা করলাম। খেতে চায়না, ব্যাথায় মুশড়ে থাকে। তাদের পাঁচজনের মাঝে একটি ছানা ছিল আকারে বড়,তার নাম দিলাম প্রিন্স। সে দেখি ঐ আহত ছানাটার পায়ের ওপর উঠে দাঁড়ায়, আহত ছানাটা কুঁকড়ে ওঠে। প্রথমে ভাবলাম এতে আহত ছানাটার আরো ক্ষতি হচ্ছে, তাই তাকে আলাদা রাখতে চাইলাম। কিন্তু সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার বাকিদের কাছেই চলে গেল,একা থাকতে চাইল না। অগত্যা একসাথেই রাখলাম। তারপর একবার খেয়াল করে দেখি আহত ছানাটার পায়ে দাঁড়ানোর ফলে সে উঠে দাঁড়াতে পারছে। তার মানে এটা প্রিন্স তার চিকিৎসার জন্যই করেছে। যাক বাবা, তবু ছানাটা সেরে তো উঠল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এভাবেই কাটছিল তাদের শৈশব, ধীরে ধীরে তারা বেড়ে উঠতে লাগল। তাদের পরিচর্যা চলতে লাগল। দোতলা থেকে এখন তাদের নিচে নামানো হয়, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়।যেখানেই যায়, দল বেঁধে যায়। মাঝে মাঝে একটু অসুখ হয়,আবার সেরেও যায়।আমি তাদের কাছে প্রায়ই যাই, তাদের দেখাশোনা করি,সেই সুবাদে তারা আমাকে ভালই চেনে।আমাকে দেখলে ছুটে পালায় না,বরং কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।আমি মাঝে মাঝে কোলে নেই, আদর করি, এটা সেটা খেতে দেই।তারপর আবার দলের মাঝে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।চারপাশের লোকজন আমাকে দেখে হাসে আর ভাবে “মুরগী নিয়ে কত আদিক্ষেতা,পাগল নাকি?” সাবার কাছে ব্যপারটা হাস্যকর আর আজব মনে হলেও আমার কাছে এতটুকুও বিব্রত লাগে নি। সবাই হাঁ হয়ে দেখলেও আমি তাতে এতটুকু বিচলিত হইনি। তাদের কোলে নেয়া আদর করা,তাদের সাথে কথা বলা,সব করেছি মনের গভীর থেকে।এরা যে অবুঝ প্রানি তা আমার মোটেও মনে হয়নি।বরং মনে হত এরা আরো ভাল বোঝে, আরো বেশি ভালবাসতে জানে।
.

ওদের সোনালী শৈশব
ওদের সোনালী শৈশব

ওদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী হল প্রিন্স, সেই বেশি কাছে আসত।একদিন হঠাৎ বিকেল বেলা তারা চারজনে ফিরল, একজন নিখোঁজ। কত খুঁজলাম ছানাটি কোথাও নেই।তখন তাদের বয়স দেড় থেকে দুমাস। রঙিন পালক ঢেকে গিয়ে ধীরে ধীরে সাদা পালক বের হচ্ছে মাত্র।তখন একজনকে কে নিয়ে গেল,কে উদরপূর্তি করল, বলতে পারলাম না। কি আর করা, চারজনকে নিয়েই তুষ্ট থাকলাম। পরদিন সকালে দেখি প্রখর রোদ, সে বছরের সেরা রোদ। এদেরকে নিচে নামালে চুরি হয়ে যায়,তাই দেখে তাদের ছাদেই রেখে দেয়া হল। ছাদে কটা টব আছে, তার নিচে ছায়ায় বসে থাকবে। কিন্তু যে রোদে আমরাই এক মিনিট দাঁড়াতে পারিনা, সেখানে তারা কি করে টিকবে? তবে তাদের যে সারাদিনে ছাদ থেকে নামাতে কারোরি মনে পড়বে না,তাতো ভাবিনি। বাসায় ফিরেই আমি প্রথম তাদের খোঁজ করি। আমার মা বলেন, ছাদের দরজা খুলতেই তারা দৌড়ে এসে সিঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।তখন প্রায় বিকেল।তাদের দেখতে মলিন লাগছিল। তাদের লেজ অনেকটা রোদের তাপে নষ্ট হয়ে গেছিল। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল,কদিন ঠিকমত খেতেই পারেনি। মনে মনে খুব দুঃখবোধ করলাম ওদের এ করুন অবস্হা দেখে। তার ওপর তাদের পানি খাওয়াতেও ভুলে গেলাম সেদিন। অতপর ফলশ্রুতিতে আরেকটা ছানা বিদায় নিল। এতে খুব কষ্ট পেলাম আর ছানাদের যত্নে আরো মনযোগী হলাম। এভাবেই ধীরে ধীরে তারা বাড়তে লাগল ঠিক যেন আমার পরিবারের কটা সদস্য…..

(চলবে)


 

৫৮৭জন ৫৮৭জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ