ঋতু পরিবর্তনের সময়গুলোতে এই শহরে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কেউ এলার্জি জনিত, কেউবা ঠাণ্ডাজনিত, নয়তো শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগে। আমার ছোট বাপজান রিহানও তেমনি অসুস্থ হয় গত সপ্তাহে। কাশি বেড়ে শেষরাতের দিকে শ্বাসকষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত যতো রাতই হোক না কেন, হাসপাতালে ছুটে যাই। জরুরি চিকিৎসা শেষে সুস্থ হলেই ফিরে আসি। সন্তানের অসুস্থতায় কখনো কখনো মায়েরা দিশেহারা হয়ে উঠেন কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে ভুল করেন, আমারও তা-ই হয়েছে এবার।
সকালের দিকে রিহানের শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো যখন, আমি ছুটলাম ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু কয়েকটি দিন কাছের অফিসে বসলেও সেদিন ডাক্তার বসেছেন দূরের অফিসে, যেখানে আগে একাকি যাওয়া হয়নি আমার। গাড়িতে জিপিএস সেট করে ছুটলাম। যেতে হবে যতো দ্রুত সম্ভব। এদিকে জিপিএস দেখাচ্ছে অমুক রাস্তায় কন্সট্রাকশন, তমুক রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, ঘুরে যেতে হবে অন্য রাস্তা হয়ে। তবুও শেষ অবধি পৌঁছালাম যখন, ততোক্ষণে রিহানের শ্বাস ভারী হয়ে আসছিলো। হন্যে হয়ে পার্কিং খুঁজছি আর পিছনের সিটে বসা রিহানকে লুকিং গ্লাসে খেয়াল রাখছিলাম। ছয় বছর বয়সের ছোট্ট মানুষটি কি অসীম ধৈর্যে কষ্ট চেপে নিচু স্বরে কাঁদছে আর টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে ! আমি সান্ত্বনা দেই। বলি, রিহান, এইতো চলে এসেছি আমরা, ডাক্তার ওষুধ দিলেই তুমি ভালো হয়ে যাবা। তিরিশ মিনিট পর গাড়িটি পার্ক করে তাঁকে নামাতে গিয়ে দেখি সে আর দাঁড়াতে পারছে না। কোলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যাচ্ছি। একটি মাত্র স্ট্রীট ! যেন মাইলের পর মাইল দৌড়াচ্ছি। দীর্ঘতম এক পথ ! অসুস্থ সন্তান কোলে এক মায়ের কি ভীষণ অসহায় ছুটে চলা ! চেম্বারে ঢুকতেই ডাক্তার হার্টবিট, প্রেসার, শরীরে অক্সিজেনের পরিমাপ দেখতে দেখতে ৯১১ কল করছে। এদেশে ৯১১ ইমারজেন্সী নাম্বার। নাম্বারটিতে ফোন করলে মুহূর্তেই এ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। সেটিতে টুকটাক প্রাথমিক চিকিৎসার সারঞ্জামাদি থাকে। নাকে অক্সিজেন দিতে দিতে এ্যাম্বুলেন্সেই হাসপাতালে পৌঁছালাম। মুহূর্তেই ডাক্তার, নার্স সকলের ছুটাছুটি, রিহানের মুখে নেবুলাইজার মাস্ক, নাকে অক্সিজেন সহ পুরো শরীর ছেয়ে গেলো নানান রকম নল আর তারে।আমি হেল্থ ইনস্যুরেন্স সংক্রান্ত তথ্য সহ, অন্যান্য কাগজপত্রে সাইন শেষে রিহানের পাশে এসে দাঁড়াই। দেখি, ভীষণ ক্লান্ত শ্রান্ত ছোট্ট মানুষটি কি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
রিহানকে কেবিনে দেয়া হোল। রুম নাম্বার ৪১২৭। দরজায় ঢুকতেই দৃষ্টি আটকে থাকে ডানপাশে দেয়ালে ছোট্ট হাতে আঁকা একটি বাঁধাই করে টানানো ছবিতে। বিগত দিনে এই রুমে সেবা নেওয়া রিহানের মতোই ছোট্ট কোন এক রোগী যাবার সময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখে রেখে গেছে__ Thank you for everything that you have done for me, I really aprishiate it. I’ll never forget you. love. Tonny … চমৎকার মন ভালো করা লেখা। সমস্ত রাত্রি নির্ঘুম বসে স্যালাইনের টুপটুপ ফোটাগুলোর গড়িয়ে যাওয়া দেখলাম। মনিটরের সবুজ, গোলাপি আর সাদা বক্ররেখার উঠানামার দিকে চেয়ে থাকলাম।চেয়ে থাকলাম রিহানের বুকের পাঁজরের অস্বাভাবিক ওঠানামার দিকে।
এদেশে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি হাসপাতালগুলো রোগীকে এক রকম আটকে রাখে, বলা চলে।
আমরাও আটকে থাকলাম। দু’দিন পর বাইরের পৃথিবীতে, পৃথিবীর আলো-বাতাসে এসে দাঁড়াই। বুকভরে শ্বাস নেই। জীবন সুন্দর। তারচেয়েও সুন্দর এই দেশ। এখানে ফার্মেসী থেকে ওষুধ না এনে দেয়া অবধি চিকিৎসা বন্ধ থাকে না, কিংবা টাকার জন্যেও চিকিৎসা বন্ধ থাকে না। আগে সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসাটুকু হবে। বিল পরিশোধের সামর্থ্য যার আছে, সে দিবে। যার নেই, সে দেবার প্রয়োজন নেই। এখানে মধ্যরাতে একজন নারী একাকী হাসপাতালের দিকে ছুটে যেতে পারে নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে। এখানে রাত গভীরে হাসপাতালগুলোয় নার্সরা টেবিলে মাথা নুইয়ে ঘুমিয়ে থাকে না। দিনে রাতে ডাক্তার, নার্স সকলেই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠার সাথে। এতোসব সুন্দর আর ভালোথাকার মাঝেও বুকের গহিন কোন থেকে অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে__ আমার দেশের মানুষগুলো যদি এমন সুযোগ সুবিধাগুলো পেতো !
সেটি আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা দেশ বলেই কি ?
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৩টি মন্তব্য
ইঞ্জা
কুলাঙ্গার, দুর্বৃত্তায়নের দেশে আমরা আজ বন্ধী, কিছুই পাওয়ার নেই এই দেশ থেকে।
ছেলের জন্য দোয়া রইল।
রিমি রুম্মান
তবুও সেই দেশটার জন্যই মন কাঁদে, যেখানেই যতো ভালোই থাকি না কেন।
ইঞ্জা
স্বাভাবিক, দেশ মাতৃকা বলে কথা, যে মাঠিতে বেড়ে উঠেছেন তাকে ভুলেন কি করে। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বেড়ে উঠা দেশ বলেই এমন মোচড় দিয়ে ওঠে দেশের মানুষের কথা ভেবে।
কোনকালে এমন হতে পারে সে স্বপ্নও দেখার কল্পনা করতে পারি না মানুষের নৈতিক অবক্ষয় দেখে।
তবুও যে দেশকে ভালোবাসি আমি, আপনি, আমরা। (3
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। তবুও কেন যেন মনে হয় একদিন অনেকটাই এগিয়ে যাবে দেশ।
ভাল থাকুন আপু। -{@
অরুনি মায়া অনু
কিছুদিন আগেও আমার এক খুলনার আত্মীয়কে স্ট্রোক করার পরেও হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রাখা হত তিন দিন বিনা চিকিৎসায়। অথচ সেখানে ডাঃ নার্স সবই ছিল। আমরা গিয়ে তাকে ঢাকা এনে চিকিৎসা শুরু করলাম। আমাদের খবর পেতে ও সেখানে পৌঁছানো আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কি কোনই দায়িত্ব ছিলনা! এই হল অবস্থা আমাদের দেশের। বাইরের দেশেগুলোর অধিকাংশেই চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব উন্নত।
রেহান বাবুটা এখন কেমন আছে আপু?
রিমি রুম্মান
আমার বাবাকে নাকে নল দিয়ে তরল খাবার দিয়েছিল। খাবার নাক দিয়ে না গিয়ে গিয়েছে শ্বাসনালী দিয়ে, নার্সদের সেইদিকে খেয়াল নেই। বাবা হাত পা ছুঁড়ে বুঝাতে চেয়েছেন। কেউ বুঝতে চায়নি সেই ভাষা। বরং সকলে মিলে হাত পা চেপে ধরে রেখেছিল। অতঃপর যন্ত্রণাকাতর বাবা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এলো। নার্সরা নিজ রুমে গিয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। আমার মা বসে থাকলো পাশে, বাবা ঘুমাচ্ছেন ভেবে। আচমকা শ্বাস ভারী হয়ে এলো বাবার। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছিলেন। মা ছুটে গেলেন নার্সদের রুমে, অক্সিজেন দিতে বললেন। ঘুমঘুম চোখে বিরক্তি নিয়ে নার্স এলো অনেক পরে। ততোক্ষণে বাবা আমার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
এমন কত শত ভুলভ্রান্তির মাঝে কতো রোগী মারা যায়, সে খবর কেউ রাখে না।
শুধু যার যায়, সেই জানে তাঁর কি অপূরণীয় ক্ষতি করে সেইসব হাসপাতালগুলো।
শুন্য শুন্যালয়
আমাদের দ্বিতীয় রিহান এখন কেমন আছে আপু? এমন চমৎকার একজন নির্ভরযোগ্য মা যার আছে সে সবসময় ভালো থাকবে।
ওখানকার কথা বলতে পারবো না, এখানকার এমার্জেন্সি আউটডোরে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়, প্রাথমিক এমার্জেন্সি গুলো নার্সরা নির্ধারণ করেন এরকম দু একটা ব্যাপার ভালো লাগেনি এছাড়া আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। ছেলেটাকে দুমাস আগে নিউমোনিয়া র জন্য ভর্তি করলাম, হসপিটালের পরিবেশ, নার্স ডাক্তারদের যত্ন এসব দেখে আমারও খুব খুব মন খারাপ হয়েছে। এতো বিশাল একটা শিশুওয়ার্ডে আমার ছেলেসহ মাত্র দুজন ভর্তি। বাকি সব বিছানা গুলো পড়ে আছে। অথচ আমাদের দেশে …..
রিমি রুম্মান
এখানে এ্যাম্বুলেন্স কল করে যারা এমার্জেন্সিতে যায়, তাঁদের সাথে সাথেই চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। আর যারা নিজেই হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিভাগে যায়, তাঁদের চিকিৎসা রোগের ধরন বুঝে আগে পরে চিকিৎসা শুরু হয়। তবে খুব একটা সময় অপেক্ষা করতে হয় না।
নীরা সাদীয়া
যেন একদিন আমার সোনার বাংলাও একই রঙে ও রূপে, সুযোগ ও সুবিধায় ভরে ওঠে। এই প্রত্যাশা।
রিমি রুম্মান
আমি জানি, একদিন আমার দেশেও এমনটি হবে। কেননা, দেশ আগের চেয়ে এগিয়েছে অনেকদূর।
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন। শুভকামনা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আফসোস শুধুই আফসোস….রিহান ভালো থাকুক এই কামনা -{@
রিমি রুম্মান
সকলের দোয়া’য় রিহান সুস্থ হয়ে উঠেছে।
ভাল থাকুন। শুভকামনা।
ব্লগার সজীব
রিহানের রোগ মুক্ত সুস্থ জীবন কামনা করছি। এত মায়া থাকে আপনার লেখায় মনেই হয়না পড়ছি কিছু। যেন দেখছি সব কিছু। তুলনায় আমাদের প্রিয় দেশটি পিছিয়েই থাকবে। কেবল মাত্র অনিয়ম, অব্যবস্থায় এগিয়ে থাকবে। আপনার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।
রিমি রুম্মান
বিদেশের মাটিতে ভাল কিছু দেখলে কেবলই দেশের কথা মনে পড়ে। মনে হয়, ইশ্ , আমার দেশটিও যদি এমন হতো ! অনেকটা এমন__ একজন মা কোথাও বেড়াতে গেলে যদি ভাল কিছু খেতে পায়, তখন তাঁর কেবলই সন্তানের কথা মনে পড়ে। ভাবে, ইশ্ , আমার সন্তানকে যদি এই খাবারটি খাওয়াতে পারতাম !
আবু খায়ের আনিছ
আমি বেশি কিছু জানিনা, তবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট সহ উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসা সেবা পেতে বেশ বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়। ইনসুরেন্স থেকে শুরু করে ডাক্তার অ্যাপোয়েন্টমেন্ট পেতেও নাকি বেশ সময় লেগে যায়। যদিও এটা আমার শিক্ষক মহোদয় এর মুখে শুনা কথা।
রিহান সুস্থ আছে শুনে ভালো লাগছে।
রিমি রুম্মান
আমি এবং আমার পরিচিতজনেরা এমন বিড়ম্বনার শিকার হতে শুনিনি এখনো। এমনটি দেখলে লিখবো তা নিয়ে।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিহান বাবু কেমন আছে এখন আপু? তুমি অনেক দায়িত্ত্বশীল ও স্নেহপ্রবণ একজন মা, তাই জানি রিহান বাবু সুস্থ হয়ে উঠবেই।
দেশের চিকিৎসার কথা বলতে চাইনা, ভাবতেও চাইনা।
রিমি আপু আমাদের জন্মের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আগেও যেমন ছিলো, এখনও তেমনই আছে। থাকবেও।
ভালো থেকো আপু। -{@
রিমি রুম্মান
তবুও আমার মনে হচ্ছে আমাদের দেশ একদিন এমন হবে। আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে দেশ।
ভাল থেকো, নিরাপদ থেকো।
ছাইরাছ হেলাল
শুধুই রিহানের রোগ মুক্তি কামনা করছি,
এখানের কথা এই মুহূর্তে মনে করতে চাই না।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সকলে দেশে, বিদেশে… এই কামনা।
জিসান শা ইকরাম
একমাত্র আমাদের দেশেই চিকিৎসা সেবাটি ভিন্ন অন্য দেশের তুলনায়,
রিহান অবশ্যই ভাল থাকবে, এমন মা পেয়েছে সে ভাল না থেকে পারবেই না।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
রিহান ভাল আছে, দাদাভাই।