এক শীতের শনিবার রাতে

রিমি রুম্মান ৬ নভেম্বর ২০১৬, রবিবার, ১২:০৬:০৬অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২১ মন্তব্য

এক শীতের শনিবার রাত।

ব্রুকলিনে এক আত্মীয়ের বাসায় নিমন্ত্রণে যাচ্ছি আমরা স্বামী-স্ত্রী। পথিমধ্যে গ্যাস স্টেশনে থেমে গাড়িতে গ্যাস নেয়া হলো। সংলগ্ন দোকানটিতে কিছু জরুরী জিনিষ কিনতে গেলো হাসব্যান্ড। আমি গাড়িতে অপেক্ষায়। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁর ফিরবার নাম নেই। এদিকে ফোনও গাড়িতে রেখে গিয়েছে। ঘড়িতে রাত বাড়ে। চরম বিরক্তি নিয়ে নেমে এদিক সেদিক খুঁজি। বিশাল গ্যাস স্টেশনের অনেক গাড়ির ভিড়ে দেখতে পাই একটি গাড়ির সামনের হুড খুলে ইঞ্জিন নিয়ে কিছু করছেন। অতঃপর একসময় তিনি এলেন। জানালেন মহিলা লং আইল্যান্ড থেকে এসেছেন। ষাটোর্ধ বয়স। গাড়িটি হঠাৎ নষ্ট হয়েছে। অনেককেই অনুরোধ করছে। কেউ সহযোগিতা করছে না। তাই তিনি গাড়িটি সচল করতে লেগে গেলেন। গাড়ি ঠিক্‌ঠাক হবার পর ভদ্রমহিলাকে বিদেয় করে তবেই ফিরেছেন। আর এদিকে সময় যে কতোটা গড়িয়ে গেছে, ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর।

অবশেষে আমরা পার্টিতে যাচ্ছি।

ভেতরে প্রচণ্ড দুঃখে, বিরক্তিতে মনের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিয়ে একচোট্‌ নিচ্ছিলাম। আমি বলি, ” একটা ছুটির দিন, সাজগোজ করে ফুর্‌ফুরে মনে বেড়িয়েছি, আজ এমনটি না করলেই কি হতো না !” এবার মুখ খোলেন তিনি। বলেন, ” ধরো, পথে ঘাটে কোনদিন তুমি যদি এমন বিপদের মুখোমুখি হও, কেউ এগিয়ে না আসে, কেমন অসহায় লাগবে তোমার ?” এতে আমার আরো রাগ ধরে। বলি, “এতো মানুষের মধ্য থেকে তোমাকেই এগিয়ে যেতে হবে ? অন্যসময় হলে ভিন্ন কথা ছিল।” শেষে তিনি আমায় বললেন, ” আমি যদি কারো বিপদে এগিয়ে যাই, সেই পুণ্যে একদিন আমার স্ত্রী-সন্তানের বিপদেও কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে”।

যাক্‌ এতোসব ঝক্কি পেরিয়ে যখন আমরা পার্টিতে পৌঁছাই, ততক্ষণে অতিথিরা একে একে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অল্পক্ষণ থাকা এবং খাওয়া শেষে আমরা বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। আর বাড়ি ফিরবার পথটুকুতে পুরোটা সময় সে চুপটি করে অপরাধী হয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছিলো। এসব সাত বছর আগের কথা।

……

আজ ছেলেকে নিয়ে কোচিং থেকে ফিরছিলাম।

রেড লাইটে অপেক্ষার সময়ে আচ্‌মকা গাড়ি থেমে যায়। দিশেহারা আমি এদিকে, ওদিকে, গ্যারেজে ফোন করছি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় গ্যারেজে কর্মরত সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। কেউ আসতে রাজি নয়। এদিকে ব্যস্ত রাস্তা। অন্য গাড়িগুলো কায়দা করে পাশদিয়ে একে একে চলে যায়। মাঝরাস্তায় থেমে আছি বলে কেউ কেউ বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। কারো বিরক্তি ভরা দৃষ্টির সাথে ঠোঁট নড়ছে অনবরত। আমি নিশ্চিত, তাঁরা সকলেই হালকা জ্যাম লাগিয়ে দেয়ার অপরাধে বিড়বিড় করে আমায় একচোট্‌ বকে নিচ্ছেন। সৌভাগ্যবশত ঠাণ্ডার কারনে সকলেরই জানালার কাঁচ বন্ধ থাকায় আমি সেইসব বকা শুনতে পাইনি। তারপরও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা কিছু মানুষ থাকেন পৃথিবীতে। প্রথমে দু’জন স্প্যানিশ যুবক এগিয়ে এলেন। তাঁরা কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন গাড়িটি সচল করতে। হয়নি। যাবার সময় বলে গেলেন, ব্যাটারিতে সমস্যা। একজন নারীকে নষ্ট গাড়ি নিয়ে রাস্তার মাঝখানে এমন অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবার গাড়ি থামালেন এক চায়নিজ। বয়স সত্তরের আশেপাশে হবে। তিনিও কিছুক্ষন দেখলেন, চেষ্টা করলেন। বললেন কম্প্রেসর এর সমস্যা। সবশেষে এক জাপানিজ যুবক তাঁর জিপটি রাস্তার একপাশে পার্ক করে নেমে এলেন। সামনের হুড খুলে ইঞ্জিনের এটা সেটা দেখলেন। নিজের গাড়ি থেকে টুকটাক কিছু যন্ত্রপাতি এনে চেষ্টা করছেন। ওমনি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডেকে উঠলেন এক রমণী__ মাসাহিকো, মাসাহিকো বলে। মাসাহিকো’র চেষ্টাও বৃথা গেল। সে ফিরে গেলো। ভাবছি, রমণী কি মাসাহিকো’কে একচোট্‌ বকাঝকা করবেন ছুটির দিনে বেহুদা সময় নষ্ট করার জন্য ? সেও কি অপরাধী হয়ে চুপটি করে ড্রাইভ করে যাবে ?

এতোসব ভাবনার মাঝে হাসব্যান্ড এসে হাজির।

গ্যারেজের লোকও এলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস গায়ে মেখে তিন ঘণ্টা পর যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছি, ততোক্ষণে বাইরে সন্ধ্যার আঁধার। কামাল ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে আমি। নিয়ন বাতির কমলা আলোয় শতশত গাড়ি ছুটে চলছে। আজও শীতের শনিবার রাত।  সাত বছর আগেকার সেই ঘটনাটি কেন জানি খুব মনে পরছে। কি ভীষণ বিরক্তই না হয়েছিলাম মানুষটির উপর। রাগে ক্ষোভে কত কি-ই না বলেছিলাম। কানে বাজছে সেদিনের সেই কথাগুলো__ ” আমি যদি কারো বিপদে এগিয়ে যাই, সেই পুণ্যে একদিন আমার স্ত্রী সন্তানের বিপদেও কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে “।

বাড়ি ফিরবার পথটুকুতে পুরোটা সময় আমি একজন অপরাধী হয়ে বিষণ্ণ মনে চুপটি করে বসে থাকলাম।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

৪৭৪জন ৪৭৪জন

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ