এক শীতের শনিবার রাত।
ব্রুকলিনে এক আত্মীয়ের বাসায় নিমন্ত্রণে যাচ্ছি আমরা স্বামী-স্ত্রী। পথিমধ্যে গ্যাস স্টেশনে থেমে গাড়িতে গ্যাস নেয়া হলো। সংলগ্ন দোকানটিতে কিছু জরুরী জিনিষ কিনতে গেলো হাসব্যান্ড। আমি গাড়িতে অপেক্ষায়। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁর ফিরবার নাম নেই। এদিকে ফোনও গাড়িতে রেখে গিয়েছে। ঘড়িতে রাত বাড়ে। চরম বিরক্তি নিয়ে নেমে এদিক সেদিক খুঁজি। বিশাল গ্যাস স্টেশনের অনেক গাড়ির ভিড়ে দেখতে পাই একটি গাড়ির সামনের হুড খুলে ইঞ্জিন নিয়ে কিছু করছেন। অতঃপর একসময় তিনি এলেন। জানালেন মহিলা লং আইল্যান্ড থেকে এসেছেন। ষাটোর্ধ বয়স। গাড়িটি হঠাৎ নষ্ট হয়েছে। অনেককেই অনুরোধ করছে। কেউ সহযোগিতা করছে না। তাই তিনি গাড়িটি সচল করতে লেগে গেলেন। গাড়ি ঠিক্ঠাক হবার পর ভদ্রমহিলাকে বিদেয় করে তবেই ফিরেছেন। আর এদিকে সময় যে কতোটা গড়িয়ে গেছে, ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর।
অবশেষে আমরা পার্টিতে যাচ্ছি।
ভেতরে প্রচণ্ড দুঃখে, বিরক্তিতে মনের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিয়ে একচোট্ নিচ্ছিলাম। আমি বলি, ” একটা ছুটির দিন, সাজগোজ করে ফুর্ফুরে মনে বেড়িয়েছি, আজ এমনটি না করলেই কি হতো না !” এবার মুখ খোলেন তিনি। বলেন, ” ধরো, পথে ঘাটে কোনদিন তুমি যদি এমন বিপদের মুখোমুখি হও, কেউ এগিয়ে না আসে, কেমন অসহায় লাগবে তোমার ?” এতে আমার আরো রাগ ধরে। বলি, “এতো মানুষের মধ্য থেকে তোমাকেই এগিয়ে যেতে হবে ? অন্যসময় হলে ভিন্ন কথা ছিল।” শেষে তিনি আমায় বললেন, ” আমি যদি কারো বিপদে এগিয়ে যাই, সেই পুণ্যে একদিন আমার স্ত্রী-সন্তানের বিপদেও কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে”।
যাক্ এতোসব ঝক্কি পেরিয়ে যখন আমরা পার্টিতে পৌঁছাই, ততক্ষণে অতিথিরা একে একে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অল্পক্ষণ থাকা এবং খাওয়া শেষে আমরা বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। আর বাড়ি ফিরবার পথটুকুতে পুরোটা সময় সে চুপটি করে অপরাধী হয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছিলো। এসব সাত বছর আগের কথা।
……
আজ ছেলেকে নিয়ে কোচিং থেকে ফিরছিলাম।
রেড লাইটে অপেক্ষার সময়ে আচ্মকা গাড়ি থেমে যায়। দিশেহারা আমি এদিকে, ওদিকে, গ্যারেজে ফোন করছি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় গ্যারেজে কর্মরত সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। কেউ আসতে রাজি নয়। এদিকে ব্যস্ত রাস্তা। অন্য গাড়িগুলো কায়দা করে পাশদিয়ে একে একে চলে যায়। মাঝরাস্তায় থেমে আছি বলে কেউ কেউ বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। কারো বিরক্তি ভরা দৃষ্টির সাথে ঠোঁট নড়ছে অনবরত। আমি নিশ্চিত, তাঁরা সকলেই হালকা জ্যাম লাগিয়ে দেয়ার অপরাধে বিড়বিড় করে আমায় একচোট্ বকে নিচ্ছেন। সৌভাগ্যবশত ঠাণ্ডার কারনে সকলেরই জানালার কাঁচ বন্ধ থাকায় আমি সেইসব বকা শুনতে পাইনি। তারপরও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা কিছু মানুষ থাকেন পৃথিবীতে। প্রথমে দু’জন স্প্যানিশ যুবক এগিয়ে এলেন। তাঁরা কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন গাড়িটি সচল করতে। হয়নি। যাবার সময় বলে গেলেন, ব্যাটারিতে সমস্যা। একজন নারীকে নষ্ট গাড়ি নিয়ে রাস্তার মাঝখানে এমন অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবার গাড়ি থামালেন এক চায়নিজ। বয়স সত্তরের আশেপাশে হবে। তিনিও কিছুক্ষন দেখলেন, চেষ্টা করলেন। বললেন কম্প্রেসর এর সমস্যা। সবশেষে এক জাপানিজ যুবক তাঁর জিপটি রাস্তার একপাশে পার্ক করে নেমে এলেন। সামনের হুড খুলে ইঞ্জিনের এটা সেটা দেখলেন। নিজের গাড়ি থেকে টুকটাক কিছু যন্ত্রপাতি এনে চেষ্টা করছেন। ওমনি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডেকে উঠলেন এক রমণী__ মাসাহিকো, মাসাহিকো বলে। মাসাহিকো’র চেষ্টাও বৃথা গেল। সে ফিরে গেলো। ভাবছি, রমণী কি মাসাহিকো’কে একচোট্ বকাঝকা করবেন ছুটির দিনে বেহুদা সময় নষ্ট করার জন্য ? সেও কি অপরাধী হয়ে চুপটি করে ড্রাইভ করে যাবে ?
এতোসব ভাবনার মাঝে হাসব্যান্ড এসে হাজির।
গ্যারেজের লোকও এলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস গায়ে মেখে তিন ঘণ্টা পর যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছি, ততোক্ষণে বাইরে সন্ধ্যার আঁধার। কামাল ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে আমি। নিয়ন বাতির কমলা আলোয় শতশত গাড়ি ছুটে চলছে। আজও শীতের শনিবার রাত। সাত বছর আগেকার সেই ঘটনাটি কেন জানি খুব মনে পরছে। কি ভীষণ বিরক্তই না হয়েছিলাম মানুষটির উপর। রাগে ক্ষোভে কত কি-ই না বলেছিলাম। কানে বাজছে সেদিনের সেই কথাগুলো__ ” আমি যদি কারো বিপদে এগিয়ে যাই, সেই পুণ্যে একদিন আমার স্ত্রী সন্তানের বিপদেও কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে “।
বাড়ি ফিরবার পথটুকুতে পুরোটা সময় আমি একজন অপরাধী হয়ে বিষণ্ণ মনে চুপটি করে বসে থাকলাম।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২১টি মন্তব্য
ইঞ্জা
মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে না আসলে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে আর আমি চেষ্টা করি হঠাত বিপদে পড়া কারো কাজে লাগা।
রিমি রুম্মান
আমরা যখন সাপ্তাহিক ছুটির একটি দিন মনের আনন্দে কোন পার্টিতে যাবার পরিকল্পনা করি, তখন আসলেই এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাই বেশীরভাগ মানুষ। এরমাঝেও কেউ কেউ ব্যতিক্রম আছেন।
ইঞ্জা
(y) -{@
ছাইরাছ হেলাল
ত্যাগ স্বীকার আমাদের করতেই হয়,
রিমি রুম্মান
আমাদের ভুলগুলো কখনো না কখনো আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। অপরাধী মনে হয় তখন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মানুষ মানুষের জন্য
-{@ উপলব্দি করা জীবনকে রঙ্গীন করে।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন, অল্প কথায়।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আমি কারো উপকার করার সময় ভাবি হয়তো আমার স্ত্রী-সন্তানের বিপদের সময় কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।
রিমি রুম্মান
বিপদগ্রস্ত মানুষটির অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভাবলেই আমাদের উপলব্দিতুকু, বোধটুকু আসে।
অরুনি মায়া অনু
উপকারের প্রতিদান আল্লাহ্ উপকারের মাধ্যমেও দিয়ে থাকেন। আপনার হাজবেন্ড একজন পরোপকারী ব্যক্তি। আল্লাহ্ উনার ভাল করুন।
রিমি রুম্মান
আমীন…
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি “কর্মা” এই শব্দটিকে খুব বিশ্বাস করি। স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস নেই।
ভাই অনেক বড়ো মনের মানুষ। এভাবে উপকার সবাই করতে পারেনা রিমি আপু।
তুমি অনেক ভালো একজন সঙ্গী তোমার জীবনের পাশে পেয়েছো।
ভালো থেকো।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছ নীলা’দি।
তবুও আমরা সময়ে অনেককিছুই বুঝতে চাই না।
বুঝি অনেক দেরী করে। ভাল থেকো।
নীলাঞ্জনা নীলা
তুমিও ভালো থেকো।
মোঃ মজিবর রহমান
আপু আপনি যদি কারও সন্মান, মান, জীবন রক্ষা করেন আল্লাহ অন্য কারও মাধ্যমে আপনার প্রয়জনে আপনার ন্মান, মান, জীবন রক্ষা করবেন।
রিমি রুম্মান
এটি এখন আমিও বিশ্বাস করি।
মোঃ মজিবর রহমান
(y)
নাসির সারওয়ার
সবাই উপকার করতে আসে না, পারেনা। একজনের জন্য কিছু করতে পারলে যে মনের সুখ অনুভব হয়, তার স্বাদ আমরা অনেকেই পাইনা। কামাল সাহেব সেই স্বাদ বা তৃপ্তি পান। এবং আমার মনে হয় উনি ফেরত পাবেন এই আশাটা করে ওসব করেননা।
রিমি রুম্মান
উপকার করার সময় সবাই নিঃস্বার্থ ভাবেই করে হয়তো।
তবে এটি একটি মনের সান্তনা এই যে, ” কখনো না কখনো আমাদের বিপদেও কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।”
ব্লগার সজীব
কি লিখবো মন্তব্যে বুঝে উঠতে পারছি না। লেখাটি এমন ভাবে নাড়া দিল আমাকে যে আজীবন বিপদে থাকা মানুষকে অবশ্যই সহযোগিতা করব।
আমি খুব কম লেখি। আমার লেখা রিমি রুম্মান আপু পড়লে আমার যে খুব ভাল লাগে, এটি কি আপুটা জানে? 🙁
রিমি রুম্মান
আমি সময় পেলেই সোনেলায় আসি। সেদিন চোখের সামনে যাঁদের লেখা পাই, পড়ি , মন্তব্য করি। কোনভাবে কি আপনার লেখা আমার নজর এড়িয়ে যায় ? মন্দ কপাল আমারও এই ভেবে।