জরির স্বামীর নাম সাহেব আলী। দিন মজুরী তার পেশা। যেদিন কাজ পায় সেদিন তো যার বাড়ীতে কাজ তার বাড়ীতেই খাওয়া । সন্ধ্যার সময় দুই সের চাল আর পঞ্চাশটা টাকা। উহ সেদিন তার ফুর্তি তে গলা দিয়ে গান বের হয়। বাসায় বউটা আর বাড়ীর সবাই কি খেল না খেল তা দেখার কি আছে! চালের সঙ্গে এক সের কাঁচামরিচ তো আনছে।
সস্তা দামের বিড়ি টানতে টানতে বাড়ী ফিরে বউটার উপর তার পৌরুষত্ব দেখিয়ে আরামে ঘুম । এই ঘুম ফজরের আজানের আগে আর ভাঙ্গে না।
বউটা নিজের ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে চাটাইএ পড়ে থাকে। পেটে অনন্ত ক্ষুধা, সারা শরীরে ব্যাথা দাঁড়াতে পারে না, পা দুটা কাঁপে, মাথা ঘুরে । শরীরের ক্ষুধা হয়তো কোন একদিন ছিল ,কিন্তু কোন দিন বুঝতেই পারে নাই এই ক্ষুধা কিভাবে মেটে। বিয়ের পর পর শুধু ক্ষুধার সাথে যন্ত্রনা বাড়ত। আর এখন শুধুই নিপীরন মনে হয়। প্রতিটি দিনের আসহনিয় নিপীরন, কাউকে না বলতে পারা নির্যাতন।
ঠোঁটের কোনে ঘা হয়েছে। হাতে পায়ে পানি আসছে মনে হয়। বুক ধরফর করে। একটু ঔষধ যদি পাইত তবে একটু আরাম হইত। নিজের মনেই হেসে উঠে জরি , ভাত নাই তার আবার ঔষধ। আর আমার শ্বশুর বাড়ীর চৌদ্দগুষ্টির কেউ কোন দিন বাচ্চা হবার জন্য ডাক্তার দেখাইছে নাকি। বাচ্চা হওয়া তো লজ্জার কথা । সেটা নিয়া আবার ডাক্তারের কাছে যাও লাজ শরম কিছু নাই। বেহায়া কোথাকার? গ্রামে আর থাকা লাগবেনা। মন্ডলের বাড়ীর বউরা পর্যন্ত ডাক্তার দেখায়না তার আবার আমি।
জরির পেটে এখন তার চার নাম্বার সন্তান। একদিন খুব সাহস করে সাহেব আলীকে বলেছে– ——–“আমি আর পারব না বাচ্চা নিতে। আমার শরীর আর চলে না। কত কিছু ব্যাবস্থা হইছে, ক্লিনিকগুলিতে গেলে তারা ব্যাবস্থা করে দেবে।”
সাহেব আলী খুব ক্ষেপে গিয়ে বলেছে ————তুই পারবিনা কেন রে ? আমার একটাও ব্যাটা নাই। তুই মেয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নিয়া বলছিস বাচ্চা পেটে নিবি না!!! কেন তুই কি বেশ্যাগিরি করবি? মেয়ে মানুষের কাজই হল একটা, সেটা হল বাচ্চা পেটে ধরা। হারামজাদী আমাকে ব্যাটা দে তার পর তোর কথা চিন্তা করা যাবে। তুই মরলে তো আমার হার জুড়ায়। আমি দশ হাজার টাকা ডিমান্ড নিয়া আর একটা বিয়া করতে পাড়ি।”
বিড়ি টানতে টানতে সাহেব আলীর ঠোঁট দুটো গায়ের চামরার মত কালো রঙ ধারন করেছে। সে বড় করে বিড়ির মুখে একটা টান দেয় তারপর জরির পেটের দিকে তাকিয়ে বলে, “এবার ও যদি তোর বেটি হয় , তা হইলে আমাকে অন্য চিন্তা করতে হবে।”
স্বামীর কথা শুনে জরির সারা গা যেন দপ করে জ্বলে উঠে। মানুষটার মুখে এমন কথা জরির বড় অসহ্য। ইচ্ছে করে বুড়া ঝাঁটাটা বান্দরটার কালা মুখের উপর ভাঙ্গে। জরি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে রাগটা সামলিয়ে নিয়ে বলে “তোমার যদি এতই ব্যাটার সখ তো আল্লাকে বলতে পার না । ব্যাটা বানানোর কাজ কি খালি আমার?”
বউ এর প্রশ্নের কোন সদুত্তর খুঁজে পায় না সাহেব আলী। সে অকারনে পিঠটা চুলকায় হাত দিয়ে। তারপর বিড়ি টানতে টানতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
দিন যতই যাচ্ছে সন্তান ভারে ক্লান্ত জরির দেহমন ততই দূর্বল হয়ে পড়ছে। খালি ভয় হয় এবার ও যদি মেয়ে হয়, তাহোলে? এর উত্তর যানে না সে। মেয়ের জন্যই যদি তার ঘর ভাঙ্গে তবে পুরুষ গুলো এত বউ বউ করে কেন? মেয়ে জন্ম না হলে বউ আসবে কত্থেকে? পৌরুষগিরি দেখাবে কাকে।
সেদিন আষাড় মাসের সন্ধ্যা । ঝম ঝম করে বৃষ্টি পরছে। সারাদিন বৃষ্টি। বাড়িতে জরি একা। ওর শ্বাশুড়ী জরির বড় মেয়ে দুইটাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে তার মেয়ের বাড়ীতে । রাতে থাকতেও পারে। ছোটটা এখন ও মায়ের শুকনা দুধ চুষে চুষে ঘুমায়। তাই আছে জরির কাছে।
এখন চুলায় চাল চড়ানোর সময়। জরি পিছনের মন্ডলের বাড়ীর বাইরের নলকূপে যায় পানি আনতে। মাটির রাস্তা বৃষ্টিতে খুব পিছলা হয়েছে। পা টিপে টিপে হাঁটছে জরি। ভিখারী বুড়ি কালার মা জরির পিছ ধরে । একমুঠ খুদ ও যদি পায়। তার উপর আজ যে বৃষ্টি রাতটা জরির বাড়ীর চালাতে কাটাতে পাড়লে আর বাড়ী যাবে না। জরি রাগত্ব স্বরে বলল ———-“দেখ বুড়ী অন্য কোথাও যাও আমাকে জ্বালাইওনা।”
জরি তার ছোট্ট উঠান মাড়িয়ে ঢুকল তার এক চালা রান্নাঘরে। হঠাৎ উঠল প্রোসব ব্যথা। সে অনেক কষ্টে কলসটা রাখল মেঝেতে। ঘরটা প্রায় অন্ধকার , তখন সাঁঝের আলোটা পর্যন্ত জ্বালান হয় নি। ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল জরি। সে প্রানান্ত চেষ্টা করছে সন্তান প্রসবের।
ভুমিষ্ট হোল শিশু। জরি চোখ বুজে সন্তান প্রসবের পরবর্তি স্বস্থিটুকু ভোগ করছিল। সন্তান প্রসবের পর সন্তান ধারনের যে আনন্দ তা কেবল মায়েরাই জানে। তা কেবল প্রসূতিরাই ভোগ করে।
এই সময় কালার মা এসে দরজায় দাড়াঁয়। জরিকে ডাকে রাতটা যেন থাকতে দেয়। কালার মাকে জরি ভিতরে ডাকে, বাচ্চাটার নাড়ী কাটার জন্য। অন্ধোকারে শিশুটিকে হাতরিয়ে কালার মা বলে উঠল, “এটাতো মেয়েরে।”
বুড়ীর কথা শুনে জরির প্রসবের সব আনন্দ যেন নিমেষেই বন্যায় ভেসে নিয়ে গেল। এবার আর তার রক্ষা নেই, নিশ্চিত তার ঘর ভাঙ্গবে। এই মেয়ে তার ঘর ভাঙ্গবার জন্য এসেছে। তার বড় রাগ হল শিশুটির ওপর। পা দিয়ে সে শিশুটিকে সরিয়ে দিল। তার মন বলছে, এ মেয়েটা মরলে তার আর ঘর ভাঙ্গবে না। তার ক্লান্ত পা দুটো দিয়ে শিশুটির গলা চেপে ধরতে চাইছে।
হঠাৎ এক টুকরো আলো দরজার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়ল শিশুটির মুখের ওপর। মুখের দিকে তাকাল জরি। সন্তান বাৎসল্যে গলে গেল মাতৃহৃদয় । দুটো হাত দিয়ে শিশুটিকে ছোঁ মেরে তুলে নিল বুকে। গালে, কপালে চুম্বন ও দিল কয়েকটা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল তার ঘরের দরকার নাই , তার সন্তান আছে।
এবার জরির চোখ পড়ল শিশুটির নাভির নিচে। একি দেখছে সে, এ যে তার ছেলে। সে চীৎকার করে বলল, “ওমা ! তুই এত মিথ্যাবাদী, এটা যে আমার ছেলে রে।'”
এই বলে সে কাঁদতে লাগল। তার আনন্দ আশ্রুতে শিশুর ভেজা ও পিচ্ছিল বুক আরও ভিজে গেল। পৃথিবীর সব আনন্দ যেন আজ জরির ছোট্ট চালা ঘরে এসে জমে হয়েছে। এ সুখ শুধু পুত্র সন্তান প্রসবের নয়, তার ঘর না ভাঙ্গার ।
এইচিত্র শুধু দিনমজুর অশিক্ষিতের ঘরে নয় প্রায় প্রতিটি ঘরে, শতকরা ৯৫%। ব্যতিক্রম ৫%.। ব্যতিক্রম কখনওই উদাহরন নয়।
২১টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
দারুন লিখলে। বাস্তবতা তুলে ধরলে।
আমার বাসার বানুর আবারও বাচ্চা হবে। এই নিয়ে ওর চার নাম্বার বাচ্চা। ওর বর ঢাকা গেছিল,ওর সে কি কান্না। এই ভয় যদি ওখানে কোনো মেয়ে বিয়ে করে ! ফিরিয়ে আনতে একটা রিক্সা কিনে দিলাম। এখন ওর স্বামী ওটা ভাড়া দিয়ে সারাদিন ডান্ডাগুলি খেলে বেড়ায়। এই পেট নিয়োও কাজ করে। বলো একবার !
খসড়া
মেয়েগুলারে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে। এই সমাজ ব্যবস্থা কেন যে মেনে নেয়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যেদিন ৯৫% মেয়েরা বিরুদ্ধাচরণ করা শুরু করবে, সেদিন পরিবার প্রথাটাই হয়তো ভেঙে পড়বে!
তারপরও চাই এমন অন্যায় কম্প্রোমাইজ করা থেকে মেয়েরা বেরিয়ে আসুক। কম্প্রোমাইজ হবে ন্যায়সঙ্গত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা সর্বদাই উন্নত থাকা উচিৎ।
আবু খায়ের আনিছ
একবিংশ শতাব্দিতে এসেও কণ্যা সান্তানকে যদি এই দৃষ্টিতে দেখা হয় তাহলে তারচেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে এই সভ্য সমাজের।
খসড়া
এই সমাজ কি সভ্য? অসভ্যতার ভিত্তিতেই সভ্যতা দাঁড়িয়ে।
আবু খায়ের আনিছ
আমাদের ব্যর্থতা, আমরা নিজেরা একটা সভ্য সমাজ পেয়েছি বা পাইনি সেটা নিয়ে নয়, বরং আমরা একটা সভ্য সমাজ দিয়ে যেতে পারছি না এটা নিয়ে।
খসড়া
সেটাই, নেই নেই বলে চেচাচ্ছি, কিন্তু একবারও ভাবছিনা কি দিলাম।
আবু খায়ের আনিছ
চরম মূল্য দিতে হবে আমাদের কে, আমাদের এই আচরণের জন্যই। পৃথিবী আমাদের ক্ষমা করবে না।
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত বাস্তব এই গল্প, একে গল্প না বলে সমাজের চিত্রই বলা যায়
নারীরা কেবল সন্তান উৎপাদন করবে, যে কোন সময় তালাকে হয়ে যেতে পারে, নারীর শরীরের চাহিদার কথা, ইচ্ছে অনিচ্ছার কথা খুব কম পুরুষ ভাবেন, মোট কথা নারীরা একটি বস্তু- এমন ধারনায় আচ্ছন্ন থাকা পুরুষের সংখ্যাই বেশি।
ভাল লিখেছেন।,
খসড়া
শুধু বেশী না বিপদজ্জনকও।
ইনজা
এ আমাদের সমাজেরই চিত্র তুলে ধরেছেন।
দারুণ ভাবে তুলে এনেছেন বাস্তবতা।
খসড়া
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
রিমি রুম্মান
লেখাটি পড়তে পড়তে কয়দিন আগে পত্রিকায় দেখা একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। কন্যা সন্তান বলে শিশুটির বাবা মা শিশুটিকে হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল।নানাবিধ শারীরিক জটিলতার কারনে মাস শেষে শিশুটি মারা যায়। ভর্তি ফাইল থেকে তথ্য নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফোন করা হল শিশুটির বাবা মা’কে। বাবা ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তর দিল, “মেয়ের মা নিতে চায়না, আমি কি করতে পারি ? এখন কারখানায় কাজ করছি, পরে কথা বলবো” । এরপর সেই বাবার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মৃত্যুর পরও কন্যাটিকে কাছে টেনে নিলো না সেই পাষাণ বাবা মা !
ভীষণ এক কষ্ট দলা পাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসা খবর !
খসড়া
জন্মই মেয়েদের আজন্মের পাপ।
লীলাবতী
সন্তান কন্যা হবে না পুত্র হবে একশত ভাগ নির্ভর করে পিতার উপর। এই সত্যটির বহুল প্রচার প্রয়োজন। ছেলে কেন হয়না এর দায় সম্পুর্নই নিতে হয় নারীদের। লেখাটি পড়ে খুব খারাপ লাগছে আপু।
খসড়া
সন্তান ছেলে না মেয়ে এর দায় সম্পূর্ণ পুরুষের এই প্রচার চালিয়ে কি জন্ম শিশুটির ভাগ্য বদলাবে? হয়ত মায়ের ভার কিছু কমবে। মেয়েটি বড় হবার আগেই তার শরীর সকলের কামনার বস্তু হবে। মেয়েটি পন্য হয়ে লোভাতুর দৃষ্টির সামনে নিজের জন্ম পাপে ভুগবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
এমন ধারাই বয়ে চলবে আজন্ম। এ সমাজ ব্যবস্থা বদলাবে না কিছুতেই। অশিক্ষিতদের কথা বাদ দিলাম, শিক্ষিত-আধুনিক সমাজেও পুত্র সন্তানের চাহিদা প্রথমে।
মোঃ মজিবর রহমান
এই কালচার আর যাই বলি আপু
মানসিক চিন্তাভাবনা না বদলালে কিছুই করার নায়। ের জন্য দরকার সরকারের ভিতর লুকিয়ে থাকা বিচার বাস্তবায়ন করা।
এই সেই পুরুষ নারী মুক্তির জন্য আন্দোলন করে আবার ঘরে ফিরে নারী নির্যাতন করে আবার সেম তাই নারীর খেত্রেও অনেক নারী নেত্রী আছে নারী অধিকার আদায়ে অগ্রনী ভুমিকা রাখছে আবার ঘরে নিজেই তাঁর বাস্তবায়নে কোন সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা আগ্রহী নয় কারন কাজের বুয়া বা খালা যাই বলি না কেন নিজের স্বার্থ ছাড়তে পারে না।
এই স্বার্থ আমাদের সমাজকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ঘূণে ধরা সমাজের বাস্তব চিত্র যা এখন অনেকটা কমে গেছে।দেশ যত আধুনিকতার ছোয়া পাবে ততই এ সব কুসংস্কার কমতে থাকবে।সুন্দর উপস্থাপনা । -{@
অপার্থিব
নিম্ম বিত্ত পরিবারের নারীরা সব সময় অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত ছিল কিন্ত তারা তাদের কাজের যথাযথ মুল্য পায় না। যেটুকু পায় সেটাও ঘরে ফিরে তাদের স্বামী বা পরিবারের পুরুষ কর্তা নিয়ে নেয়। নিজেদের অর্থের মালিকানা বিষয়ে নারীদের আরো সচেতন হতে হবে। একজন নারীর হাতে যখন অর্থের মালিকানা থাকবে তখন সে নিজের অধিকার আদায় ও পুরুষতান্ত্রিক নানা শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অনুপ্রেরনা পাবে।
অর্থনৈতিক মুক্তি তারা সামাজিক ক্ষমতায়ন ঘটাবে। ভাল লেগেছে লেখা।
ব্লগার সজীব
নারীদের এমন ভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। লেখা অত্যন্ত ভাল হয়েছে।