একটা কুকুরের গল্প

বোকা মানুষ ৩ ডিসেম্বর ২০১৪, বুধবার, ১০:৫১:৪৫অপরাহ্ন গল্প, সাহিত্য ২৮ মন্তব্য

আট বছর বয়সি শারু ফুটপাথের একধারে বসে আছে। আর লোভাতুর নয়নে দেখছে এক কোনে ফেলে দেয়া কাবাব হাউজের উচ্ছিষ্ট হাড়গুলো কেমন গোগ্রাসে গিলছে একটা নেড়ি কুকুর! তার মুখের ভেতরে থেকে থেকে লালা জমা হচ্ছে, আবার সে লালাই গিলে ফেলছে সে!

 

শারুর পুরো নাম শাহরুখ! তার রিক্সাওয়ালা বাবা অভিনেতা শাহরুখ খানের অন্ধ ভক্ত ছিল। তাই ছেলের নাম প্রিয় অভিনেতার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিল। কালক্রমে সেটা সংক্ষিপ্ত হয়ে এখন শারুতে এসে ঠেকেছে। তার সাথের টোকাইরা তাকে এ নামেই ডাকে এখন।

 

শারুর পাঁচ বছর বয়সে তার মা মারা যায়। এর কিছুদিন পর তার বাবা আবার বিয়ে করে। সৎমা আসার পর শুরু হয় তার যন্ত্রনা। এক সময় তাড়িয়ে দেয় তাকে বস্তির ঘর থেকে। অভাবী বাপ দেখেও না দেখার ভান করে, হয়তো নিরবে মেনে নেয় খাওয়ার একটা মুখ কমবে ভেবে! তারপর থেকেই সে বস্তির কাছের এই ফুটপাথে থাকে অন্য আর কয়েকজন টোকাইয়ের সাথে। সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে দিনশেষে বিক্রি করে মহাজনের কাছে। মহাজনটাও মহা খচ্চর। কখনও পুরো দাম দেয়না। বাকি রেখে দেয়। বেশ কিছুদিনের পাওনা জমতে জমতে প্রায় শ’ দেড়েক টাকা জমা হয়েছে আজ পর্যন্ত। সেই পাওনা টাকা চাইতে গেলে বেশ জোর ধমক খেয়েছে সে আজ মহাজনের কাছে। তারপরও দমেনি। ঘাড় ত্যাড়া করে অনেকটা উচ্চকিত হয়েই আবার দাবী করেছিল পাওনা বাকি টাকা। ফলাফল, মহাজনের হাতে তিন-চারটা কঠিন চড়!

 

সত্যি বলতে কি, গত কদিন ধরেই সে ভাবছিল এই টাকাটা আদায় করার কথা! গত পনের দিন হলো গলির মোড়ের এই কাবাবের দোকানটা চালু হয়েছে। তারপর থেকেই দোকানের সামনে দিয়ে যতবারই সে যায়, ততবারই কাবাবের সুগন্ধে তার প্রান আঁই ঢাঁই করে ওঠে। মুখে লালা জমে, আর ভাবে, “আহ্! যদি একবার খাইতাম ফারতাম একখান পোড়া মুরগির ঠ্যাং!” ভাবে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে আয়না ঢাকা, আগুন জ্বলা অদ্ভুত আলমারিটার সামনে, যেখানে সার দিয়ে রাখা আস্ত সব মুরগি পুড়ে পুড়ে কাবাব হয়। সে দাঁড়ানোর পর যতবারই কারিগর বা অন্য কেউ তাকে দেখে, ততবারই দুর দুর ছাই ছাই করে তাড়িয়ে দেয়। অথচ, সেই একই মানুষেরা কি সুন্দর ডেকে ডেকে পথের কুকুরটাকে উচ্ছিষ্টগুলো খেতে দেয়! সে ভাবে, কুকুরটার বদলে ওরা তাকে ডেকেও তো দিতে পারতো উচ্ছিষ্ট হাড়গুলো! কাবাব তার চিন্তা, সময়, মন- সব দখল করে নেয় ক্রমে। রাতের ঘুমের মধ্যেও সে স্বপ্ন দেখে কাবাব! প্রতি রাত্রে সে স্বপ্নে দেখে যে সারা ফুটপাথ ভর্তি কাবাব আর কাবাব। সেসব কাবাব সে খাবলে খাবলে খাচ্ছে আর কারিগর দুরে বসে মুখ চুন করে বসে তার খাওয়া দেখছে!

 

আজও সে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে ছিল সেই অদ্ভুত কাঁচঢাকা, আগুন জ্বলা আলমারির সামনে! যথারীতি সরে যাবার জন্য ধমক। ধমক খেয়ে কি যেন রোখ চেপে গিয়েছিল তার মাথায়। কারিগরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল “কয় ট্যাহা দাম আফনের এই মুরগির ঠ্যাং এর? কিন্না খামু!” শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কারিগর বলেছিল “এহ্, তেজ কত! সত্তুর ট্যাহা দিয়া ফইন্নির ফুতে খাইবো চিকেন গিরিল! যা ফোট!” তার জেদ চেপে গিয়েছিল একথা শুনে। তারপরই মহাজনের কাছে বাকি টাকা চাইতে গিয়ে ধমক আর চড় খাওয়া।

 

এখন সে বসে আছে কাবাবের দোকান থেকে একটু দুরে ফুটপাথের ধারে, কারিগর বা দোকানের অন্য কর্মচারীর দৃষ্টির আড়ালে। নির্নিমেষ দেখছে কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাওয়া। তার বুক কি এক অদ্ভুত যন্ত্রনায় মোচড়াচ্ছে। চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরছে জল! সেই কান্না নিয়েই সে ফিরে যায় তার ঘুমানোর জায়গায়। সে খানে একসাথে ঘুমানোর জন্য আসা জনি অবাক হয়ে জানতে চায় “কিরে শারু, কান্দস ক্যারে!” জনির প্রশ্নে তার কান্নার দমক যেন বেড়ে যায়! ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলে “কুত্তা হইতাম মন চায়রে জনি, কুত্তা হইতাম মন চায়……….”

৯৮১জন ৯৮১জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ