আট বছর বয়সি শারু ফুটপাথের একধারে বসে আছে। আর লোভাতুর নয়নে দেখছে এক কোনে ফেলে দেয়া কাবাব হাউজের উচ্ছিষ্ট হাড়গুলো কেমন গোগ্রাসে গিলছে একটা নেড়ি কুকুর! তার মুখের ভেতরে থেকে থেকে লালা জমা হচ্ছে, আবার সে লালাই গিলে ফেলছে সে!
শারুর পুরো নাম শাহরুখ! তার রিক্সাওয়ালা বাবা অভিনেতা শাহরুখ খানের অন্ধ ভক্ত ছিল। তাই ছেলের নাম প্রিয় অভিনেতার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিল। কালক্রমে সেটা সংক্ষিপ্ত হয়ে এখন শারুতে এসে ঠেকেছে। তার সাথের টোকাইরা তাকে এ নামেই ডাকে এখন।
শারুর পাঁচ বছর বয়সে তার মা মারা যায়। এর কিছুদিন পর তার বাবা আবার বিয়ে করে। সৎমা আসার পর শুরু হয় তার যন্ত্রনা। এক সময় তাড়িয়ে দেয় তাকে বস্তির ঘর থেকে। অভাবী বাপ দেখেও না দেখার ভান করে, হয়তো নিরবে মেনে নেয় খাওয়ার একটা মুখ কমবে ভেবে! তারপর থেকেই সে বস্তির কাছের এই ফুটপাথে থাকে অন্য আর কয়েকজন টোকাইয়ের সাথে। সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে দিনশেষে বিক্রি করে মহাজনের কাছে। মহাজনটাও মহা খচ্চর। কখনও পুরো দাম দেয়না। বাকি রেখে দেয়। বেশ কিছুদিনের পাওনা জমতে জমতে প্রায় শ’ দেড়েক টাকা জমা হয়েছে আজ পর্যন্ত। সেই পাওনা টাকা চাইতে গেলে বেশ জোর ধমক খেয়েছে সে আজ মহাজনের কাছে। তারপরও দমেনি। ঘাড় ত্যাড়া করে অনেকটা উচ্চকিত হয়েই আবার দাবী করেছিল পাওনা বাকি টাকা। ফলাফল, মহাজনের হাতে তিন-চারটা কঠিন চড়!
সত্যি বলতে কি, গত কদিন ধরেই সে ভাবছিল এই টাকাটা আদায় করার কথা! গত পনের দিন হলো গলির মোড়ের এই কাবাবের দোকানটা চালু হয়েছে। তারপর থেকেই দোকানের সামনে দিয়ে যতবারই সে যায়, ততবারই কাবাবের সুগন্ধে তার প্রান আঁই ঢাঁই করে ওঠে। মুখে লালা জমে, আর ভাবে, “আহ্! যদি একবার খাইতাম ফারতাম একখান পোড়া মুরগির ঠ্যাং!” ভাবে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে আয়না ঢাকা, আগুন জ্বলা অদ্ভুত আলমারিটার সামনে, যেখানে সার দিয়ে রাখা আস্ত সব মুরগি পুড়ে পুড়ে কাবাব হয়। সে দাঁড়ানোর পর যতবারই কারিগর বা অন্য কেউ তাকে দেখে, ততবারই দুর দুর ছাই ছাই করে তাড়িয়ে দেয়। অথচ, সেই একই মানুষেরা কি সুন্দর ডেকে ডেকে পথের কুকুরটাকে উচ্ছিষ্টগুলো খেতে দেয়! সে ভাবে, কুকুরটার বদলে ওরা তাকে ডেকেও তো দিতে পারতো উচ্ছিষ্ট হাড়গুলো! কাবাব তার চিন্তা, সময়, মন- সব দখল করে নেয় ক্রমে। রাতের ঘুমের মধ্যেও সে স্বপ্ন দেখে কাবাব! প্রতি রাত্রে সে স্বপ্নে দেখে যে সারা ফুটপাথ ভর্তি কাবাব আর কাবাব। সেসব কাবাব সে খাবলে খাবলে খাচ্ছে আর কারিগর দুরে বসে মুখ চুন করে বসে তার খাওয়া দেখছে!
আজও সে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে ছিল সেই অদ্ভুত কাঁচঢাকা, আগুন জ্বলা আলমারির সামনে! যথারীতি সরে যাবার জন্য ধমক। ধমক খেয়ে কি যেন রোখ চেপে গিয়েছিল তার মাথায়। কারিগরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল “কয় ট্যাহা দাম আফনের এই মুরগির ঠ্যাং এর? কিন্না খামু!” শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কারিগর বলেছিল “এহ্, তেজ কত! সত্তুর ট্যাহা দিয়া ফইন্নির ফুতে খাইবো চিকেন গিরিল! যা ফোট!” তার জেদ চেপে গিয়েছিল একথা শুনে। তারপরই মহাজনের কাছে বাকি টাকা চাইতে গিয়ে ধমক আর চড় খাওয়া।
এখন সে বসে আছে কাবাবের দোকান থেকে একটু দুরে ফুটপাথের ধারে, কারিগর বা দোকানের অন্য কর্মচারীর দৃষ্টির আড়ালে। নির্নিমেষ দেখছে কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাওয়া। তার বুক কি এক অদ্ভুত যন্ত্রনায় মোচড়াচ্ছে। চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরছে জল! সেই কান্না নিয়েই সে ফিরে যায় তার ঘুমানোর জায়গায়। সে খানে একসাথে ঘুমানোর জন্য আসা জনি অবাক হয়ে জানতে চায় “কিরে শারু, কান্দস ক্যারে!” জনির প্রশ্নে তার কান্নার দমক যেন বেড়ে যায়! ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলে “কুত্তা হইতাম মন চায়রে জনি, কুত্তা হইতাম মন চায়……….”
২৮টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
শেষ লাইনে এসে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো ভাইয়া।
বোকা মানুষ
হ্যাঁ 🙁
শুন্য শুন্যালয়
🙁 অদ্ভূত পৃথিবী। মন ভীষণ খারাপ করে দিলেন ভাইয়া।
বোকা মানুষ
হ্যাঁ, পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত!
মামুন
সুন্দর লিখেছেন…
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ!
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ভীষন বেদনাদায়ক অনুভূতি। -{@
বোকা মানুষ
🙁
জিসান শা ইকরাম
গতকাল পড়েছি
এমন চিৎকার আসলে কানে আসতেই থাকে ।
ভালো লিখেছেন।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ ভাইজান!
রাতুল_শাহ
পোষ্টে লিখেছেন বলে, শারুর জন্য অনেক মায়া হচ্ছে, মনে হচ্ছে এখনই তাকে কাবাব গ্রীল খাবার টাকাটা দিয়ে আসি। কিন্তু গল্পের বাইরে, অর্থাৎ রাস্তায় নামলে কেন জানি সে মায়া আর থাকে না।
লেখাটা সুন্দর…..
বোকা মানুষ
রাস্তায় বেরুলে হয়তো চোখ কান খোলা রাখিনা আমরা! রাখলে ঠিকই হয়তো নিজেদের সাধ্যমত করতাম তাদের জন্য! যে যাই বলুক, মানুষের মধ্যে মায়ার শক্তিটাই বেশি। অনেকে হয়তো প্রকাশ করতে পারেনা সে মায়া জাগতিক নানা সীমাবদ্ধতার কারনে! লেখার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ! 🙂
প্রজন্ম ৭১
সিষ্টেমের প্রতি দারুন কটাক্ষপুর্ন লেখায় ভালোলাগা জানালাম
বোকা মানুষ
তারুণ্যে সিস্টেমের প্রতি ছিল তীব্র ক্ষোভ। সময়ের সাথে সাথে সিস্টেমই সেই ক্ষোভ দারুন দক্ষতায় খেয়ে ফেলে এই আমাকেই তার একটা নিষ্কর্মা অংশ বানিয়ে নিয়েছে! কিন্তু কখনও কখনও রক্তে ঘাপটি মেরে থাকা সেই তারুণ্য, সেই ক্ষোভ মাথাচাঁড়া দিতে চাইলে কিবোর্ডে ওঠে ঝড়। তবে হয়তোবা এখনকার আমি-র মত সে ঝড়ও নিষ্কর্মা! 🙁
মারজানা রুবা
বাস্তব চিত্র!আমরা কয়বার তাদের দিকে মনযোগ দিতে পারি!তবে আমার বিশ্বাস জীবন থেকে নেয়া এ ধরনের গল্প কিছুটা হলেও মানুষের মনে নাড়া দিবে।
বোকা মানুষ
আমি সীমিত সাধ্যের অথর্ব মানুষ। দেখি, কিন্তু নিজের অকিঞ্চিৎকর লেখার মাধ্যমে এগুলো তুলে ধরা বাদে তেমন আর কিছুই করতে পারিনা! এই না পারা আমাকে উনমানুষ হওয়ার যন্ত্রনায় পোড়ায় নিয়ত! 🙁
আজিজুল ইসলাম
নিষ্কর্মা এই ঝড়কে জাগিয়ে তুলুন ভাই। বালুর মধ্যে মুখ ডুবিয়ে রাখলে প্রলয় বন্দ্ব হবেনা।
বোকা মানুষ
বালুর মধ্যে তো মুখ ডুবিয়ে নেই ভাই। বরং সবকিছু বড় বেশি ধরা পড়ে চোখে! কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু তেজ নিয়ে কিছুই করতে পারিনা দেখে নিজেকেই আজকাল প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকি ক্রমাগত!
Alam Dipro
ছোট লেখায় ভীষণ গভীরতা দেখিয়েছেন । বেশ লাগল ! লিখে চলুন । শুভকামনা ।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ আপনাকেও!
আবু জাঈদ
দারুন করুন, ছোট গল্প হিসেবে খুব ভাল লাগল, শেষ টা দুর্দান্ত। তবে লেখার কিছু দুর্বলতা আছে, পাঠক হিসেবে যা আমাকে পিরা দিল, যেমন ‘ তার পাঁচ বছর বয়সে তার
মা মারা যাবার পর তার বাবা আবার
বিয়ে করে।’ এখানে ‘তার ‘ শব্দ টা তিন বার এলো, আবার ‘ফারতাম’ ওখানে হবে ‘পারতাম ‘ ময়মনসিংহ আষায় পারতাম ই হবে
বোকা মানুষ
লেখা পছন্দ করার জন্য ধন্যবাদ। তারর চেয়েও বেশি ধন্যবাদ পীড়াবোধটুকু জানানোর জন্য। সে অংশটা আমারও ঠিক মনে ধরছিল না। সম্পাদনা করে অন্যভাবে লিখবো। 🙂
বোকা মানুষ
দিলাম সম্পাদনা করে। আবারও ধন্যবাদ।
খেয়ালী মেয়ে
পড়লাম-খুব ভালো লিখেছেন..
সেইসাথে মনের ভেতর একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে যে, আমরা এতো খারাপ কেনো? 🙂
খেয়ালী মেয়ে
🙁
বোকা মানুষ
খারাপের ভেতর বাঁচতে বাঁচতে আমরা খারাপ হয়ে যাই! 🙁
মেহেরী তাজ
শারুর জন্য কেমন কষ্টের এক অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হলাম।
বোকা মানুষ
ওর কথা যখন লিখছিলাম, তখন আমার মাথায় ঘুরছিল আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলের কথা! 🙁