অফিসের কাজে সিলেট যেতে হচ্ছে রুনার। কালাম ছেলেটা বেশ কাজের। রুনা চৌধুরীর নতুন পিওন সে। বাসের মাঝামাঝি জানালার পাশের সিট নিয়েছে । জার্নিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে গান শুনতে ভাল লাগে রুনার। সকাল বেলা ঢাকা থেকে সিলেট যেতে ডান পাশে খুব রোদ লাগে। কালাম বুঝেশুনে বাম পাশের সিট নিয়েছে… এসব ভাবতে ভাবতে বাইরের দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে হঠাত নিজের হাতের দিকে তাকায় রুনা। হাতের পিঠে জালের মত অজস্র চিকন রেখাগুলো আগের চাইতে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বয়স হয়েছে তো।
মাস তিনেক আগে শারিরিক সমস্যার জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল রুনা। ডাক্তার সব শুনে বলে দিয়েছে প্রতিমাসের নিয়ম করে শরীর খারাপ করার ঝামেলা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়েছে সে। আটচল্লিশ বছর বয়স্কা একজন মহিলার জন্য এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কথা নিশ্চিত হবার পর টানা আড়াই দিন কেঁদেছে রুনা।
কেমন যেন শক্তিহীন আর নিঃসম্বল লাগছিল হঠাত করে। বিয়ে, স্বামী- সন্তান, সংসার এগুলো কখনই ছিল না তার জীবনে। তাও কেন যে এত দমবন্ধ করা কষ্ট, সব শেষ হয়ে যাবার কষ্ট, পাঁজর ভেঙ্গেচুরে যাবার কষ্ট…
রুনার ভার্সিটি জীবনের রুমমেট আর সবচে কাছের বান্ধবী লুতফা। লুতফার বিয়ে হয়ে গেছিল ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই। তারপরে সংসার- বাচ্চা কাচ্চা, স্বামীর ঘন ঘন বদলীর চাকরি এসবের কারনে নিজের আর কিছু করা হল না, পুরোদস্তুর হাউজ ওয়াইফ হয়েই জীবন পার করে দিল।
এত যত্নআত্তি করেও ধরে রাখতে পারলো না লোকটাকে। থ্রম্বোসিস না কি এক অসুখে হার্টের রক্তনালী বন্ধ হয়ে মারা গেল। আজ প্রায় তিন বছর লুতফা একা। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, মেয়ের ঘরে এক নাতনী আছে। লুতফার কাছে “সুখ” শব্দের অর্থ আগে ছিল স্বামী- সন্তানের খুশি, আর এখন যোগ হয়েছে নাতনীর চারটে দাত দেখানো ভুবনভোলানো হাসি।
দুই বান্ধবীর হোস্টেল জীবনে অবসর সময়ের কাজ ছিল ফিলোসফি কপচানো। এই বয়সেও তারা একে অপরের একাকীত্ব ভুলে থাকার অবলম্বন। একদিন নাটকীয়ভাবে দুই একাকী প্রৌঢ়া ঠিক করে কিছুদিনের জন্য তারা তাদের সবকিছু অদল বদল করে দেখবে- জীবন কোথায় কেমন। অন্যের জীবনের প্রতি মোহ হয়ত মানুষের সহজাত।
লুতফা ওঠে রুনার বাড়ীতে। সেখানে সব রকম সুযোগ সুবিধা আছে। রুনার ঘরে এসি, কম্পিউটার, আরো অনেক কিছু যা লুতফা নিজের জন্য কখনো ভাবতেই পারে না। এসব জিনিস থাকে তার ছেলে মেয়েদের ঘরে। অথচ এখানে রুনার জন্যই সব আয়োজন। নিজেকে বঞ্চিত করে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে গেছে শুধু ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ করার জন্য। সেই ত্যাগের স্বীকৃতি বা বিনিময় কিছুই সে পায় নি, শুধু ছেলে মেয়েরা ভাল আছে- এটাই সুখ।
লুতফাকে এসে কালাম জিগেস করে- “ম্যাডাম, দুপুরে কি খাবেন?”
চমকে উঠে লুতফা। “ম্যাডাম” সম্বোধনটা ঠিক তার সাথে যায় না। তাকে তো সবাই “ভাবী” ডাকে। আর লুতফা কি খাবে এটা কেমন প্রশ্ন? এমন প্রশ্ন কেউ কবে করেছিল কিনা মনে করতে পারে না সে। তার যে ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছু আছে সে নিজেই ভুলে গেছিল।
কালামকে বিদেয় করে পাশের ঘরে ঢুকে লুতফা। এই ঘরটা সবসময় বন্ধ থাকে। গেস্ট রুম ও নয়। হয়তো রুনার স্টাডি হবে। আস্তে করে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে চোখ বুলায় একবার। একটা শেলফে কিছু বই আর টুকটাক জিনিস। ফটোফ্রেমে এক কোকড়া-চুল যুবকের ছবি। আরে! ওটাতো আনিস! যাকে ভালোবাসতো রুনা। লুতফা রুমের সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখে নিশ্চিত হয়- এই ঘরটা ভর্তি শুধু আনিসের স্মৃতিতে। এমনকি স্টাডি ট্যুরে গিয়ে আনিসের কিনে দেয়া ঝিনুকের মালাটাও আছে এখনো।
আশ্চর্য! একবারো এই ঘরটার কথা লুতফাকে বলেনি? আনিস এখন আমেরিকায়। ওখানকার সিটিজেন এক মহিলাকে বিয়ে করে সেখানেই রয়ে গেছে। আর রুনা পাগলিটা তার স্মৃতি দিয়ে আস্ত একটা ঘর সাজিয়ে বসে আছে!
লুতফার চোখ ফেটে জন বের হয় অভিমানে। সে তো কখনো প্রবীরের স্মৃতি এভাবে আগলে রাখার সাহস করে নি। বরং মনে আসা মাত্রই ভুলে যাবার জন্য নিজের সাথে কত প্রতারণাই না করেছে! আনিসের মত প্রবীর তো কাপুরুষ ছিল না। লুতফাই এই অসম্ভব সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করার সাহস যোগাতে না পেরে ধুম করে বিয়ে করেছে অন্যকে। আজকে হঠাত নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে তার। অনেকগুলো বছর পরে এতদিন দাবিয়ে রাখা স্মৃতিগুলো দুর্বলতার সুযোগে চারদিক ভেঙ্গেচুরে আসতে লাগলো।
এই সময়গুলোতে লুতফার বাড়িতে আছে রুনা। তেল চপচপে পরোটা আর ডিম সকালের নাশতা। রুনার ভাল না লাগলেও লুতফার ছেলেটা খুব তৃপ্তি করে খেল। এজন্যই এত মুটিয়ে গেছে লুতফা- ভাবছে রুনা। সারা ঘরে লুতফা আর তার স্বামীর অনেক ছবি সাজানো। কি সুখী সুখী চাহনি তাদের! নাকি নিজের ভিতরের শুন্যতার কারনেই এমন লাগছে রুনার? লুতফার একটা বিয়ের ছবি আছে শোবার ঘরে।সেটার দিকে তাকিয়ে অজস্র বলিরেখার মালকিন রুনা ভাবে, কেমন দেখাতো আমাকে বউ সাজলে? তা আর জানা হলো না… অনেক ভালোবাসা দিয়েছিল যাকে একদিন, সে বিনিময়ে শুধু মুক্তিটুকুও দিল না।
ছেলেটা রেডি হয়ে বাইরে যাচ্ছে। একটু অসন্তুষ্টি তার চোখে মুখে। হয়তো মা নেই বলে অসুবিধা হচ্ছে। হঠাত নিজের অপারগতার জন্য লজ্জা লাগলো রুনার। সে চাইলেও এই ছেলেটার মায়ের ভূমিকা পালন করতে পারবে না। এমন একটা ছেলে, নিজের নাড়ি ছেঁড়া- শুধু এই ভাবনাটাই যে কত নির্ভরতার অনুভুতি দিতে পারে তা রুনা কিভাবে জানবে?
বিকেলে আসল লুতফার মেয়ে আর নাতনী। রুনা অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাটাকে কোলে রাখতে পারল না। কি করে পারবে? মা মারা যাবার পরে কেউ তো একটু মমতার স্পর্শ দেয়নি তাকে- সে তো বরফ শীতল। কতগুলো বছর তার হাতদুটি অন্য কোনও হাতের উষ্ণতা পায়নি সে হিসাব কে রাখে! এই মায়ার জাল বিছানো চারপাশে নিজেকে বড় অবাঞ্ছিত লাগতে শুরু করে রুনার।
লুতফাও বুঝতে পারে- নিজের জীবন থেকে বেরিয়ে এসে অন্যের জীবনের স্বাদ নিতে চাওয়া ছিল অনেক বড় ভুল। গায়ে পড়ে অযথা এতগুলো কষ্ট ডেকে আনা।
পরদিন নিজ নিজ জগতে ফিরে এল দুইজনেই। ফোনে কথা বলে দুজনেই জানালো খুব ভাল লেগেছে এই একদিনের বৈচিত্র্য। ফোন রাখার আগে রুনা বললোঃ
– তোর বাসায় গিয়ে অনেক দিন পর মনযোগ দিয়ে গান শুনলাম। একটা গান খুব ভাল লেগেছে। এইমাত্র ডাউনলোড করে আবার শুনলাম।
– কোন গানটা?
– নচিকেতা নামের এক শিল্পীর। গানের প্রথম লাইন- “দেখে যা, যা অনির্বাণ। কি সুখে রয়েছে প্রান…”
৩০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
দুজনের দুটো সম্পুর্ন ভিন্ন অপ্রাপ্তিকে ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন।
‘ লুতফা কি খাবে এটা কেমন প্রশ্ন? এমন প্রশ্ন কেউ কবে করেছিল কিনা মনে করতে পারে না সে। তার যে ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছু আছে সে নিজেই ভুলে গেছিল। ‘ — এমনই তো আসলে সংসার করা নারীদের জীবন।
অপ্রাপ্তিতেই আবার অভ্যাস্ততা তৈরি হয়েছে দুজনের, যা থেকে ইচ্ছে করলেও এনারা বেরিয়ে আসতে পারবেন না।
সব মিলেয়ে বেশ ভালো লেগেছে।
আরো ভালো লেগেছে অনেক দিন পরে আপনার লেখা পড়ে।
শুভকামনা সব সময়ের জন্য।
সিনথিয়া খোন্দকার
আমরা ভাবি এক আর হয় আরেক। এটাই নিয়ম।
গানের লিঙ্ক টা দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। 🙂
ছাইরাছ হেলাল
আপনি এ রকম করে লিখতে পারেন! এ সুন্দর লেখাটি পড়ার পরেও ভেবে অবাক হচ্ছি।
অদল বদলের নিরীক্ষা আমরা করতেই পারি কিন্তু বদলাতে পারিনা প্রায় কিছুই।
আরও লিখুন।
গানের লিংকটি দিয়ে দিলে আরও ভালো হয়।
সিনথিয়া খোন্দকার
লিখতে পারি কিনা জানি না, কিন্তু আপনাদের উৎসাহ ছাড়া এটুকুও কখনো হতো না।
কৃতজ্ঞতা জানালাম। -{@
শুন্য শুন্যালয়
অদ্ভুত সুন্দর একটা লেখা পড়লাম। কেউ কারো জায়গায় সুখী না, নিজের জীবন থেকে বেরিয়ে এসে অন্যের জীবনের স্বাদ নিতে চাওয়া ছিল অনেক বড় ভুল… নিজেদের না পাওয়ায় হতাশা নাকি অভ্যস্ততা, নাকি দুটোই? খুব সুন্দর গল্প।
সিনথিয়া খোন্দকার
অন্যের ঝাঁ চকচকে জীবনের প্রতি সবার মোহ আর হিংসা, কিন্তু অন্ধকারটা শুধু নিজের।
মোঃ মজিবর রহমান
জগত সংসার প্রাপ্তি আর অপ্রাতিতে ভরা। পড়ে ভাল লাগলো। আরও লেখার জন্য আবেদন।
শুভেছে রইলো।
সিনথিয়া খোন্দকার
অনেক ধন্যবাদ। 🙂
ব্লগার সজীব
“নদীর এপাড়ে বসিয়া কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপাড়েতেই সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস” এটি আসলে একটি ধারনা। কিন্তু যে যার নিজের স্থানেই ভালো থাকে। অত্যন্ত ভালো লিখেছেন।
আপু অনেক দিন পরে আপনার লেখা পেলাম। স্বল্প সময়ে একটি অবস্থান আপনি করে নিয়েছেন এখানে। আপনার লেখা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা কি ঠিক ?
সিনথিয়া খোন্দকার
আমি সপ্তাহের শেষে ঢাকায় আসি। বাকিদিন যেখানে থাকি সেখানে নেট কানেকশন নেই। তাই ইচ্ছা থাকলেও নিয়মিত যোগাযোগ সম্ভব হয় না। তবু সোনেলার টানে ফিরে আসি। অনেক আগে কেউ লিখেছিলেন বড় ব্লগাররা লেখেন কম, অন্যের লেখা পড়েনই না, মন্তব্যের জবাব দেন না ইত্যাদি।
এজন্য প্রতিবার নতুন কিছু লেখার সময় আমার এই অনিয়মিত আসা – যাওয়া নিয়ে লজ্জা বোধ করি। 😀
ব্লগার সজীব
এত কষ্ট করে আসেন এখানে তা জানতামনা আপু। সোনেলার প্রতি টান থাকলেই চলবে 🙂
মোঃ মজিবর রহমান
সোনেলার আসেন শুনে ভাল লাগলো।
জারা জবাব দেন না তাদের নিয়ে কিছুই বলার নেয়।
আপনার লেখা ভাল লাগে।
শুভেচ্ছা রইল।
বনলতা সেন
জীবনের চাওয়া বা না পাওয়া কেসের নিরিখে কী ভাবে ঠিক হবে আমরা জানি না।
আরও লেখা চাই।
সিনথিয়া খোন্দকার
আছি সবসময় আপনাদের সাথে। ছাইপাশ যা ই মাথায় আসে লিখব। পচানো যাবে না কিন্তু। :p
বনলতা সেন
লিখবেন যা মনে আসে । দেরি হলে সমস্যা নেই ।কিন্তু আসতে হবে ।লিখতেও হবে।
আমরা এখানে মজা করি কিন্তু পচাইনা।
সিনথিয়া খোন্দকার
(3
নীলাঞ্জনা নীলা
জীবন দর্শনকে ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। সহজ ভাবে চমৎকার উপস্থাপনা। নিজের পৃথিবী আসলেই একান্ত নিজের,অন্য কোথাও নিজের কিছু নেই।
সিনথিয়া খোন্দকার
পাওয়া-না পাওয়ায় ভরা সবাই। যে যেভাবে জীবনকে দেখে। অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
স্বপ্ন নীলা
চমৎকার উপস্থাপনা —– তার সাথে গান !!!
সিনথিয়া খোন্দকার
আমার প্রিয় গান। 🙂
খসড়া
অপূর্ব লিখেছেন।
সিনথিয়া খোন্দকার
ধন্যবাদ আপনাকে।
বন্দনা কবীর
গানটি শুনছিলাম আর লেখাটি পড়ছিলাম। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বৃত্যবন্দি করে ফেলেছি। এ বৃত্ত ভাঙ্গা সহজ নয়। আপনি ভালো লেখেন।
সিনথিয়া খোন্দকার
আমি আপনার ছোটখাটো একজন ভক্ত। আপনাকে সামনাসামনি দেখেছি, আপনি আপনার লেখার মতই সুন্দর একজন মানুষ। আমার লেখায় আপনার মন্তব্য দেখে সত্যি অনেক ভালো লাগছে। 🙂
লীলাবতী
দুইবার পড়লাম আপনার লেখা আপু। এক অন্য লেখককে পেলাম এখানে।ভিন্ন উচ্চতায়।
সিনথিয়া খোন্দকার
অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের জন্যই ফিরে আসা হয় বারবার। (3
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
খুব সুন্দর জীবনের বাস্তবতাময় লেখা ধন্যবাদ আপনাকে।
সিনথিয়া খোন্দকার
এভাবেই আমরা “ভালো আছি” এটা বোঝার আর বোঝানোর চেষ্টা মাত্র। আপনাকেও ধন্যবাদ। 🙂
অলিভার
নিজের গণ্ডি ছেড়ে অন্যের গণ্ডিতে পা রাখলে নিজের অসম্পূর্ণতা আর অপারগতাই চোখে পড়ে। আপনি সেটা খুব সুন্দর করে ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। সব পেয়েও যেমন কেউ পূর্ণতা পায় নি আবার সব হারিয়েও কেউ অন্যের চোখে অসম্পূর্ণ থাকে নি।
গল্পের জন্যে ভালোলাগা 🙂
সীমান্ত উন্মাদ
বেশ ভালো। শুভকামনা নিরন্তর