
প্রবাসে তেমন একটা সময় মিলে না বলেই হয়ত মাস তিনেক পর আবারও ছুটির দিনেই মিলির নাম্বারে কল করে সাজিদ। মন ভরে কথা বলা যাবে।
তুই আজকাল বড় স্বার্থপর হয়েছিস বুবু-
আর সব কথা বলার প্রায় শেষ পর্যায়ে, ফস করে অভিযোগ করেই ফেলল বোনের কাছে-
কেন রে ? হটাৎ কেন তোর মনে হলো যে- আমি স্বার্থপর হয়েছি।
কেমন যেন বদলে গেছিস, আমি অভিমান করেই এতোদিন কল করিনি তোকে, তুইতো পারতি। পারবি কি করে, সুখের জোয়ারে ভুলেই গেছিস আমাকে। হয়ত আমাদেরকে।
কথাগুলি অনেকটা খামখেয়ালিতে বলার পরের ২০ মিনিট, সাজিদ শুধু শুনেই গেলো স্বার্থপর বোনের স্বার্থপরতা-
স্বভাবত ধীর লয়ে মিলি বলছে-
পূবের জানালাটা খুলে দিতো মা, ঘুম ভাঙ্গতো হাজারটা বকা শুনতে শুনতে- আলসে মেয়ে, সেই সকালে ঘুম ভেঙ্গে পাড়ার মেয়েরা মায়ের সাথে হাজার কাজ সেরে স্কুলের জন্য রেডি হলো, বাপ ভাইয়ের নাস্তা বানালো, আমার অকর্মা মেয়ে ঘুমায়। কপালে যে কি আছে- মা হলে বুঝতি-
মনে হলে মুচকি হেসে দেয়াল ঘড়িটা দেখতাম,
সাড়ে সাতটা।
মা ইচ্ছে করেই এই একই সময়ে ঘুম ভাঙ্গাতো আমার, কখনো আগেও না পরেও না- অনেক কাজের ভীরেও মা কখনো ১০ মিনিট আগে ডাকেনি আমায়।
মুখ ধুয়ে রান্না ঘরে গেলেই দেখতাম, দুইটা পরোটা আর ডিম ভাজা চুলার পাশে। গরম গরম রাখা।
আজকাল লোকটা জানালার পর্দা টানে।
বিড়বিড় করে ছোট ছোট নালিশ শোনায়, অর্ধেক শুনি আর অর্ধেক শুনিনা।
প্রশ্ন করি কখনো – কি বলছো ? ডাকনি কেনো ?
অনেকটা রাগে জবাব দেয়- হুমম, আমার দায় পড়েছে ডেকে দিতে। আমার কলিগদের বৌ-রা প্রতিদিন কত সুন্দর করে দুপুরের খাবার রেডি করে দেয়। ওরা মজা করে অফিসে বৌয়ের হাতের রান্না খায়। আমার পোড়া কপাল, বৌয়ের ঘুম ভাঙ্গে নটায়।
কিন্তু জানিস- লোকটা সেই পাঁচটায় উঠেছে, গোসল সেরেছে। আমার জন্য বাথরুমে ওর পছন্দের কাপড় রেখেছে। রাতের খাবারের সব প্লেট বাটি ধুয়ে ফেলেছে, নিজে পিয়াজ ছাড়া ডিম পছন্দ করলেও আমার জন্য ডিমে পিয়াজ দিয়েই ভাজি করেছে। পারোটা সেইম, মায়ের মতো- একটু পোড়া পোড়া- কড়া ভাজি আমার পছন্দ, সে জানে-
ফ্রেশ হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আয়নার সামনে বারবার নিজের পরিচর্যা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে।
একসাথে খায়- কখনো পিয়াজ ছাড়া নিজের রুটির একাংশ আমার মুখে তুলে দিয়ে বলে- খেয়ে দেখ, অনেক মজা পিয়াজ ছাড়া ডিম।
মা কে মনে করে কখনো ভিজে আসে চোখ-
আমি মা কে ফেলে এসেছি- মায়ের মমতা এখনো ঘিরে আছে আমাকে।
ছোট বেলায় বাবা কাঁধে করে মেলায় নিয়ে যেতেন- স্কুলের সামনে সাইকেল থেকে নামার পর যতক্ষন না ক্লাশে যেতাম- এক পা প্যাডেলে রেখে তাকিয়ে থাকতেন। আমি ফিরে তাকালে মিটি মিটি করে হাসতেন।
কলেজে বাবা দুই তিন বার কল করতেন। নিজের ছেড়া জুতা না বদলালেও আমার জন্য থ্রী পিসের কাপড় নিয়ে আসতেন। চশমাটা হাতে নিয়ে অফিস যাওয়ার পথে দরজায় দাড়িয়ে ডাকতেন-
মিলি – মামণি চশমাটা দিয়ে যাবি, খুঁজে পাচ্ছি না।
লোকটা দুশ টাকায় নিজের জন্য ফতোয়া কিনে, বেতনের অর্ধেকটায় শাড়ি কেনে আমার জন্য।
সময়ে অসময়ে ফোন করে, কখনো যদি বলি- কেনো ফোন করেছো-
জবাবে বলবে, ওহহ তুমি, আমি তো আমার এক ক্লায়েন্টকে ফোন করেছিলাম।
কখনো বলবে, ভুলে চাপ পড়ে কল লেগে গেছে।
বাবার মতো মিথ্যে বলে আমাকে একবার দেখার মতো বাহানা এই লোকটা করে, চাবি ফেলে সিড়ি দিয়ে অর্ধেকটা নেমে যায়, সেখান থেকে চিৎকার করে- মিলি – মি…লি….
চাবিটা ফেলে এলাম,
দিয়ে যাও না প্লিজ-
আমি কাঁদি- অনেক কাঁদি-
বিধাতা বাবার স্নেহের মধ্যে আমাকে আজও রেখেছেন- বাবাকে মনে পড়ে প্রতিবার-
যতবার ওর মুখটা আমি দেখি।
সাজিদ – মনে পড়ে তোকে – বিয়ের পর বাবা মায়ের জন্য যতটা কেঁদেছি, তারচে বেশি কেঁদেছি তোর জন্য। আমার দেখায় দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল এবং সবচেয়ে মন্দ ভাই তুই।
মনে পড়ে ছোটবেলায় টিভির রিমোর্ট নিয়ে টানাটানি হতো তোর আমার?
তুই খেলা দেখতি- আর আমি দেখতাম সিরিয়াল।
বিয়ের দ্বিতীয় দিনে লোকটা আমার কাছে থেকে রিমোর্ট কেড়ে নেয়- অনেক রাগ হয়েছিল সেদিন।
আজকাল হয়না রাগ। সে সোফায় শুয়ে খেলা দেখতে শুরু করে, আমি ঘর গোছানো শেষে পাশে বসলেই দেখি লোকটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি রিমোর্ট নেই, চেনেল বদলাই- সিরিয়াল শেষে উঠে যাওয়ার সময় ডাকি।
কখনো সিরিয়াল নিয়ে কথা উঠলে বুঝতে পারি- সিরিয়ালের সবার সব কথা মুখস্থ ওর, লোকটা সোফায় ঘুমায় না কখনো, ভান করে থাকে, আমি যেন আমার মতো করে সিরিয়াল দেখতে পারি।
কখনো বিকেলে চটপটি খেতে নিয়ে যায় নদীর তীরে, কখনো রাতের খাবার নিয়ে আসে বাইরে থেকে, মোম জ্বেলে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হয়, মৃদু গানের তালে নাচ হয়, প্রথম দিকে নাচতে না পারলেও আজকাল পারি।
সব ছুটিতে ঘুরতে নিয়ে যায় কোথাও না কোথাও।
একদিনের ছুটি পেলে ঘরে থাকে- রান্নায় হেল্প করে, তিন চারবার আমার কাপড়ে ময়লা লাগাবে, চেঞ্জ করতে বলবে। নিজে থেকে বলে দিবে কোন শাড়িটা পড়বো।
চুলে তেল দিয়ে দিবে, বেনী করে দিবে যত্ন করে-
কখনো তোদের কথা মনে হয়ে চোখ ভিজে এলে জড়িয়ে রাখে বুকে। নরম করে হাত বুলিয়ে দেয় বাবার মতো করে, মায়ের মতো অভিযোগ করে, তোর মতো কৌতুকে হাসায়, খুনশুটিতে রাগায়-
কখনো তোদের জন্য খুব করে কান্না পেলে মাথা টেনে নেয় কোলে, সত্য মিথ্যে ভরা আজগুবি সব গল্প শোনায়- আমি বুঝি সব মিথ্যে গল্প- তবু শুনি- শুনতে ভাল লাগে।
আমি একটা মানুষের মধ্যে আমার সবটা পরিবার খুজে পেয়েছি।
হ্যা – আমি ভুলে না গেলেও ভুলে গেছি তোদের-
স্বার্থ পর হয়েছি এই লোকের কাছ থেকে প্রতি মূহুর্তে পাওয়া ভালবাসার স্বার্থে।
সাজিদ স্পস্ট্য শুনতে পাচ্ছে প্রতিটি শব্দ।
না দেখেও দেখতে পাচ্ছে বোনের দুই চোখের উজ্জলতা-
কলটা এখনো কাটেনি, ওপাশ থেকে হয়ত মিলি কিছু বলে যাচ্ছে, কিন্তু এখন আর কোন কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না, বলতে ইচ্ছে করছে না।
মিলি বলতো, বেটা ছেলেদের কাঁদতে নেই। কিন্তু এখন যে কিছুক্ষণ ভিষন ভাবে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
ফোনটা রেখে দিয়ে খেয়াল হলো-
টি শার্টের বুকটা ভিজেছে চোখের জলে-
বোনের নিত্য সুখের গল্প শুনতে শুনতে সেই কখন থেকেই যেন অশ্রু ঝড়ছে টের পায়নি একটুও।
আপনজনদের এমন স্বার্থপরতার আসল অনুভুতি, কান্নায় সাথেই বেশ মজার হবে হয়ত।
-০-
ছবিঃ নেট থেকে।
২৯টি মন্তব্য
রেহানা বীথি
মমতার বন্ধন। যদি পাওয়া যায় এমন মমতার হাত কিছুটা স্বার্থপর হওয়াই যায় বোধহয়।
খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা।
এস.জেড বাবু
শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় আপু
ভাল লাগলো জেনে অনুপ্রানিত
শুভেচ্ছা
কামাল উদ্দিন
এতো সুখ এক মানুষের জীবনে সওয়া কঠিন, তবে আমরা প্রত্যেকটা মানুষ সত্যিই স্বার্থপর হয়ে যাই সংসারের যাতাকলে পড়ে। নিজের সংসারটা আগে ঘুচিয়ে পরে ভাই বোনদের খবর নেই।
এস.জেড বাবু
তেমন কারণে বোন স্বার্থপর হলে ভাই হিসেবে খুশি হওয়া উচিত মনে হয়।
ধন্যবাদ প্রিয় ভাইজান
কামাল উদ্দিন
হুমম
সুরাইয়া পারভিন
ভাইয়ের ভালোবাসার মিষ্টি অভিযোগ বোনের প্রতি। বোনও শান্ত গলায় বলে চললো তার তার স্বার্থপরতার গল্প। সত্যিই অসাধারণ লিখেছেন ভাইয়া।
এস.জেড বাবু
প্রতিটা বোন এমন স্বার্থপর হওয়া উচিত।
আর ভাইদের অভিযোগ তো থাকবেই। এটা উত্তোরাধিকার।
ধন্যবাদ আপু
সকালের শুভেচ্ছা
তৌহিদ
ভাই বোনের সম্পর্ক চিরকালই যেন অমৃত। এই ভালোবাসাবাসি আবার এই নোনাজলের মিশ্রনে এ সম্পর্ক সত্যিই মধুর।
একসময় বোন পরের ঘরে চলে যায়য়, তখন হয়তো সম্পর্ক ফিকে হয়ে আসে তবে বন্ধনটি কিন্তু মলিন হয়না। আবেগটা থেকেই যায়।
বোনের মাঝেই ভাইয়েরা মায়ের ছায়া খোঁজে সবসময়। নারী প্রকৃতিগতভাবেই পরম মমতাময়ী। স্বামী সন্তানের সাথে হয়তো নিজের জীবন জড়িয়ে যায় তবুও ভাইবোন তাদের জায়গায় এক অনাবিল সম্পর্কে সদা জাগ্রত থাকে। অভিমানের কিছু নেই ভাই।
দারুন একটি লেখা পড়লাম। ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য ভাই।
এস.জেড বাবু
চমৎকার হৃদয়গ্রাহী সত্য বলেছেন।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা সহ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভালো থাকবেন ভাই
নৃ মাসুদ রানা
আমার পোড়া করাল, বৌয়ের ঘুম ভাঙ্গে নটায়।
করাল>>কপাল হবে বোধহয়।
এস.জেড বাবু
দারুন উপকার হয়েছে।
ঠিক করে দিয়েছি ভাইজান।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
নুর হোসেন
ভাই বোনের সম্পর্ক জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক,
মান-অভিমান যাই থাকুক কেউ কাউকো ভুলে থাকেনা।
চমৎকার লিখেছেন।
মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল…
এস.জেড বাবু
ঠিক বলেছেন।
ভুলে থাকার ভান করলেও সত্যি ভুলে থাকা যায়না।
অভিমান তো থাকবেই,
অভিমান অধিকারের অংশ।
অনেক কৃতজ্ঞতা ভাইজান।
ভাল থাকবেন।
নুর হোসেন
শুভ কামনা রইলো, ভালবাসা নিবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
দারুন অনুভুতিশীল একদম পরিবারের ঘটে যাওয়া ভাইবোনের কাহিনি তুলে ধরেছেন।
এই মান অভিমানেই লুকিয়ে থাকে শৌশব কিশোর সময়।
আর! ঘরে বাহিরের ভালবাসার অনুভুতি। যা পরিবারকে করে অটুট বন্ধন।
এস.জেড বাবু
শুভেচ্ছা মজিবর ভালই।
আপনাদের দোয়া ও অনুপ্রেরনা।
কৃতজ্ঞতা অশেষ
মোঃ মজিবর রহমান
বন্ধন।
রুমন আশরাফ
আমার আপন কোনও বোন নেই। এই কষ্টটা আজীবন রয়েই গেলো।
এস.জেড বাবু
সমব্যাথি ভাই,
তবে দোয়া করি ভাবির একটা মিষ্টি বোন থাকবে, আপনি তাকে বোনের মতো বানিয়ে নিবেন।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।
জিসান শা ইকরাম
বোন এত ভালো থাকলে আবেগে কান্না চলে আসবেই ভাইয়ের।
একজন মানুষের মাঝে পরিবারের সবাইকে পাওয়া অত্যন্ত খুশীর,
সব বোনরা যেন এমন স্বার্থপর হয়।
ভালো লেগেছে লেখা।
শুভ কামনা।
এস.জেড বাবু
সত্যি বলেছেন। আমিও তেমনটা ভাবি।
অভিমান মনে রেখেও বোনের সুখে কান্না আসে।
অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো ভাইজান
ছাইরাছ হেলাল
লেখাটি পড়তে পড়তে এটিকে শুধুই লেখা মনে হলো না,
লেখা থেকে উঠে আসা জীবন্ত জীবনের মায়াময় পাওয়া, শুধুই পাওয়া, না-পাওয়াদের হারিয়ে
শুধুই নিজেকে নিজে ছুঁয়ে যাওয়া, বারে বারে অনেক বার।
আসলে এ লেখায় মন্তব্য হয় না, মন্তব্য করা যায় না।
অক্ষমতা জানান দিচ্ছি, সত্যি সত্যি-ই।
এস.জেড বাবু
এমন একটা মন্তব্যের কি প্রতিউত্তর করা যায় !
আমিও অক্ষম সত্যি।
চির কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলাম ভাইজান।
আজকে দোয়া চাইবো-
দোয়া করবেন।
সুপায়ন বড়ুয়া
বোনেরা এমন স্বার্থপর হয়
ভাইয়েরা ও কিন্তু কম নয় !
ভালই লাগলো শুভ কামনা !
এস.জেড বাবু
এটাও সত্যি-
অন্য এক গল্পে ভাইয়ের সুখে বোনের চোখেও জল দেখতে হবে।
ইচ্ছে রইলো।
কৃতজ্ঞতা শ্রদ্ধেয় ভাইজান
মনির হোসেন মমি
ভাইবোনের খূনসুটি সব সময় থাকে কিন্তু ভালবাসার আবেগ কখনো কখনো এক হয় না।স্বার্থপর হলেও এ ক্ষেত্রে ঠিকই যেন মনে হল। ভাল লিখেছেন ভাইয়া।
এস.জেড বাবু
আপনাদের অনুপ্রেরনা ভাইজান।
সোনেলায় অনেক অনুপ্রানিত করেন আপনারা কয়জন।
সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
আপনার জন্য শুভকামনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
এটা শুধু লেখা নয়!
সে তো ভাইয়ের প্রতি বোনের স্নেহমমতা।
বেশ ভালো লাগলো দাদা।
এস.জেড বাবু
একরাশি কৃতজ্ঞতা প্রদীপ দা
অনেক খুশি হলাম
শুভেচ্ছা অশেষ।