রাম্বা কোনো কথা না বলে দৌড়ে গিয়ে চিতায় ঝাপ দেয়। মৃদঙ্গে ডঙ্কার তাণ্ডব বাজে, ডোম নারীরা উলুধ্বনি করে। প্রলয়ের মাতম ওঠে, ‘হরি বোল, বোল হরি… হরি নাম সত্য।’ চিৎকার করে রাম্বা। দাউ দাউ করে জ্বলে রাম্বার বসন। আগুনের তোড়ে নারাছু ডোমের হাত পা উঠে যায়। রমেশ চণ্ডাল আর শ্মশান বন্ধুরা ‘হরি বোল’ বলে হাত পায়ের সন্ধিগুলোতে বাঁশ দিয়ে বারি মেরে ভেঙ্গে দেয়। ঠাস ঠাস করে পুড়তে থাকে ভাঙ্গা হাত পায়ের সন্ধি। রাম্বা বিভৎস চিৎকার করে। ভষ্ম হয়ে যায় তার পার্থিব বসন। শরীরের প্রাকৃতিক আদিম বসন চামড়া চির চির করে জ্বলে জ্বলে খুলে পড়ে মাংসের আবরণ থেকে। রাম্বা চিতা থেকে বের হয়ে আসতে চায়। শ্রীপদ চিৎকার করে বলে, ‘বাঁশ দেকে ঠাসকে ধর সবকই।’
শ্মশান বন্ধুরা পূণ্যির কথা ভেবে মহা উৎসাহে বাঁশ দিয়ে চারিদিক থেকে রাম্বার জীবিত পোড়া দেহ ঠেসে ধরতে থাকে। কেউ কেউ বাঁশ দিয়ে সুকৌশলে প্রহার করতে থাকে। রাম্বা একবার সুযোগ পেয়ে দৌড়ে চিতা থেকে বের হয়ে আসে। তার সারা শরীরের চামড়া খুলে ঝুলে পড়েছে পোড়া বেগুনের মতো। চামড়ার নীচে দগদগে লাল পোড়া মাংস। সেখান থেকে হলুদ চর্বির গলিত অংশ গড়িয়ে পড়ে। চোখের ভ্রূ, মাথার চুল কিছু নেই। চুল পোড়া তীব্র চিমসা গন্ধ। রাম্বার সুউত্তল নিতম্ব, সুডৌল স্তন, ফিমার এবং টিবিয়া ফিব্যুলা বের হওয়া জংঘের মাঝে ত্রিভুজ মাছআলু পোড়া যৌনাঙ্গ। সে যৌনাঙ্গ কুমার পালের সুনিপূণ হস্তে গড়া প্রথম লেপনের পূর্বে ফেটে চৌচির হওয়া প্রতিমা সদৃশ্য মনে হয়। সবাই দূর থেকে ঘি আর ধূপ ছুড়ে মারে রাম্বার ঝলসানো শরীরে। সব পুড়ে ঝলসানো রাম্বা শ্রীপদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়। রাম্বার চোয়ালের একপাশে মাংস খুলে পড়ে দাঁতের পাটি বের হয়ে যাওয়ায় তার অনুনয় স্পষ্ট হয় না। গালের ফাঁক দিয়ে কথা ফসকে যায়। শ্রীপদ সহ্য করতে না পেরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ডোমপাড়ার নারীরা নীরবে ঘোমটার ফাঁকে চোখ মোছে। উলুধ্বনি দেয় আর ফুলের পাঁপড়ি ছুড়তে থাকে রাম্বার শরীরে। শ্রীপদ চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘অকরেকে ধরকে চিতামে লেকে বিক। তাড়াতাড়ি জ্বলাও অকারকে। অভি কিন্তু সতীদাহের নিয়ম নেইখে। থানা-পুলিশকে ঝামেলা হই।’
একথা শোনার সাথে সাথে সাথে রমেশ চণ্ডালসহ কয়েকজন শ্মশানবন্ধু এসে জোর করে রাম্বাকে টেনে হেচড়ে নিয়ে গিয়ে চিতায় ছুঁড়ে মারে। চিতায় অনবরত ঢালা হয় ঘি, ছিটিয়ে দেওয়া হয় ধূপ। রাম্বা চিৎকার করে। কিছুক্ষণ পর রাম্বা শরীর বাঁক দিয়ে ধপাস করে চিতায় পড়ে যায়। চিৎকার থেমে যায় রাম্বার। রমেশ চণ্ডাল আর শ্মশানবন্ধুরা তুলো ধুনোর মতো বাঁশ দিয়ে আঘাত করতে থাকে ভষ্মপ্রায় রাম্বার শরীরে। আগুনের লেলিহান শিখা আর শবযাত্রার শ্মশানবন্ধুদের প্রহারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাম্বার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শরীরের শিরা-উপশিরা ও নাভিমূল পোড়ানোর সামর্থ্য পৃথিবীর কোনো আগুনের নেই। শিরা-উপশিরাগুলোর বাহন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিনষ্ট হওয়ায় সেগুলো কুঞ্চিত হয়ে শরীরের মূলকেন্দ্র নাভিমূলে জমা হতে থাকে। ঘি আর আগুনের দাপটে ক্ষণেকের মধ্যেই ভষ্ম হয়ে যায় নারাছু ডোম, রাম্বার মরদেহ। শুধু টিকে থাকে শিরা-উপশিরা সমেত দু’টি গোলাকার নাভিমূল যাকে বলে পিণ্ডি। জল দিয়ে চিতা নেভানোর পর চিতার ছাই ফেলা হয় নদীর জলে। যমুনা জলের ঘূর্ণিতে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় চিতা ভষ্ম। দু’টি ঘটের মধ্যে দুই পিণ্ডি আর কিছু ছাই তুলে লাল কাপড়ে মুখ বাঁধে রমেশ চণ্ডাল। তারপর ঘট দুটো তুলে দেয় শ্রীপদের হাতে। সনাতন ধর্ম মতে এই পিণ্ডি তীর্থস্থান গয়াতে গিয়ে গঙ্গা জলে বিসর্জন না দেওয়া অবধি আত্মা পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারে না। এই পিণ্ডিদান সৎকারের শেষকৃত্য। রমেশ চণ্ডালের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে শ্রীপদ অকস্মাৎ হাউমাউ করে কাঁদে। রমেশ তাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়। রামু দৌড়ে এসে শ্রীপদের হাতে মদের বোতল তুলে দেয়। বোতলের মুখ খুলে শ্রীপদ বেহুশের মতো বোতল টানে আর চিৎকার করে কাঁদে।
শেষ রাত প্রায়। শ্রীপদ, ডোমপাড়ার নরনারী, শ্মশানবন্ধু সবাই ক্লান্ত-ভগ্ন দেহ নিয়ে ঘরের টানে ছুটে চলে। মৃত আত্মাদের সাথে রমেশ চণ্ডাল শ্মশানে দাঁড়িয়ে থাকে একা। সবাই দূরে চলে গেলে রমেশ একটা গাঁজার স্টিক ধরায় তারপর পাকুড় গাছটির ডানে তার ছোট্ট উঠান ঘেরা নিঃসঙ্গ শনের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তখন রাত পেরিয়ে ভোরের বাতাস বইতে শুরু করেছে।
(………………………………………………………………………………..চলবে)
আগের পর্বের লিংকগুলো:
১. http://sonelablog.com/archives/12440
২. http://sonelablog.com/archives/12475
৩. http://sonelablog.com/archives/12531
৪. http://sonelablog.com/archives/12788
৫. http://sonelablog.com/archives/12859
৬. http://sonelablog.com/archives/12944
৭. http://sonelablog.com/archives/13003
৮. http://sonelablog.com/archives/13126
৯. http://sonelablog.com/archives/13269
১০. http://sonelablog.com/archives/13617
১১. http://sonelablog.com/archives/14926
১২. http://sonelablog.com/archives/17125
১৩. http://sonelablog.com/archives/17164
১৪. http://sonelablog.com/archives/17210
১৫. http://sonelablog.com/archives/17308
১৬. http://sonelablog.com/archives/17837
১৭. http://sonelablog.com/archives/17968
১৮. http://sonelablog.com/archives/18263
১৯. http://sonelablog.com/archives/18396
২০. http://sonelablog.com/archives/18643
২১. http://sonelablog.com/archives/19993
২২. http://sonelablog.com/archives/20171
২৩. http://sonelablog.com/archives/20560
৮টি মন্তব্য
খসড়া
চলুক
সাতকাহন
ধন্যবাদ, খসড়া।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
চলুক সাথে থাকব ——- পূর্বের সব পর্ব সময় করে পড়ে নেব ভাইয়া ——- ।। :Delighted:
সাতকাহন
সাথে থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
আপনাকে অনেক কঠিন নার্ভের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
সতীদাহ প্রথার সময় নয়, তবুও এমন করলো? 🙁
সাতকাহন
ধন্যবাদ, শুন্য।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
চলতে থাকুক ভাল লাগার গল্প।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, মনির।