সুখের অন্বেষণে

রিমি রুম্মান ৯ নভেম্বর ২০১৪, রবিবার, ১০:১২:৫৭পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৯ মন্তব্য

নয়’য়ের দশকের শেষের দিকে আঙ্কেল এর সাথে আমার পরিচয়। তিনি এদেশে এসেছেন অনেক আগে তরুন বয়সে, সুন্দর জীবনের অন্বেষণে। দেশে স্ত্রী আর ফুটফুটে দু’টি জমজ কন্যা। ” একটু গুছিয়েই দেশে ফিরে যাবো”__ করতে করতেই অনেকগুলো বছর হারায় জীবন থেকে। কন্যাদ্বয় বড় হতে থাকে… খরচ বাড়তে থাকে… বাড়তে থাকে পিতার দায়িত্বও। কাগজ-পত্র নেই, বিধায় ভাল জবও নেই। কিছুদিন এই জব তো কিছুদিন অন্য জব। সংগ্রাম করে টিকে থাকা এক পিতা। তবুও পিতার দায়িত্ব শেষ না করে ফিরে যাবার নয়। অক্ষমতার কাছে মাথা নোয়াবার নয়…

সহসাই একবার দেখা হয় আমাদের। বললেন, ” দুইটা ডাক্তার কন্যার বাবা আমি, বুঝলি ?” বুকভরা গর্ব আর চোখে মুখে তার ক্যামন যেন এক সুখের দৃপ্তি খেলে গেলো__ কোন শব্দচয়ন কিংবা শব্দের মাধুর্য দিয়ে তা বুঝাবার ক্ষমতা নেই আমার। শুধু বলি, আঙ্কেল, ওদের কাছে ফিরে যান। আঙ্কেল বলেন, ” মেয়েদের বিয়ে দিতেও তো টাকা লাগবে। আমার তো সঞ্চয় কিছু নেই। বিয়েটা সেরে ফেললে আর পিছুটান থাকবেনা।” বুঝি যে, বাইরে থেকে আমরা যা-ই বলি না কেনো… বাস্তবতা গল্পের মত কিংবা স্বপ্নের মত সুন্দর নয়। অনেক কঠিন, নির্মম।

এরপর জানলাম মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়েছে। আমি যারপরনাই খুশী হলাম। এবার নিশ্চয় তিনি ফিরে যাবেন পরিবারের কাছে। সেই ছোট্ট পরী দু’টি তো আর ছোট্টটি নেই। দুর্দান্ত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে না হয়তো। তবে বাবার শিয়রে বসে অসীম ভালোবাসায় হাতখানি তো অন্তত কপালে, মাথায় বুলিয়ে দিবে। যে হাতগুলোর পরশ সেই কঠোর সংগ্রামী পিতার এতোকালের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবে… সব… সব…

আজ আঙ্কেলের কর্মস্থল সেই গ্রোসারী স্টোরে বাজার করতে গিয়ে জানলাম উনি হাসপাতালে। ব্রেইনস্ট্রোক করেছেন তিন সপ্তাহ আগে। সহকর্মীদের কাছ থেকে রুম নাম্বার চেয়ে নিলাম। সব ব্যস্ততাকে পিছু ঠেলে ছুটলাম…আমি ছুটলাম তাকে দেখতে, যিনি প্রায়ই বলতেন__ তোকে দেখলে মেয়ে দু’টির কথা মনে পড়ে… দু’দণ্ড শান্তি পাই মনে…

হাসপাতালে রুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে থম্‌কে যাই। বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এক একটি যন্ত্র। জীর্ণ-শীর্ণ নিথর দেহখানা আমার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেয়। কাছে, খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বৃদ্ধের মুখের অবয়বে আমি আমার বাবার ছবি দেখতে পাই। ক্ষণিক আবেগাপ্লুত নত হয়ে থাকি। ভেতরের সবটুকু শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেই। কানের কাছে গিয়ে বলি, “আঙ্কেল, আমি রিমি।” তিনি নিস্প্রভ, নিস্তেজ। কন্যাসম আমি অজানা এক অভিমানে একাকী আনমনে বলে উঠি, “এতোদিনে গুছানো হলো বুঝি !”

বাইরে ঝক্‌ঝকে রোদ। আমি মিশে যাই এই শহরের ব্যস্ত মানুষজনের ভীড়ে… কোলাহলে…

৮৩৬জন ৮৩৬জন
0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ