নয়’য়ের দশকের শেষের দিকে আঙ্কেল এর সাথে আমার পরিচয়। তিনি এদেশে এসেছেন অনেক আগে তরুন বয়সে, সুন্দর জীবনের অন্বেষণে। দেশে স্ত্রী আর ফুটফুটে দু’টি জমজ কন্যা। ” একটু গুছিয়েই দেশে ফিরে যাবো”__ করতে করতেই অনেকগুলো বছর হারায় জীবন থেকে। কন্যাদ্বয় বড় হতে থাকে… খরচ বাড়তে থাকে… বাড়তে থাকে পিতার দায়িত্বও। কাগজ-পত্র নেই, বিধায় ভাল জবও নেই। কিছুদিন এই জব তো কিছুদিন অন্য জব। সংগ্রাম করে টিকে থাকা এক পিতা। তবুও পিতার দায়িত্ব শেষ না করে ফিরে যাবার নয়। অক্ষমতার কাছে মাথা নোয়াবার নয়…
সহসাই একবার দেখা হয় আমাদের। বললেন, ” দুইটা ডাক্তার কন্যার বাবা আমি, বুঝলি ?” বুকভরা গর্ব আর চোখে মুখে তার ক্যামন যেন এক সুখের দৃপ্তি খেলে গেলো__ কোন শব্দচয়ন কিংবা শব্দের মাধুর্য দিয়ে তা বুঝাবার ক্ষমতা নেই আমার। শুধু বলি, আঙ্কেল, ওদের কাছে ফিরে যান। আঙ্কেল বলেন, ” মেয়েদের বিয়ে দিতেও তো টাকা লাগবে। আমার তো সঞ্চয় কিছু নেই। বিয়েটা সেরে ফেললে আর পিছুটান থাকবেনা।” বুঝি যে, বাইরে থেকে আমরা যা-ই বলি না কেনো… বাস্তবতা গল্পের মত কিংবা স্বপ্নের মত সুন্দর নয়। অনেক কঠিন, নির্মম।
এরপর জানলাম মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়েছে। আমি যারপরনাই খুশী হলাম। এবার নিশ্চয় তিনি ফিরে যাবেন পরিবারের কাছে। সেই ছোট্ট পরী দু’টি তো আর ছোট্টটি নেই। দুর্দান্ত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে না হয়তো। তবে বাবার শিয়রে বসে অসীম ভালোবাসায় হাতখানি তো অন্তত কপালে, মাথায় বুলিয়ে দিবে। যে হাতগুলোর পরশ সেই কঠোর সংগ্রামী পিতার এতোকালের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবে… সব… সব…
আজ আঙ্কেলের কর্মস্থল সেই গ্রোসারী স্টোরে বাজার করতে গিয়ে জানলাম উনি হাসপাতালে। ব্রেইনস্ট্রোক করেছেন তিন সপ্তাহ আগে। সহকর্মীদের কাছ থেকে রুম নাম্বার চেয়ে নিলাম। সব ব্যস্ততাকে পিছু ঠেলে ছুটলাম…আমি ছুটলাম তাকে দেখতে, যিনি প্রায়ই বলতেন__ তোকে দেখলে মেয়ে দু’টির কথা মনে পড়ে… দু’দণ্ড শান্তি পাই মনে…
হাসপাতালে রুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে থম্কে যাই। বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এক একটি যন্ত্র। জীর্ণ-শীর্ণ নিথর দেহখানা আমার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেয়। কাছে, খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বৃদ্ধের মুখের অবয়বে আমি আমার বাবার ছবি দেখতে পাই। ক্ষণিক আবেগাপ্লুত নত হয়ে থাকি। ভেতরের সবটুকু শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেই। কানের কাছে গিয়ে বলি, “আঙ্কেল, আমি রিমি।” তিনি নিস্প্রভ, নিস্তেজ। কন্যাসম আমি অজানা এক অভিমানে একাকী আনমনে বলে উঠি, “এতোদিনে গুছানো হলো বুঝি !”
বাইরে ঝক্ঝকে রোদ। আমি মিশে যাই এই শহরের ব্যস্ত মানুষজনের ভীড়ে… কোলাহলে…
১৯টি মন্তব্য
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
উজ্জ্বলতার আড়ালে থাকে অনেক ত্যাগ অনেক কষ্ট।
রিমি রুম্মান
ঠিকই বলেছেন। কারো জীবন সুন্দর হয়ে উঠার পেছনে কারো নির্মম ত্যাগ থাকে। ভালো থাকুন।
সঞ্জয় কুমার
জিবনের হিসাব বড়ই গোলমেলে ।
মধ্যবিত্তের জীবন যাপন তুলে ধরেছেন । ভাল লাগল ।
রিমি রুম্মান
ধন্যবাদ আপনাকে, সময় করে পড়েছেন বলে। এটি আমার দেখা ছোট্ট একটি ঘটনা, যা বলতে গেলে পুরো একটি জীবনেরই গল্প।
নুসরাত মৌরিন
একজন বাবা তার সবটুকু ঢেলে দিয়ে গোছাতে চান সন্তানের জীবন,প্রায়ই হয়ত নিজের জীবনটার সুখ গুলো তাদের হাত ফসকে যায়।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আপু।
ওই আঙ্কেলের জন্য শুভাশিষ রইলো।
রিমি রুম্মান
বিদেশে এইসব বাবা’রা যে সীমাহীন কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করে টিকে থাকেন, এটা দেশে থাকলে এমন করে জানা হতো না।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এটাই বাস্তবতা।জীবনের শেষ বেলাও যাদের কর্তব্যের চিন্তা এখানেই মমতা এখানেই ভালবাসা।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। অনেক শুভকামনা রইল। ভাল থাকুন সবসময়।
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
আপু, চোখের কোনে পানি চলে এলো। জীবন কি একেই বলে?
রিমি রুম্মান
এক একটি জীবন, জীবনের গল্প দেখি খুব কাছ থেকে। সেগুলোই সবার সাথে লিখে শেয়ার করি। ভাল থাকুন।
সায়ন্তনু
এত ত্যাগ! ভাবলে কষ্ট লাগে।
রিমি রুম্মান
বাবা’দের ত্যাগ চোখে দেখা যায় না। এখানে না এলে হয়তো আমারও এমন করে দেখা হতো না।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার দেখা ঘটনা গুলো জীবনের মর্মে স্পর্শ করে।
ভাতেও কষ্ট লাগে………………………………
রিমি রুম্মান
সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখাগুলো এমনই হয়। নির্মম, নিষ্ঠুর। গল্প হলে সুন্দর একটা সমাপ্তি দেয়া যেতো।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার বর্ণনা সুন্দর লাগে।
সবাই দেখে কিন্তু সবাই লিখতে পারেনা।
রিমি রুম্মান
আবার সবাই আপনার মত করে গভীরে গিয়ে পড়তেও পারে না। অনেক ধন্যবাদ ।
মোঃ মজিবর রহমান
পড়ে জানার চেস্টা করি মাত্র।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
এমন লেখায় আসলে মন্তব্য করা কঠিন।
খারাপ লাগছে তাঁর জন্য।
রিমি রুম্মান
এমন আংকেল এই প্রবাসে অনেক আছে। যারা তাদের ছোট্ট সন্তানদের দেশে রেখে এসেছেন জীবন সুন্দর করবেন বলে। জীবন সুন্দর হয় যদিও অনেকগুলো মানুষের, কিন্তু বিনিময়ে একজনের জীবন নির্দয়ভাবে সমাপ্তির দিকে এগোয়…