সাঁঝবাতির কাছে চিঠি

নীলাঞ্জনা নীলা ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১১:৩১:২১পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৮ মন্তব্য
সাঁঝের আকাশে চাঁদের বাতি...
সাঁঝের আকাশে চাঁদের বাতি…


প্রিয় সাঁঝবাতি,

কেমন আছিস? চোখের তীর ঘেষে কাজলের ওই রেখা এখনও কি আছে? নাকি চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে? কতো কতো দিন-মাস-বছর পার হয়েছে, ভুলেই গেছি। প্রায় দুই যুগ, নাকি! যে আমরা মানে আমি-তুমি নই, সেই আমরাই এখন দুজন থেকে বহুজন। দুজনকে ছাড়া চলতে তো শিখেছি-ই, এমনকি বেঁচেও আছি। একসময় মনে হতো আমরা কখনোই আলাদা দুজনে পরিণত হবো না। আসলে সময় মানুষকে সেভাবেই বাঁচিয়ে রাখে, যেভাবে তার বেঁচে থাকার কথা। সাঁঝ আমায় কি তোর মনে পড়ে কখনো? প্রশ্নটা করা ঠিক হলোনা। তুই তো জানিস বেঠিক কাজই করি আমি বেশী!

আর মাত্র তিনদিন পর বইমেলা। মনে আছে সেই সময়কার কথাগুলো? কি যে অস্থির হয়ে পড়তি বইমেলাতে যাবার জন্যে। তোর ব্যস্ততা দেখে মনে হতো কোনো এক নামকরা লেখিকা তুই, যেনো অটোগ্রাফ নেয়ার অপেক্ষায় বসে আছে পাঠককূল। তোকে ক্ষ্যাপাতাম, ও লেখিকা তোর লেখা আমি ছাড়া আর কেউ কি পড়ে? আমি অবাক হতাম কখনোই তুই রেগে যাসনি। হেসে বলতি ‘প্রকৃতি তুই পড়িস বলেই তো লিখি রে। আর তোকে খুশী করতেই পত্রিকায় পাঠাই।’ সুপারফ্লপ হয়ে যেতো আমার ক্ষ্যাপানোটা। তারপর খুব সাধারণ পাটভাঙ্গা শাড়ী পড়ে, এলোখোপায় বেলীর মালা প্যাঁচিয়ে বেড়িয়ে পড়া বাসা থেকে। রিক্সায় উঠে তোর সেই যে বলে ওঠা, ‘এই দেখ দেখ টিপটা ঠিকমতো পড়েছি তো!’ টিপ আর কাজল ছাড়া তোকে একটুকুও মানায় না। কেমন জানি বৈধব্যবেশ। আর তোর সেই পাগলামো আজও একা একা ভেবে হাসি।

বহুবার তোকে বলেছি একটা বই বের কর। কি সুন্দর লিখিস তুই! প্রেম আর প্রকৃতি এক হয়ে যায়। শেক্সপিয়রের ওই যে নাটকটা As you Like It পড়েছিলাম, শহরের জটিল-কুটিল মানুষ যখনই আর্ডেনের জঙ্গলে চলে যেতো, একেবারে সহজ-সরল সাধারণ মানুষে পরিণত হতো। তোর লেখায় সেই সহজ-সাধারণ রূপের দেখা পাওয়া যায়। তখন অতো সহজ ছিলো না বই প্রকাশ করা। আজকাল তো লেখক হতে চাইলেই খুব সহজেই লেখক হয়ে যাওয়া যায়। আর যদি টাকা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। যতোটা খুশী বই বের করাও যায়। তবে এখনও বেশ কিছু লেখক-কবি আছেন, পড়লে মন ভরে যায়। প্রতিবার বইমেলা আসে-যায়, আমি খবর নেই আমার সাঁঝের কোনো বই কি প্রকাশিত হলো? নিজে তো আর যেতে পারিনা, তূণীরকে বলি খবর নিতে। তূণীর-ই তো আমাকে তোর ঠিকানা সংগ্রহ করে দিলো। এই শোন, আমাদের যে এক সিনিয়র আপু ছিলো, যার লেখা পড়লে হাসি চাপিয়ে রাখা যেতোনা। বুঝেছিস কার কথা বলছি? ওই যে তনিমা আপু। এখন উনার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ না ছয় জানি! অবশ্য তোকে এসব কথা শুনিয়ে কি লাভ! তুই তো ‘অহিংসা পরম ধর্ম’—এ নীতিতে বিশ্বাসী।

সাঁঝ আমার কথা কি আর বলবো বল! শুধু জেনে রাখ তোর প্রকৃতি বদলে গেছে। তার সেই সবুজ-সরলতা আর নেই। তুই চলে গেলি, অমনি সবকিছু ফ্যাঁকাসে। বইমেলা আসে-যায়, আমার আর যাওয়া হয়না। কিন্তু এবার যাবো। নিজেকে খুঁজে নিতে আমাকে যেতেই হবে। তূণীরের কাছেই শুনলাম খবরটা। তোর নাকি বই বের হচ্ছে। প্লিজ তূণীরকে বকিস না, ও আমাকে বলেনি। তুই যেভাবে ওকে শিখিয়ে দিয়েছিলি, ঠিক সেভাবেই আমায় ফোন করলো। তারপর বললো, ‘সাঁঝ দেশের বাইরে থাকে, তাই আসেনা। তুই কেন আসবি না বইমেলায়? এবারে আয়।’ তূণীরের কন্ঠস্বর শুনেই কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিলো। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করলাম, ওই ফাঁকেই বললাম সাঁঝের তো বই বের হচ্ছে। থতমত খেয়ে গেলো, ‘মানে! তুই জানিস!! কিভাবে?’ বললাম সাঁঝ বলেছে। তোর দেয়া নাম্বার দেখেই তো আমি ফোন দিলাম, তখনই বললো।

সাঁঝ বহুদিন পর এতো আনন্দ পেলাম। অবাক কান্ড দেখ, আবার তুই-ই আমার আনন্দ হয়ে এলি! বহুভাবেই তো হেসেছি, আনন্দ করেছি। তবুও ওর মধ্যে একটা অপরিপূর্ণতা ছিলো। আসলে আমাদের দুজনের পূর্ণতা আমরাই, আর কেউ ছিলোনা, নেইও, কেউ হবেও না। কথাটা প্রমাণিত হয়ে গেলো দেখলি! আজ এটুকুই। ভালো থাকিস আমার সাঁঝ, সকলের সাঁঝবাতি।

ইতি, 
তোর কৃতি, সকলের প্রকৃতি।

হ্যামিল্টন, কানাডা
২৮ জানুয়ারী, ২০১৭ ইং।

৭৫০৭জন ৭৫০৬জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ