প্রিয় সাঁঝবাতি,
কেমন আছিস? চোখের তীর ঘেষে কাজলের ওই রেখা এখনও কি আছে? নাকি চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে? কতো কতো দিন-মাস-বছর পার হয়েছে, ভুলেই গেছি। প্রায় দুই যুগ, নাকি! যে আমরা মানে আমি-তুমি নই, সেই আমরাই এখন দুজন থেকে বহুজন। দুজনকে ছাড়া চলতে তো শিখেছি-ই, এমনকি বেঁচেও আছি। একসময় মনে হতো আমরা কখনোই আলাদা দুজনে পরিণত হবো না। আসলে সময় মানুষকে সেভাবেই বাঁচিয়ে রাখে, যেভাবে তার বেঁচে থাকার কথা। সাঁঝ আমায় কি তোর মনে পড়ে কখনো? প্রশ্নটা করা ঠিক হলোনা। তুই তো জানিস বেঠিক কাজই করি আমি বেশী!
আর মাত্র তিনদিন পর বইমেলা। মনে আছে সেই সময়কার কথাগুলো? কি যে অস্থির হয়ে পড়তি বইমেলাতে যাবার জন্যে। তোর ব্যস্ততা দেখে মনে হতো কোনো এক নামকরা লেখিকা তুই, যেনো অটোগ্রাফ নেয়ার অপেক্ষায় বসে আছে পাঠককূল। তোকে ক্ষ্যাপাতাম, ও লেখিকা তোর লেখা আমি ছাড়া আর কেউ কি পড়ে? আমি অবাক হতাম কখনোই তুই রেগে যাসনি। হেসে বলতি ‘প্রকৃতি তুই পড়িস বলেই তো লিখি রে। আর তোকে খুশী করতেই পত্রিকায় পাঠাই।’ সুপারফ্লপ হয়ে যেতো আমার ক্ষ্যাপানোটা। তারপর খুব সাধারণ পাটভাঙ্গা শাড়ী পড়ে, এলোখোপায় বেলীর মালা প্যাঁচিয়ে বেড়িয়ে পড়া বাসা থেকে। রিক্সায় উঠে তোর সেই যে বলে ওঠা, ‘এই দেখ দেখ টিপটা ঠিকমতো পড়েছি তো!’ টিপ আর কাজল ছাড়া তোকে একটুকুও মানায় না। কেমন জানি বৈধব্যবেশ। আর তোর সেই পাগলামো আজও একা একা ভেবে হাসি।
বহুবার তোকে বলেছি একটা বই বের কর। কি সুন্দর লিখিস তুই! প্রেম আর প্রকৃতি এক হয়ে যায়। শেক্সপিয়রের ওই যে নাটকটা As you Like It পড়েছিলাম, শহরের জটিল-কুটিল মানুষ যখনই আর্ডেনের জঙ্গলে চলে যেতো, একেবারে সহজ-সরল সাধারণ মানুষে পরিণত হতো। তোর লেখায় সেই সহজ-সাধারণ রূপের দেখা পাওয়া যায়। তখন অতো সহজ ছিলো না বই প্রকাশ করা। আজকাল তো লেখক হতে চাইলেই খুব সহজেই লেখক হয়ে যাওয়া যায়। আর যদি টাকা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। যতোটা খুশী বই বের করাও যায়। তবে এখনও বেশ কিছু লেখক-কবি আছেন, পড়লে মন ভরে যায়। প্রতিবার বইমেলা আসে-যায়, আমি খবর নেই আমার সাঁঝের কোনো বই কি প্রকাশিত হলো? নিজে তো আর যেতে পারিনা, তূণীরকে বলি খবর নিতে। তূণীর-ই তো আমাকে তোর ঠিকানা সংগ্রহ করে দিলো। এই শোন, আমাদের যে এক সিনিয়র আপু ছিলো, যার লেখা পড়লে হাসি চাপিয়ে রাখা যেতোনা। বুঝেছিস কার কথা বলছি? ওই যে তনিমা আপু। এখন উনার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ না ছয় জানি! অবশ্য তোকে এসব কথা শুনিয়ে কি লাভ! তুই তো ‘অহিংসা পরম ধর্ম’—এ নীতিতে বিশ্বাসী।
সাঁঝ আমার কথা কি আর বলবো বল! শুধু জেনে রাখ তোর প্রকৃতি বদলে গেছে। তার সেই সবুজ-সরলতা আর নেই। তুই চলে গেলি, অমনি সবকিছু ফ্যাঁকাসে। বইমেলা আসে-যায়, আমার আর যাওয়া হয়না। কিন্তু এবার যাবো। নিজেকে খুঁজে নিতে আমাকে যেতেই হবে। তূণীরের কাছেই শুনলাম খবরটা। তোর নাকি বই বের হচ্ছে। প্লিজ তূণীরকে বকিস না, ও আমাকে বলেনি। তুই যেভাবে ওকে শিখিয়ে দিয়েছিলি, ঠিক সেভাবেই আমায় ফোন করলো। তারপর বললো, ‘সাঁঝ দেশের বাইরে থাকে, তাই আসেনা। তুই কেন আসবি না বইমেলায়? এবারে আয়।’ তূণীরের কন্ঠস্বর শুনেই কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিলো। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করলাম, ওই ফাঁকেই বললাম সাঁঝের তো বই বের হচ্ছে। থতমত খেয়ে গেলো, ‘মানে! তুই জানিস!! কিভাবে?’ বললাম সাঁঝ বলেছে। তোর দেয়া নাম্বার দেখেই তো আমি ফোন দিলাম, তখনই বললো।
সাঁঝ বহুদিন পর এতো আনন্দ পেলাম। অবাক কান্ড দেখ, আবার তুই-ই আমার আনন্দ হয়ে এলি! বহুভাবেই তো হেসেছি, আনন্দ করেছি। তবুও ওর মধ্যে একটা অপরিপূর্ণতা ছিলো। আসলে আমাদের দুজনের পূর্ণতা আমরাই, আর কেউ ছিলোনা, নেইও, কেউ হবেও না। কথাটা প্রমাণিত হয়ে গেলো দেখলি! আজ এটুকুই। ভালো থাকিস আমার সাঁঝ, সকলের সাঁঝবাতি।
ইতি,
তোর কৃতি, সকলের প্রকৃতি।
হ্যামিল্টন, কানাডা
২৮ জানুয়ারী, ২০১৭ ইং।
১৮টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
সকলের সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে দিলাম আপু।
ভাল থেক দোয়া কইর সবার জন্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
মজিবর ভাই বড়ো মমতামাখা মন্তব্য করলেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন অহর্নিশ।
ইঞ্জা
মন ছোঁয়া লেখা, খুব ভালো লাগলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
হ্যান্ডপাম্প ভাই বইমেলা এলেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পড়ে। সতেরো বছর হয়ে গেলো বইমেলায় যাওয়া হয়নি। 🙁
ইঞ্জা
মজার ব্যাপার হলো, আমি কখনোই যায়নি। 😀
নীলাঞ্জনা নীলা
বলেন কি!!!
হ্যান্ডপাম্প ভাই লেখালেখি করেন বলে বলছি না। একটিবার বইমেলায় যাবেন।
আপনার মতো মানুষের যাওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।
ছাইরাছ হেলাল
অদ্ভুত আপনার এই স্মৃতিচারণ।
সাঁজবাতীর মত আমরাও অনেক কিছুই হারাই।
বই মেলা সমাগত দ্বারে।
নীলাঞ্জনা নীলা
কুবিরাজ ভাই এবারের বইমেলাতেও যাওয়া হবেনা।
মনটা উদাস হয়ে যায় বইমেলা এলে। 🙁
ভালো থাকুন।
নিহারীকা জান্নাত
কি সুন্দর। এমন মিস করে আমাকে যদি কেউ লিখতো!!!
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি চিঠি লিখতে খুব ভালোবাসি।
চিঠি আমার প্রিয় বিষয়। 🙂
লিখবে কেউ না কেউ। আজকাল চিঠি কেউই লেখেনা। আমি আমার মেইল বক্সের নাম দিয়েছি বিলবক্স। 😀
নিহারীকা জান্নাত
ঠিক বলেছেন আপা। এখনতো এস এম এস আর ইমেইলের যুগ। কে আর কষ্ট করে চিঠি লিখে?
ইমেইলের নতুন নাম শুনে হেসেই মরে যাচ্ছি। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার নিজস্ব বেশ কিছু শব্দ আছে, বন্ধুরা হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যায়। মেলবক্সে চিঠি আসেনা, সব বিলের খাম। তো কি বলবো বলুন! 😀
আবু খায়ের আনিছ
এমন চিঠি একবার পড়লে বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।
বই মেলায় আমন্ত্রণ।
নীলাঞ্জনা নীলা
আনিছ ভাইয়া দেশে থাকলে বইমেলায় যাওয়া আটকে রাখতে পারতো না কেউ।
বইমেলা আমার কাছে চুম্বকক্ষেত্র।
ভালো থাকুন।
মিষ্টি জিন
এই নীলাপু তুমি আবার কোন তুই নিয়ে পডলে ? এ আমার তুই নাতো আবার :p
অনেকদিন যাবত আমার তুইকে খুজে পাচ্ছি না। 🙁
ইস এমন করে যদি কেউ আমায় লিখতো…
নীলাঞ্জনা নীলা
মিষ্টি আপু তোমার তুইকে খুঁজে পাবে কি করে? দেখো কোথায় গেছে! :p আমার কাছে তো আসেনি।
এই তুইকে ধার করে এনেছি। 😀
আমি তোমাকে এভাবে লিখলে কি আর খুশী হবে? :p
আমিও বড়ো কষ্টে আছি গো, আমাকে কেউ একটা চিঠিও লেখে না। ;(
মৌনতা রিতু
সত্যি আপু, কতো মমতা স্মৃতিচারন করলে।
তোমার মতো আমারও ইচ্ছে হয় এমন করে চিঠি লিখতে।
সত্যি একসময় বই বের করা সহজ ছিল না। আর এখন নিজের পনেরো বিশ হাজার টাকা খরচ করলেই বই বের করা যায়।
অনেকে আবার এমন ভাবে বই বের করে পা মাটিতে রাখে না।
আমার খুব ইচ্ছে নিজের লেখা গুলো বই এর মোলাটে বেঁধে ফেলতে। মেমন কি বলে জান, বলে, “মা আমি তোমার সব লেখা একদিন যত্নে রেখে দিব।”
ও গুছিয়ে রাখে অনেক কিছু। খুব গোছানো একটা ছেলে আমার। ছোটটা বাদর। ওর কোনো জিনিস তুমি এক যায়গা পাবে না।
তীর্থ সোনাকে আদর দিও।
নীলাঞ্জনা নীলা
শান্ত সুন্দরী জানো আমি রোজ আমার মামনির সাথে কথা বলি, সে পাঁচ মিনিট হোক কিংবা এক ঘন্টা। ফোন দিলেই প্রথমেই জিজ্ঞাসা করবে ‘আজ কি লিখেছিস?’ কাল বললাম একটা চিঠি। তারপর পড়ে শোনাতে হলো। এই মানুষটা কি যে জ্বালায়, শুধু বলবে একটা বই বের কর। আমার মামনি খুব ভালো লিখতো একসময়। মামনি বেশী লিখেছে উপন্যাস, গল্প। কবিতাও, তবে অতো নয়। মেমনের মতো আমিও গুছিয়ে রাখতাম মামনির বই-লেখার খাতা। জানো আমার বিয়ের সময় মামনির সেই লেখার খাতাটা হারিয়ে গেলো। কোত্থাও খুঁজে পেলাম না। ভেবেছিলাম মামনিকে চমক দেবো লেখাগুলো সব এক করে বই বের করবো। হলোনা গো আপু। কি যে দারুণ লিখতো মামনি, বিশ্বাস করো তুমি পছন্দ করতেই।
শোনো মেয়ে একজন গোছানো আরেকজন এলোমেলো না হলে হয়না। আমার যে এই একটা, এমনিতে শান্ত। কিন্তু ওর ক্লোজেট যদি দেখো। আজ গুছিয়ে দিয়েছি। আর পড়ার টেবিল বলে কিছু নেই, ল্যাপটপে পড়া আর খেলা দুটোই চলে। স্কুল থেকে একেবারে ল্যাপটপ দিয়েছে ওকে। ^:^