গভীর একটা সুখ এবং স্বস্তি নিয়ে নামলাম ট্রেন থেকে। আহ নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেলো শৈশব-কৈশোরী ঘ্রাণ। এ কেমন অনুভূতি আমার মধ্যে? দীর্ঘ পথশ্রমও কেন পারেনা আমাকে ক্লান্ত করতে? কিছু কষ্ট মনের ভেতর ছিলো, উফ ভুলে গেলাম কি করে? এভাবে গোগ্রাসে কি কষ্ট হজম করা যায়? মাঝে-মধ্যে বুঝিনা আসলে আমি কি সুস্থ? নাহ সুস্থ তো অবশ্যই, তা নইলে খাবার টেবিলে এতো আনন্দ কি করে হয়? কেন আমি এলেই বাসায় উৎসব শুরু হয়ে যায় কাজের মানুষদের মধ্যে? “এই নীলা দেখ মেয়ে অতো অহঙ্কার ভালো না।” আরে শুরু হলো এই তুই চুপ, ডায়েরী লিখতে দে। একটা কথাও না কিন্তু।
আজ সকালে বাসায় ফেরার পথে হেঁটে হেঁটেই এলাম বাজারের রাস্তা দিয়ে। এখানে এলে রিক্সা না আপন মাটিটাকে ছুঁতে ভালো লাগে। কিন্তু কি করা হাতে স্যান্ডেল নিয়ে তো বাজারে হাঁটা সম্ভব না। ব্যাগপ্যাক নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আসছি অমনি দেখি সিকদার আঙ্কেল। “এখন আসছো? কিসে পারাবতে? জানাওনি কেন? শ্রীমঙ্গলে যেতো কেউ গাড়ী নিয়ে। এখন রিক্সা নে রে পাগলী।” আঙ্কেল জানেন রিক্সা নেবোনা। “নাহ তোমার এই পাগলামী গেলো না।” আরে আঙ্কেল পাগলামী গেলে তো আর নীলাই থাকলাম না। ধুরো ডায়েরী কোথায় যে কোন ইঁদুরে অক্ষরগুলো দেখে দেখে খাবে, তাও না লিখে পারিনা।
বাপির এই রুটিনটার আজও বদল হলোনা। বাসায় এসেই জড়িয়ে নেয়, কপালে আদর দেয় তারপর জিজ্ঞাসা করে “একলা আইলে কেনে? জানাইতে তো পারতে!” ইস জানাবো! একা একা ট্রেনে আসি, আমি আমার অভিভাবক। কি যে লাগে! বিরক্তি লাগে ওইসব ছেলেগুলোকে আরে সাহস থাকলে সামনে এসে বল কি বলতে চাস! তা নয় একেকটা মেরুদন্ডহীন। ইচ্ছা করে জুতিয়ে ওদের মুখ বেঁকিয়ে দেই। ট্রেনে বসলে এসে ফালতু কথা আপা কোথায় যাবেন? একা আপনি? ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ খুব ভালো লাগছে একজন এসে ঠিক একই প্রশ্ন করলো। আমি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি একা যাচ্ছেন! একা যাওয়া তো ঠিক না। বাসায় কাউকে সাথে নিয়ে আসতেন। লোকটা ভাবতেও পারেনি। বাসায় এসেই বাপিকে বলেছি। বাপি শুনে হাসতে হাসতে বললো চুপ করে থাকা ভাব নেয়া মুখটা এতো দুষ্টু হলাম কি করে? বাপিকে বলেছি তার থেকে।
বাসায় পেছনের গেট দিয়ে ঢুকেই নিজের রুমে। এই মিষ্টি গন্ধটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই বাসাটা যেনো আলোয় আলোকময়। একান্ত আপন নীড়। আমার শুভ্র নীড়। অগোছালো রুমটা বাপি কাউকে ঢুকতে দেয়না। জানালার পাশে রকিং চেয়ারটা দুলে উঠলো যেনো। এই দাঁড়া আগে তো সবার সাথে দেখা করে নেই। সাধু বুড়াআআআআআ, ক্ষীরোদ—-, মিথিলা বুড়ীইইইইইই…ঘোড়াআআআআআ…ভারতীইইইইইইই, ডালাআআআআআ…মেজাজ গরম হয়ে যায়। ইচ্ছে করে কেন যে এমন করে? থাকো তোমরা আমি বাইরে গেলাম। বলেই ছুট। কুমু আপু তো অবাক! আজ যে আসা সে তো চমক দেয়া। ঢাকা শহর থেকে কেন পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, চমক আমি এভাবেই দেবো, দিয়ে যাবো।
ইস মাথায় একটা কবিতা কাটুর-কুটুর করছে যে! কি করি? লিখতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। থাক। এই ডায়েরী এখন গান শুনবো, আর বই পড়বো। তুই ঘুমা আজকের মতো বাই বাই। শুভরাত্রি। ইস দাঁড়া আগে বাপি-মামনিকে দিয়ে আসি, তারপর তুই।
৬ জানুয়ারী, ১৯৯৮ ইং
শমশেরনগর চা’ বাগান।
**সেদিন কবিতা আসেনি। এলে এখানে লেখা থাকতো। তবে সেই সময়কারই একটি কবিতা তুলে দিলাম যা রাফ হিসেবে এখনও আছে। আমার অরিজিনাল কবিতার খাতাটা হারিয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো নোটবুকগুলো আছে। ডায়েরীতেও বেশ কিছু আছে।
অবগাহন——–
টুপটাপ শিশিরের শব্দে আরেকটি রাত জেগে ওঠে
টুংটাং গজলের ভেতর ঝরা পাতার দিনের আগমনীবার্তা শোনা যায় যেনো,
বৃক্ষের নশ্বর দেহ একটু কি বেঁকে গেছে?
অনুভূতির ভেতর শ্যাঁওলা, তাই পিছলে পড়ে আবেগ।
হাতের চাদরে জড়িয়ে নিয়েছি নিজেকে,
আর তো কিছুই করার নেই!
হঠাৎ বহুদূর থেকে কান্নার শব্দ কানে আসে, কে কাঁদে?
ক্ষুধার্ত শিশু?
অসহায় নারী?
কান্নাগুলো একই কেন?
ফোঁটায় ফোঁটায় গাল ভেঁজায়, আর বুকের ভেতর যন্ত্রণাকে আরোও ভাসায়।
সবকিছু এতো অসহ্য!
চোখ বুঁজে আসছে,
টিনের চালে শিশির কি এখনও গান গাইতে থাকবে?
ক্যাসেটের ফিতে মোচড় দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে কেন?
দু’ চোখ ভরা ঘুম,
আমার ঘুম আসছে।
রাতের বিছানায় এবার কান্নারা স্নান করুক।
শমশেরনগর চা’ বাগান
৭ জানুয়ারী, ১৯৯৮ ইং।
**পরিচয় পর্ব—যাদের নাম নিয়েছি তারা সকলেই বাগানের লোক, আমাদের বাসায় কাজ করলেও কোনোদিন ওদেরকে অসম্মানিত করা হয়নি।
সাধু বুড়া – আমার শৈশব যার কোলে।
ক্ষীরোদ – রান্না করতো, কিন্তু আজ সে আর নেই।
মিথিলা বুড়ী – বাসার কাজ করতো। এই বুড়ীটাকে খুব জ্বালিয়েছি।
ভারতী – সেও বাসায় কাজ করতো।
ঘোড়া – মালির কাজ করতো। মানুষটা নেই।
ডালা – সেও মালির কাজে ছিলো।
এদের নিয়ে একদিন গল্প হবে। আমার সময়ের বেশীরভাগ যে ওদের সাথেই।
৩২টি মন্তব্য
সঞ্জয় কুমার
বাড়ির মত আপন আর কিছু নেই । এই আট দিনের লম্বা ছুটি কিভাবে শেষ হল বুঝতেই পারলাম না ।
নীলাঞ্জনা নীলা
কতোদিন পর বাড়ীর মুখ দেখবো, আমিও জানিনা।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
অরণ্য
“আরে আঙ্কেল পাগলামী গেলে তো আর নীলাই থাকলাম না।” – ঠিক! ঠিক! ঠিক! 🙂
আরেকটু বলি, কিছু মনে করা যাবে না।
আপনার হৃদয় দারুন স্বচ্ছ। এ কাঁচ বা ক্রিস্টাল নয়; এ জল, সুপেয়ও বটে। 🙂
আপনি ভাল লেখেন। আপনার ও স্বচ্ছ হৃদয় আপনাকে লেখায়। 🙂
শুভেচ্ছা জানবেন। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
এতো অনবদ্য মন্তব্য আমি কি করি! ;?
খুশীতে 😀 \|/
এই আনন্দের জন্যে -{@
জিসান শা ইকরাম
এসব অক্ষর কখনো অস্পষ্ট হয় না
চকচকে ঝকঝকে থাকে উজ্জ্বল হীরক খন্ডের মত।
ভালো লিখেছ।
শুভ কামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা পুরোনো ডায়েরী শেষ পর্যন্ত ইঁদুরে খায়নি। খাচ্ছে আমাদের সোনার সোনেলা। -{@ (3
খেয়ালী মেয়ে
নীলা আপু তোমার ছেঁড়া পাতার অস্পষ্ট অক্ষর থেকে এখনো যে একধরনের সতেজ মুগ্ধতার ঘ্রান ভেসে আসছে -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
খেয়ালী আপুর খেয়ালে মন নাচে, প্রাণ নাচে। \|/
-{@ (3
অনিকেত নন্দিনী
ডায়েরির লেখা যতোই অস্পষ্ট হোক, এসব স্মৃতি কখনো অস্পষ্ট হয় দিদি? এসব স্মৃতির আলাদা একটা গন্ধ থাকে, সময়ে অসময়ে সেই গন্ধ আমাদের মাতাল করে দেয়।
চা বাগানের উজ্জ্বল রোদওঠা মাতালন্ধী দিনগুলো লেখার ভেতর দিয়েই দেখতে পেলাম।
নীলাঞ্জনা নীলা
নন্দিনী দিদি স্মৃতির এসব গন্ধ শেষ নিঃশ্বাসেও লেগেই থাকে।
অনেক সুন্দর মন্তব্যর জন্য -{@ (3
বোকা মানুষ
মিষ্টি লেখা! লেখায় প্রচ্ছন্ন ভাবে নারী থেকে “মানুষ” পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার তীব্র ইচ্ছেটুকুর ঘ্রাণ পেয়ে ভাল লাগলো! 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
অসংখ্য ধন্যবাদ এমন মন্তব্যের জন্য। -{@
হিলিয়াম এইচ ই
ভাল্লাগছে 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
সীমান্ত উন্মাদ
স্মৃতির পট থেকে নেওয়া গল্প কিন্তু যেন জীবন্ত। আপু আপনি যেভাবে গল্পগুলো লিখেন, জীবন স্মৃতির ডাইরে থেকে হলেও মনে হয় যেন গতকাল ঘটে গেছে। তাই আমার ভীষন ভালোলাগে।
শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর।
নীলাঞ্জনা নীলা
জীবন্ত এবং সত্যি যে! 😀
গল্প নয়। 🙂
শুভকামনা গ্রহণ করিলাম। -{@
সিকদার
ছেড়া ছেড়া কথায় ঘটনা গুল যেন স্মৃতির উঠনে নাচছিল আর আমি উপভগ করলাম মন ভরে । দারুন !!
নীলাঞ্জনা নীলা
স্মৃতির উঠানে নাচ! \|/
ধন্যবাদ। 🙂
তামিম রুহুল
ভাল লাগল 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
ছাইরাছ হেলাল
একান্ত ই আপন শুভ্র নীড়ের ডাক আমরাও শুনতে পাই এই দূরে থেকেও।
এখানে বিছানারা কাঁদলেই স্বাভাবিক।
যেতে হবে সেখানেই কোন এক দিন ।
নীলাঞ্জনা নীলা
মেহজাবীন কেমন আছে?
-{@
লীলাবতী
এমন লেখা পড়ে মুগ্ধতার রেশ থেকে যায় অনেক দিন।
নীলাঞ্জনা নীলা
লীলাবতী দিদি আমি তো মুগ্ধতা নিয়ে চলি, যখন আপনার লেখা পড়ি। -{@ (3
স্বপ্ন
লেখা এবং কবিতায় খুবই ভালো একটি পোষ্ট।
নীলাঞ্জনা নীলা
স্বপ্নের মন্তব্যকে সাজিয়ে রাখলাম। -{@
শুন্য শুন্যালয়
আমি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি একা যাচ্ছেন! একা যাওয়া তো ঠিক না। বাসায় কাউকে সাথে নিয়ে আসতেন।… হা হা হা এইনা আমার নীলা আপু।
কবিতায় পুরোপুরি অবগাহন করলাম আপু। রাতের বিছানায় এবার কান্নারা স্নান করুক। আহ্।
ফেরারী দিনগুলোর এই ডায়েরী, এর চাইতে প্রিয় কিছু নেই। ছেড়া পাতা আবার জোড়া লেগে যাচ্ছে। লাগতেই থাকুক। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
আসলেই সেদিন এমন হেসেছি। :D) :D) :D) :D) :D)
অফুরান ভালোবাসা। -{@
অলিভার
ছেঁড়া পাতার অস্পষ্ট অক্ষরে অনেক স্মৃতি উঠে এসেছে।
ভালো লাগলো আপনার ডায়েরির কিছু অংশ পড়ে 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
স্মৃতি-ই থেকে যায়।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে অলিভার। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তোমার মুখের কথা না শুনিলে, পরান আমার রয়না পরানে।
নীলাঞ্জনা নীলা
তাই বুঝি? তাইতো চলে এলাম। \|/ \|/