
চাকরীটা ছাড়ার কথা ছিলো না। ব্যাট বল একসাথে কাজ করলো না। আমার হাজব্যান্ডের বদলি, যেতে হবে। অথচ আমাকে বদলি দিলো না। বিদায় নেয়ার সময় আমার এক কলিগ বললো, ” আপা, কতোদিন বিশ্রাম নেন না। এবার নতুন জায়গায় গিয়ে ছ মাস বিশ্রাম নিয়ে নবউদ্যমে কাজ শুরু করিয়েন। ”
সেট হতে না হতে শুরু হলো করোনা। আমাদের মধ্যবিত্তের টানাপোড়ন। বিধাতার দেয়া বিশ্রাম শেষ হয় না। স্বপ্নে দেখি, ” একটা লাল টকটকে সূর্য। নদীতে ভেড়ানো নৌকা, সলাজ বৌ এর উঁকি ঝুঁকি। ”
টিং টং! টিং টং! কলিং বেল বেজে ওঠে। পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে দরজা খুলি। সারি সারি লাশ।
প্রথমজনের কাফনের কাপড় তুলে দেখি, আমার প্রেমিক। মনে হলো, এইতো সেদিন টুংটাং এসএমসএস। ” লাবণ্য আমি চলো যাচ্ছি। দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্তে। আর হয়তো কখনো দেখা হবে না। নিষ্প্রাণ শহরের, তীব্র নিরবতায়।” বার্তাটা পড়ে টুপটাপ চোখের থেকে কী পড়েছিলো জানিনা। তবে বাষ্পীভুত হতে সময় নেয়নি। আনমনে ঢিপঢিপ হৃদযন্ত্রটা বলেছিলো, ” ভালো থেকো !” আজ আঁকড়ে ধরেও লাভ নেই।
২য় লাশটি দেখে আঁতকে উঠি। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। কিছুদিন আগের কথা, ফোন পেয়ে নদীর ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওর কী এক শখ ভাসলো! সাঁতরে নাকি নদীর এই তীর থেকে ঐ তীরে যাবে। বলে,” এখন তো নদী শুকায় গেছে। ১০০ গণতে গণতে ফিরে আসবো। ” আর এখন সেই নদীকে আমি খুঁজি।
৩য় জন আমাদের দুধ ওয়ালা। বাকুয়া ঘাড়ে করে দুধ নিয়ে আসে যাত্রাপুর থেকে। আমরা যখন ছোট ছোট তখন থেকেই দেখি তার একই চেহারা। এতো পরিশ্রমে তার চেহারা নষ্ট হয়নি। বিস্মিত ! অবাক রোগের কাছে আত্মসমর্পণ।
সিনেমার দৃশ্যপটের মতো মাথাটাও ঘুরে যায়। রাস্তা থেকে শহর — শহর থেকে নগরে চোখ চলে যায় অনেক দূরে। সিঁড়ি বেয়ে শুধু নামি আর নামি। মায়াবী চোখের মেয়েটি মায়ের সাথে আসতো কাছ করতে। আজ তাড়া নেই। মাকে বলবে না। ” ও মা, চলতো, বড় দেরি হয়ে গেছে। ”
এবার আমি উপরে উঠে আসি। ক্লান্তিহীন পথ আর ভালো লাগে না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে শায়রা বানু কে ফোন দেই। ” দুঃখিত কাঙ্খিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।” বুকটা ধরাস ধরাস করে। আবার দেই —–! সেই একই কণ্ঠস্বর ! ” দুঃখিত………… হচ্ছে না !” বুঝলাম ও আর এই পৃথিবীতে কোনদিনও রিসিভার তুলবে না।
টিভির সামনে গিয়ে বসি। মৃত্যু কি সহজলভ্য? মনে হয় ; একেক জনের মৃত্যু একেকটা অধ্যায়। আমরা যখন চলি ফিরি। তখন ভাবি চিরকাল বাঁচবো। কিন্তু মৃত্যু আসে নিঃশব্দে, কোন প্রস্তুতি না নিয়ে।
টিভি দেখা বাদ দিয়ে। কলম নিয়ে বসি। এই খানেও মৃত্যু ছাড়া কিছু আসে না। মৃত্যুকে আর উদযাপন করবো না। মৃত্যু আসবে বলেই জীবন জীবিত থাকে। ” Death shall be died ! ” কিন্তু এ কোন কারবালা ? কার মহিমা ?
যুবকরা ” Hundred days in solitude ” পড়ে এখন ঘরে বসে কী বোর্ড চাপে। স্ক্রিনে স্ক্রিনে খবর, কাভার ফটো। ” অক্সিজেন দরকার। আইসিইউ খালি নাই। শামীম তার মাকে নিয়ে ৩০০ মাইল পড়ি দিয়ে পৌঁছালো হাসপাতালে। ছেলেকে নিয়ে মায়ের আহাজারি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গুলি। গরীবের পেটে লাথি। রিকশা উল্টে রেখেছে পুলিশ। আমরা খামু কী? আমাদের তো সঞ্চয় নেই। রংপুরে কিছু ছাত্রছাত্রীর উদ্যোগে ১০০ জনের ইফতার। এক টাকায় প্রতিদিন আহার করাচ্ছে বিদ্যানন্দ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া টু হাট হাজারী। মোদি আসলো বলেই করোনা বাড়লো ————— স্ক্রল করতে করতে ইউটিউবে চলে আসি। সেজেগুজে দুই নারী রান্না শেখাচ্ছে। আবার রাস্তায় নামি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফুটেছে বরুণ ফুল। আর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল মনি কান্ত ফুল। এসব দেখে আবারও গুগলে গিয়ে খবর পড়ি।
মানবজাতি কি ধ্বংস হবে? না এইখানে দাঁড়িয়ে নতুন করে গল্প শুরু হবে। একটা নতুন জীবনের জয়গান। যেখানে ভালোবাসা সত্যিকারের ভালোবাসা হবে।
উৎসর্গ : ব্লগার খাদিজাতুল কুবরাকে। আল্লাহ তাঁকে শক্তি দান করুন।
২৮টি মন্তব্য
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
সুন্দর লেখা।।।।।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটির এক লাইনও কি আপনি পড়েছেন? কেন সুন্দর লেখা বললেন তা মন্তব্যে লিখুন। এটি ব্লগ, ফেসবুক না।
আরজু মুক্তা
এটা সুন্দর নয়। অনেক দুঃখের। পড়ে মন্তব্য করবেন।
হালিমা আক্তার
চমৎকার গল্প। অসাধারণ প্রেক্ষাপট ।
আরজু মুক্তা
সমসাময়িক।
ধন্যবাদ আপা
জিসান শা ইকরাম
করোনা পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবন, সময়।
প্রিয়জনদের মৃত্যু, জগত হতে চলে যাওয়া – এসব অপ্রকৃতস্থ করে দিচ্ছে আমাদের। কাউকে কিছুদিন না দেখলেই ভাবি, বেঁচে আছেন তো তিনি? করোনার থাবা তার উপর পরেনি তো?
আমাদের ব্লগার খাদিজাতুল কুবরার স্বামী চলে গেলেন এই জগত হতে। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
আপনার জন্য শুভ কামনা।
গল্প ভালো হয়েছে।
আরজু মুক্তা
নিশ্চয় আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন।
বন্যা লিপি
পুরো লেখাটা একটা আলাদা ঘোর। প্রতি প্রেক্ষাপটে একেকটা টান টান পড়ার আকর্ষন। আমরা লিখি কেন? আমরা পড়ি কেন? আমাদের মনের ভেতরে বসবাসরত শব্দপুঞ্জকে ঢেলে দিই কাগজের বুকে, তা হয়ে ওঠে পাঠকের পড়ার আগ্রহ। এই লেখা তেমনই এক লেখা।মহামারী এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। মৃত্যুর উদযাপন চলছে সর্বত্র। বেঁচে আছি এ পর্যন্ত মহান স্রস্টার কৃপায় এই মহা করুনা মহান বিধাতার।
হে দয়াময় কৃপা করো সবাইকে।
আরজু মুক্তা
ুমন কমেন্ট পরম পাওয়া।
নিশ্চয় আল্লাহ সব জানেন ও বোঝেন। সামনের দিনগুলি আলো ঝলমল হবে। এ কামনা করি
তৌহিদুল ইসলাম
এক বিষণ্ণ সময় পার করছি আমরা। কাল কি হবে কেউই জানিনা। বুকে আক্ষেপ নিয়ে কারো কথা ভাবলে শঙ্কা লাগে এটা ভেবে সে ভালো আছেতো?
খাদিজা আপুর জন্য সত্যি কষ্ট পেয়েছি। তিনি ও তার পরিবার ভালো থাকুন এটাই প্রার্থনা।
শুভকামনা আপনার জন্যেও আপু।
আরজু মুক্তা
এই অবস্থার ইতি ঘটুক। আল্লাহ আপনি সহায় হোন
মোঃ খুরশীদ আলম
আহ!
ছাইরাছ হেলাল
ব্লগ ফেসবুক না, মনে রেখে মন্তব্য দিতে হবে।
আরজু মুক্তা
প্যাথেটিক বটে
ছাইরাছ হেলাল
“Death shall be died” এটি আমি চাই, মনে প্রাণে।
একটি মুভির ডায়লগ একটু ঘুরিয়ে বলি, I will burn thar hell….
আসলে অমোঘ মৃত্যু রোধ করা যায় না, যাবে ও না। তাই বলে এমন মৃত্যু-দৃশ্য সহ্য করা প্রায় অসহনীয়।
তবুও সময় চলে যাচ্ছে সময়ের মত নিজ নিজ গতিতে, আমরা শুধুই নিরব দর্শক।
নেই স্পন্দন
নেই হচ্ছে রক্তের উষ্ণতা ক্রমশ,
শিরা-ধ্মনী আর বেজে উঠছে না;
বদ্ধ ডোবা এখন আবেগ- আনন্দের
পাড়-ভাঙ্গা নদী,
মৃত্যু এখন পরস্পরের সৎপ্রতিবেশী।
আল্লাহ যেন কুবরাকে এমন কঠিন শোক সহ্যের সক্ষমতা দান করেন। আমিন।
আরজু মুক্তা
মৃত্যু ই আজন্ম সত্য। এড়ানো কঠিন।
সবাই এই নির্মম পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠুক
রোকসানা খন্দকার রুকু
এমন এক সময়ে আমরা দাঁড়িয়েছি কখন কোন সংবাদ আসবে জানা নেই। কিছু খবর সত্যিই ভাষা হারিয়ে স্তম্ভিত করে দেয়। তখন মনে হয় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সবাই দাডিয়ে গেছি। শান্তনা বা অবশিষ্ট বলে কিছুই নেই।
আরজু মুক্তা
অমোঘ সত্য। কখন কি ঘটে?
সাবিনা ইয়াসমিন
গল্পের মাঝে বর্তমান সময়ের বাস্তবতা খুব নির্মম ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যেন সময়ের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। আমরা ভবিষ্যৎ জানি না, জানতাম না আগেও। কিন্তু এখনকার অন্ধকার সময়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে সামনের পথ পাড়ি দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? আলোকিত দিন আসা পর্যন্ত কি বেঁচে থাকবো!
খাদিজাতুল কুবরার পরিবারের উপর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করি। আল্লাহ তায়ালা তার স্বামীকে জান্নাতবাসী করুন। খাদিজার পরিবারের উপর থেকে বিপদ আপদ দূর করে তার জীবন যাপনে সহায় হোন। আমিন।
আপনিও ভালো থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন।
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
কতোদিন বেঁচে থাকবো বা আলোকিত দিন দখবো কিনা জানি না। তবে, এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি। এটাই বড়।
নিরাপদে থাকুন।
আলমগীর সরকার লিটন
অসাধারণ লেখেছেন মুক্তা আপু আগাম ঈদের শুভেচ্ছা রইল
আরজু মুক্তা
জি ভাই। নিরাপদে থাকেন
বোরহানুল ইসলাম লিটন
নির্মম সময়ের সচিত্রণ।
এভাবেই চলে যাচ্ছে কতো প্রিয়জন চিরতরে
তবুও যেন উৎকণ্ঠার মাঝেই বেঁচে থাকা।
আন্তরিক শুভ কামনা জানবেন সতত।
আরজু মুক্তা
আল্লাহ ক্ষমাশীল। সামনের দিনগুলি নিশ্চয় ভালো হবে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এ এক অদ্ভুত যন্ত্রণা – না যায় কাউকে বোঝানো, না যায় নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়া ঈশ্বরের এমন নির্মমতায়। ঈশ্বর আজকের এই মহামারীতে আমাদের কে একদম অসহায় করে দিয়েছে সারি সারি মৃত্যুর মিছিলে। কুবরা আপুর প্রতি সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছু বলার শক্তি নেই। ঈশ্বর ওনাকে শক্তি দিন, সাহস দিন বেঁচে থাকার এ লড়াইয়ে।
আরজু মুক্তা
এখন চিন্তা এরপর কি আমি?
মহান আল্লাহ নিশ্চয় এ রোগ থেকে মুক্তি দিবেন আমাদের।
আশরাফুল হক মহিন
অসাধারণ লেখা প্রিয়,
প্রতিটা লেখায় মনে দাগ কেঠে যায়।
বুঝাতে পারি না মনের যন্ত্রণা
খুবই নিমর্ম একটা বেদনা।
আরজু মুক্তা
নিশ্চয় নতুন সূর্য উঠবে।
শুভ কামনা