শারদ সুন্দরীময়ী মা...
শারদ সুন্দরীময়ী মা…

“অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।।”—-অবশেষে শারদীয়া এসেই গেলো। নীল আকাশে তুলো তুলো মেঘ, প্রকৃতির বুকে শুভ্র কাশফুলের নাচন, বাতাসে শিউলী ফুলের ঘ্রাণ দেবীর আগমনী বার্তাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। দেবীপক্ষকে বরণ করার সময় এখন। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ অমাবস্যার দিন থেকেই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, সেদিনই মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়। এই মহালয়াতেই দেবীকে আবাহন করা হয়। আর দেবীপক্ষতেই শারদীয়া পূজা হয়ে থাকে। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপুজা উৎসব পালিত হয়। আচ্ছা দুর্গা মানে কি? তার উত্তর হলো, দুর্গা মানে তিনি, যিনি সঙ্কট থেকে রক্ষা করেন। এর সম্পূর্ণ মানে;
“দ”=দৈত্য বিনাশ,
“উ-কার”=বিঘ্ন নাশ,
“রেফ”=রোগ নাশ
“গ”=পাপ নাশ
“আ-কার”=শত্রু নাশ।

এর অর্থ হলো দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। দুর্গাষষ্ঠীতে দেবীর বোধন, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে মা দুর্গার পূজা এবং বিজয়া দশমীতে আনন্দময়ী মায়ের বিসর্জন হয়ে থাকে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা, সেদিন লক্ষ্মীদেবীর পূজা পালিত হয়। পৃথিবীর বহু দেশে আনন্দময়ীর পূজা হয়ে থাকে। বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের প্রধান উৎসবই হচ্ছে দুর্গাপূজা। দেবীদুর্গা যখন অবতীর্ণ হন তখন তাঁর সাথে থাকেন ঐশ্বর্যদায়িনী দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যাদেবী সরস্বতী, সিদ্ধিদাতা ও বিঘ্ননাশকারী দেবতা শ্রী গণেশ এবং ক্ষাত্র অর্থাৎ রণশক্তির দেবতা কার্তিক। দেবীদুর্গার বাহন সিংহ আর, মহামায়ার পায়ের নীচে মহিষাসুর।

মায়ের ডানে সরস্বতী, বাঁয়ে লক্ষ্মী...
মায়ের ডানে সরস্বতী, বাঁয়ে লক্ষ্মী…

দুর্গাপূজা কেন হয়? সনাতন ধর্মে আছে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তাহলে কেন এতো দেব-দেবী? আসলে দেব-দেবী হলেন একেকটি শক্তি, ঈশ্বরের ঐশ্বরিক মায়া। অন্যভাবে বলি, মানুষ চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শোনে, একেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একেকটি কাজ করে। কান দিয়ে যেমন দেখা যায়না, তেমনি চোখ দিয়ে শোনাও যায়না। ঈশ্বরও তেমনি তাঁর একেকটি শক্তির সাহায্যে একেকটি কর্ম সাধন করে থাকেন। আর সেই শক্তি-ই বিভিন্ন দেব-দেবী রূপে আমাদের মানব সম্প্রদায়ের কাছে পরিচিত। তেমনি দুর্গা হলেন শক্তিদেবী, এককথায় বলা যায় পরম ঈশ্বরের নারীশক্তিরূপ হলো মা দুর্গা। তিনি নারীশক্তির আধার। নারী একইসাথে মা, স্ত্রী, বোন। মা হয়ে সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য যতো বাধাই আসুক না কেন, তিনি তা প্রতিরোধ করেন। নারীকে যারা দূর্বল এবং অসহায় হিসেবে ভাবে তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করতে হিন্দুধর্মে দেবীপূজা করা হয়ে থাকে।

“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমো নম:।।”—এটি হলো শক্তিবাদের মূলমন্ত্র। শক্তি-ই পরমব্রহ্ম। আর এই পরমব্রহ্মই চৈতন্যময়ী মহাশক্তি বা মহাদেবী হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন।

শক্তিময়ী মাতৃরূপ...
শক্তিময়ী মাতৃরূপ…

“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা 
নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমো নম:।।”আবার এই মহামায়াই মাতৃত্বের প্রতীক। মায়াময়ী, স্নেহ-ভালোবাসার আরেক মূর্তি ত্রিনয়নী দুর্গা। দেবীদুর্গা বৈদিক দেবী নন, তিনি পৌরাণিক দেবী। পুরাণে দেবীর তিনটি রূপ। প্রথম রূপ দেবীদুর্গা, দ্বিতীয় রূপ জগদ্ধাত্রী এবং তৃতীয় রূপ ভবানী। এই তিনটি রূপ-ই শক্তিরূপ। শক্তির এই প্রতীক মাতৃরূপেও দেবীদুর্গার মধ্যে বিরাজমান।

মহামায়ার আগুণময়ী রূপ...
মহামায়ার আগুণময়ী রূপ…

এবারে আসি কবে, কোথায় দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিলো! বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপুজা হয় রাজশাহী বিভাগের তাহেরপুর জেলায়। কথিত আছে রাজা কংশ নারায়ন রায় কর্তৃক বিশ্বের প্রথম দুর্গাপূজাও নাকি এই তাহেরপুরেই হয়েছিলো। অবশ্য এও বলা হয় যে, দেবীদুর্গার পূজা বঙ্গদেশে ঘটা করে শুরু করেন বল্লাল সেন। আর দেবীদূর্গা পুরোপুরি বাঙ্গালীর দেবী হয়ে ওঠেন সুলতানী আমলে এবং সার্বজনীন রূপে প্রতিষ্ঠা পান স্বদেশী আন্দোলনে। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে “বন্দে মাতরম” গানটি তৈরী করেন, তা দেবীদুর্গাকে ভেবেই। দেশমাতৃকা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা সবেতেই কিন্তু মা। আর এই মাতৃশক্তি মা দুর্গার মধ্যে বিরাজমান।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশকে দেবীদুর্গার শক্তি এবং স্নেহময়ী রূপ হিসেবে তুলে ধরেছেন এই গানটির মাধ্যমে।

“ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে
বাঁ হাত করে শঙ্কা হরণ
দুই নয়নে স্নেহের হাসি
ললাট নেত্র আগুণবরণ।
ওগো মা তোমার কি মূরতি আজি দেখি রে!
তোমার দূয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।”

"ওগো মা তোমার কি মুরতি আজি দেখি রে!"...
“ওগো মা তোমার কি মুরতি আজি দেখি রে!”…

মা দুর্গা সমস্ত নারী জাতীর প্রতিক। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, দুর্গা পূজায় গণিকালয়ের মাটির প্রয়োজন পড়ে। ওখানকার মাটি ছাড়া কিছুতেই প্রতিমা পূর্ণতা পায়না। সমাজে সকল নারী-ই এক, নীচু কিংবা উঁচু জাত বলে কিছু নেই। আর এই গণিকা সম্প্রদায়কে সম্মান প্রদর্শনের জন্যই ওখান থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয়।

পরিশেষে এসে বলতে চাই, ধর্মের চেয়ে মানবতা বড়ো। আর এই সার্বজনীন দুর্গাপূজা শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে আসুক আমাদের প্রত্যেকের জীবনে। এও বলতে চাই যে, দুর্গাপূজা নিয়ে বলার মতো অতো বেশী জ্ঞান আমার নেই। তাছাড়া অনেক কিছুই লেখা হয়ে ওঠেনি। যেটুকু লিখেছি তা আসলে জ্ঞানের মধ্যে পড়ে কিনা, সেও আমার জানা নেই। এই লেখাটি লিখতে আমাকে সহায়তা করেছে গুগল থেকে পাওয়া ইতিহাস এবং কিছুটা আমার মন থেকে। তাই যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, ধরিয়ে দেবেন। জানার অসীম আগ্রহ আমার। আর অবশ্যই ক্ষমা করবেন আমার এ ভুলের জন্য। সবাইকে জানাচ্ছি শারদীয়া দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা। সকলেই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আনন্দময়ীর আগমনে সমস্ত অপশক্তি পরাজিত হোক, এই-ই কামনা।

**এবার পূজো শুরু হবে অক্টোবরের ৭ তারিখ।
আমার  রাত পোহালো শারদ প্রাতে
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।।”

আর শেষ হবে ১১ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মাধ্যমে।
“সময় যে তার হল গত
নিশিশেষের তারার মতো
শেষ করে দাও শিউলিফুলের মরণ-সাথে॥”———-

বিজয়া দশমীতে মায়ের মুখ...
বিজয়া দশমীতে মায়ের মুখ…

আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে 

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩ অক্টোবর, ২০১৬ ইং।

 

১৯৭১জন ১৯৬৭জন
0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ